আমাদের সবার প্রিয় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ (খালেদ স্যার) চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের অনিয়ম নৈরাজ্য নিয়ে তাঁর অতি সত্য কথন আর শোনা যাবে না। একইভাবে দুর্গম চরে বসবাসরত দরিদ্র মানুষের উন্নয়নে তিনি ‘চর ফাউন্ডেশন গঠন’, ‘চরের মানুষের জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে’র জন্য প্রতিনিয়ত যে দাবি তুলতেন সেটি আর দেখা যাবে না। ২৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর বেশ আগে তিনি অসুস্থ হন। প্রথমে তাঁকে শ্যামলিস্থ স্পেশালাউজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর তাঁকে আনা হয় বিএসএমএমইউ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংক খাতের অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, চরম অব্যবস্থাপনা নিয়ে যখন অনেকেই নিশ্চুপ থেকেছেন, সত্য কথা বলার ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন, তখন প্রকাশ্যে থেকেছেন একজন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। বরাবরই জনগণের মনের কথাটি তিনি বলেছেন সাহসের সাথে, নির্ভয়ে এবং দৃঢ়চিত্তে। কথা বলার সময় ডানে-বামে তাকাননি। রাষ্ট্রের প্রধান বা অন্যান্য শক্তিশালী ব্যক্তি খুশি না অখুশি হচ্ছেন তাও খেয়াল করেননি বা ধর্তব্যের মধ্যেও নেননি। নিজের বিচক্ষণতা আর পর্যবেক্ষণ দিয়ে একজন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-অস্বচ্ছতা নিয়ে কথা বলেছেন নির্বিবাদে। সমসাময়িক কালে তার মতো করে ব্যাংক খাতের অনিয়ম নিয়ে সুস্পষ্ট উচ্চারণে এত সত্য আর কেউ বলে যেতে পারেননি বলেই প্রতীয়মান। আর এ কারণেই ব্যাংক খাতের ‘বাতিঘর’ বলে জনসাধারণ্যে ব্যাপকভাবে পরিচিত হওয়া মানুষটির প্রয়াণে অনেকেই মন খারাপ করেছেন, কেঁদেছেন, ব্যথিত হয়েছেন। অনেকেই বলেছেন-সত্য বলার এখন আর কেউ থাকলো না। তাঁর মৃত্যুর খবর বের হওয়ার পর ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে যায় শোকবার্তায়। সাহসী মানুষটিকে হাজার লক্ষ জন স্যালুট জানান।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্যারের প্রয়াণ ব্যথিত হওয়ার মতোই বিষয়। কেননা এই শূন্যতা অচিরেই পূরণ হবে না। দেশের ব্যাংকিং খাতে যখন দৃশ্যত লুটপাটের খবর আসছিল, বড় বড় খেলাপীর খবরে যখন আর্থিক খাত নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল তখন তাঁর কন্ঠস্বর থেমে থাকেননি। বারবার বিশ্লেষণ আর সত্য উচ্চারণে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেছেন, এসবের জন্য সমাজের কারা দায়ী, আর কারা কী দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বহুবার দৃঢ়কন্ঠে বলেছেন দেশের ব্যাংক খাতের মূলে সমস্যা ও দুর্বলতা ‘খেলাপী ঋণ।’ খেলাপী ঋণ কমলে এমনিতেই সুদের হার কমে যাবে। খেলাপী ঋণ আর দেশের টাকা পাচারের কারণে ব্যাংকগুলো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ দীর্ঘদিন ব্যাংকিং পেশায় ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকিং জীবনের সমাপ্তি টানেন। ব্যাংকিং সেক্টরের তিনি ছিলেন এক কৃতিমান মানুষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। পুবালী ব্যাংক এবং কৃষি ব্যাংকেরও বড় পদে ছিলেন। ব্যাংক জীবন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করার পর তিনি সামাজিক বিভিন্ন কর্মকা-ের সাথে যুক্ত হন। সেগুনবাগিচাস্থ কচিকাঁচার মেলা ছিল তাঁর প্রিয় এক স্থান। একই সাথে তিনি চরের মানুষের উন্নয়নে কর্মরত ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্সে’এরর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। এই দুটি সংগঠনের সাথে তিনি নিবিড় ভাবে কাজ করতেন। যত কাজই থাক নিয়ম করে প্রাণের