বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় সব হারিয়ে এখন শেষ সম্বল ভেঙ্গে কলাপাতায় ভাত খাচ্ছেন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মাদারপুর ও জয়পুর পাড়ার সাঁওতালরা। সহায়-সম্বল সব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে ভয়াবহ আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। সাঁওতাল পল্লী ঘুরে তাদের কষ্টকর জীবন দেখে ঢাকায় ফিরে তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন একজন সাংবাদিক।
সরেজমিন সাঁওতাল পল্লী ঘুরে যে চিত্র দেখেছেন সে ব্যাপারে সিনিয়র সাংবাদিক পিনাকী রায় চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘৬ নভেম্বর পুলিশ ও প্রশাসন যে জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করেছে তার চারপাশে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে যাতে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। সেখানে কোনো সাঁওতালকে দেখা যায়নি।’
এ বিষয়ে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ‘গর্ব এবং সন্তুষ্টি’র সঙ্গে বলেছেন, চিনিকলের জমি দখলমুক্ত করা হয়েছে।
সাঁওতালদের সামনে রেখে ভূমিদস্যুরা অরাজকতা চালিয়েছে: শিল্প মন্ত্রণালয়
কীভাবে হামলা হলো? স্থানীয়রা তাকে যেটা জানিয়েছে সেকথা উল্লেখ করে পিনাকী বলেন, সাঁওতালরা সবসময়ই উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকতেন। পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাঁওতালদের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। হামলার দিন আখ কাটার কথা বলে লোকজন জড়ো করা হয়, তখন আখ কাটতে বাধা দিলে শুরু হয় সংঘর্ষ এবং চারপাশ থেকে একযোগে হামলা শুরু হয়।
তবে, স্থানীয়রা তাকে জানান: এটি মোটেও আখ কাটতে গিয়ে বাধা দেয়ার ফলে সৃষ্ট কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। পুলিশ প্রহরায় আখ কাটতে যাওয়ার কোন যুক্তি নেই। আদিবাসী-বাঙালিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়।
হামলার আসল কারণ ভূমি দখল
কেন হামলা হলো? এ ব্যাপারে সাঁওতালরা পিনাকীকে যেটা জানিয়েছেন সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ভূমি দখলই আসল কারণ।
হঠাৎ করে জমি উচ্ছেদ দরকার হলো কেন? পিনাকী বলেন, এটা হঠাৎ নয়, দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া। সরকার বলছে সাঁওতালদের বসবাস করা জমি তাদের না। সেখানে ১,৮৪২ একর জমি ১৯৫৪ সালে অধিগ্রহণ করা হয় যার জন্য আইন পাশ হয় পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালে। অধিগ্রহণের সময় বলা হয়েছিল, এই জমি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। কিন্তু চিনিকল যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন (২০০৪-০৫) এই জমি এমপি, চেয়ারম্যান ও স্থানীয় প্রভাবশালী এবং তাদের আত্বীয়-স্বজনের কাছে লিজ দেয়া হয়।
তিনি বলেন, সাঁওতালদের দাবি এই জমি তাদের এবং সেখানে তারা আখসহ অন্যান্য ফসল করে আসছিলেন। প্রভাবশালীরা জমি দখল করতে চাইলে ২০১২ সালে পাল্টা ভূমি উদ্ধার কমিটি গঠন করেন সাঁওতালরা। ওই কমিটির সদস্য সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এই সাঁওতালরা উচ্ছেদ আতঙ্কে তীর ধনুক দিয়ে পাহারা দিতেন। সেই প্রক্রিয়া থেকেই পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে তাদের উচ্ছেদ করে প্রশাসন ও প্রভাবশালীরা।
পুলিশের উপস্থিতেই তাদের ওপর হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে
পিনাকী বলেন. সাঁওতালরা তাকে জানিয়েছে, পুলিশের উপস্থিতেই তাদের ওপর হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
গুলির নির্দেশ এবং পরিকল্পিত আগুন দেয়ার দায় কে নেবে? এই প্রশ্নের জবাবে গোবিন্দগঞ্জের ইউএনও পিনাকীকে যা বলেছেন তা উল্লেখ করে তিনি বলেন: প্রশাসন বলছে, তারা চারদিক থেকে চাপে ছিলো। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বাঙ্গালীরা হামলা চালায়। সেসময় পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে গুলি চালায় এবং গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
উচ্ছেদ ও হামলার শিকার সাঁওতালরা এখন মানবেতরভাবে দিন-রাত পার করছেন বলে জানান পিনাকী। তিনি বলেন, তাদের মধ্যে যারা পেরেছেন আত্বীয়-স্বজনদের কাছে চলে গেছেন, আর যাদের সেই উপায় নেই তারা খোলা আকাশের নিচে খড় বিছিয়ে রাত কাটাচ্ছেন।
কোনভাবে একটি হাঁড়ি যোগাতে পারলে তাতে চাল বা অন্যকিছু ফুটিয়ে খাচ্ছেন। বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়ায় সব হারিয়েছেন তারা। থালাবাটির অভাবে সেদ্ধ বা অর্ধসেদ্ধ খাবার কলাপাতায় খেতে হচ্ছে তাদের: পিনাকী রায়
পিনাকী রায় বলেন, হামলার পর থেকে কোন খাবার কিনতে পারেননি তারা। এমনকি এলাকার বাইরেও যেতে পারেননি। তাই কোনভাবে একটি হাঁড়ি যোগাতে পারলে তাতে চাল বা অন্যকিছু ফুটিয়ে খাচ্ছেন। বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়ায় সব হারিয়েছেন তারা। থালাবাটির অভাবে সেদ্ধ বা অর্ধসেদ্ধ খাবার কলাপাতায় খেতে হচ্ছে তাদের।
চরম আতঙ্কের মধ্যে থাকা সাঁওতালরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন বলে জানান পিনাকী। আরো হামলার আশঙ্কা এবং নিজ ভিটায় ফিরতে পারবেন কিনা সেই দুঃশ্চিন্তায় চরম হতাশায় আছেন তারা। সাঁওতালরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতোটাই উদ্বিগ্ন যে সরকারের আশ্বাসেও তারা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। উচ্ছেদ করা জমিতে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ায় উদ্বেগ আরো বেড়েছে।
পিনাকী বলেন, সরকারের আশ্বাসে তারা আশ্বস্ত হতে পারেননি। আর সে কারণেই সরকারের দেয়া ত্রাণও তারা নেননি। জমি ফেরত, হয়রানি বন্ধ, হামলার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও হামলার ঘটনায় সাঁওতালদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি সাঁওতালদের।
তিনি বলেন: আমি মনে করি, যে জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করা হয়েছে সেটা যদি তাদের নাও হয় তবু বাংলাদেশের এ নাগরিকদেরকে যে প্রক্রিয়ায় উচ্ছেদ, হামলা ও নির্যাতন করা হয়েছে তা যথাযথ বিচারের দাবি রাখে।