আজ ২৪ জানুয়ারি। এই দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থান দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৬৯ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর।
মতিউরের শহীদ হওয়ার সংবাদ বাতাসের মতো ছড়িয়ে যায় সারাদেশে। দীর্ঘদিন যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলার ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সূচিত হয় মহান গণঅভ্যুত্থানের।
এর আগে ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও ডাকসু আহ‚ত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন শেষে মিছিল বেরুলে, সেই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) গ্রুপের নেতা আসাদুজ্জামান। আসাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট সূচিত হয়। কবির ভাষায় সেই দিনের স্লোগান ছিল ‘আসাদের রক্তমাখা শার্ট জাতির পতাকা’।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকেই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের ওপর থেকে বাঙালির মোহ কেটে যেতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতির ওপর জাতিগত ও অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ শুরু হয়। বাংলা ভাষাভাষী জনগণ পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জিন্নাহর এই ঘোষণা
তাৎক্ষণিকভাবে বাংলার ছাত্রসমাজ-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীসহ সচেতন জনগোষ্ঠী প্রতিবাদে নেমে পড়ে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা’ বাঙালির আত্মমর্যাদার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠা করার জন্য পৃথিবীতে কোনো জাতিকে এভাবে বীরের রক্তে শোণিত হতে হয়নি। এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর গণরায় যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। পাকিস্তানের ইতিহাস ধর্মের লেবাসে পরিচালিত সামরিক শাসনের ইতিহাস।
১৯৬২ সালে শিক্ষার আন্দোলন, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ বাঙালি জাতির মধ্যে এই উপলব্ধি এনে দেয় যে, পশ্চিমাদের হাতে বাঙালির নাগরিক অধিকার শিক্ষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জাতিগত পরিচয় কোনোটাই নিরাপদ নয়। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অলি আহাদ, তোয়াহা, আবদুল মতিন, গাজিউল হক, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক ভাষাসৈনিক সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে পশ্চিমা জাতিসত্তার যে বিরোধ, সেই বিরোধটি যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিকশিত হতে থাকে। অন্য নেতারা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে শোষিত জনগোষ্ঠীর মূল দ্বন্দ্বটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে পরিকল্পিতভাবে আন্দোলন সংগ্রামে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গঠিত হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ৬ দফা। এই ৬ দফা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ৬ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ যৌথভাবে দেশব্যাপী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। এরই পাশাপাশি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক আপসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, মোজাফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) স্বকীয় ধারায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হয়। পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের দ্ব›দ্ব প্রকট আকার লাভ করায় সব রাজনৈতিক দল রাজনৈতিকভাবে কাছাকাছি অবস্থানে আসে। ১৯৬৮ সালে নভেম্বরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন তীব্রতর রূপ লাভ করে। এই আন্দোলনে বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক-পেশাজীবী জনতা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা মূলত ছিল বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিচ্ছায়া।
১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ১১ দফার ভিত্তিতে গঠিত হয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। ডাকসুও এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফার মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ও ডাকসুর সমন্বয়ে এই প্লাটফর্ম গঠিত হয়। ডাকসু ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আসাদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে শহীদ কিশোর মতিউরের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় মহান গণঅভ্যুত্থান ২৪ জানুয়ারি ১৯৬৯। গণঅভ্যুত্থান দমন করতে ব্যর্থ হয়ে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতেও জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার ঠেকানো যায়নি। এই গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরেই মুক্ত হন কারাবন্দি আগরতলা মামলার (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব) আসামি শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্যরা। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে নিরঙ্কুশ বিজয়, পশ্চিমাদের ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা ও ষড়যন্ত্র বাঙালি জাতিকে অনিবার্যভাবে এক দফা অর্থাৎ বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে (স্বাধীনতার) কেন্দ্রীভূত হয়। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই দিন থেকে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন ও ছাত্রসমাজের আপসহীন অবস্থান আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে যা থেকে পিছিয়ে আসার আর কোনো পথ কারো জন্য খোলা ছিল না। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে অগ্রগ্রামী অংশ জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা ও জয়বাংলা বাহিনী গঠন করে স্বাধীনতার আন্দোলনকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদন ক্রমেই এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ডাকসু ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারাই মূল ভূমিকা পালন করেন।
এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে উঠে। গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের ধারাবাহিকতায় ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। এর ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে আনে মহান স্বাধীনতা। ফলে বাঙালি জীবনে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্ব অপরিসীম।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে দায়িত্ব পালন সহ সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশে একটি প্রগতিশীল আধুনিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠন, গণতান্ত্রিক মানাবধিকার ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জনকল্যাণমূখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হোক গণঅভ্যুত্থান দিবসের অঙ্গীকার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)