সংগঠন কচি-কাঁচার মেলাতে যেতেন। শিশু-কিশোরদের সাথে কথা বলতেন, ভাব বিনিময় করতেন। একইভাবে যত ব্যস্ততাই থাক ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্সের যত মিটিং, আলোচনা হতো সব খানেই তিনি দায়িত্ব নিয়ে যেতেন। নিজের গাড়ির তেল ফুরিয়ে অংশ নিতেন বিভিন্ন মিটিং, সভাতে। চর অ্যালায়েন্সের কাজে কোনোদিন একটাকা আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করেননি। চরের মানুষের জন্য তিনি মন থেকে কথা বলতেন। ২০১৫ সালে এক হাজারেরও বেশি মানুষের অংশগ্রহণে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম চর সম্মেলনে তিনি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এখানে করিয়ে দিতে চাই ২০০৮ সালে ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্সের হাল ধরেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্যার। অ্যালায়েন্সের সদস্য সচিব হিসেবে স্যারের সাথে ছিল আমার নিবিড় যোগাযোগ। কাজের প্রয়োজনে উনার বাসায়ও যেতে হয়েছে। ফলে উনার সাথে আন্তরিকভাবে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। অনেক অনেকবার উনার সাথে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীর দপ্তরে গিয়েছি। ২০১০ সালের কথা, চরের মানুষের জন্য জাতীয় বাজেটে যাতে আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হয় সেই অ্যাডভোকেসি করতে তৎকালীন পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তফা কামালের অফিসে যায়। অ্যালায়েন্সের সভাপতি হিসেবে কেন চরের মানুষের জন্য আলাদা বরাদ্দ প্রয়োজন সেই দাবিটি তিনি তুলে ধরেন। মন্ত্রী মহোদয় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্যারের সাথে সহমত পোষণ করে বলেন এবারের বাজেটে তিনি অবশ্যই চরের মানুষের জন্য থোক বরাদ্দ দেবেন। আলোচনার এক পর্যায়ে শেয়ারবাজারের প্রসঙ্গ তুলেন মন্ত্রী নিজেই। অনেক কথা বলতে থাকেন একা একা। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্যার নিশ্চুপ থাকেন তাঁর আপন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। বের হওয়ার পর স্যারের সাথে একসাথে গাড়িতে উঠতেই আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘কিছু বুঝলেন?’ আমি বললাম না স্যার। স্যার বললেন, আকারে ইঙ্গিতে আমার দেওয়া সেই শেয়ার বাজার রিপোর্টের কথা বলছিলেন। পরক্ষণেই বললেন, যেটা সত্য আমি সেটা লিখে দিয়েছি। এরপর আর সব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। উনি কী করবেন উনার ব্যাপার। আমার আর কিছু করার নেই।
খালেদ স্যার এমনিতে মৃদুভাষী ছিলেন। অনাবশ্যক কথা বলতে এবং আলোচনা করতে একদম পছন্দ করতেন না। কাজেন কথাটিই কেবল বলতে পছন্দ করতেন। এ কারণে স্যারের সাথে কথা একটু চিন্তাভাবনা করে বলতে হতো। স্যারের সাথে চলতে গিয়ে বুঝেছি এদেশে নির্লোভ মানুষ জন্মগ্রহণ তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। আরেকটি বিষয় দেখেছি উনি সাধারণ মানুষের কথা শুনতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও প্রতিটি মানুষের মাঝে ‘উইজডম’ আছে। এ বিষয়টিকে উনি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন।
একজন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মৃত্যুতে দেশ নিঃসন্দেহে একজন খাঁটি মানুষকে হারালো। কেননা উনার মতো করে সত্য বলার মানুষ এখন এমনিতেই সমাজে কম। খালেদ স্যার মৃদুভাষী হলেও সংক্ষেপে যা বলতেন তার ভার কাউকে বুঝতে কষ্ট হতো না। তাঁর বক্তব্যে কতো না ব্যাংক লুটেরা, মাফিয়া রুষ্ট হয়েছেন, অখুশি হয়েছেন। কেউ কেউ গোপনে তাঁর চরিত্র হনন করতে চেয়েছেন। কিন্তু ভীষণ নির্লোভ পরিচ্ছন্ন মানুষটি সত্য বলেছেন নির্ভয়ে নির্বিবাদে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)