ক্রমশই করোনাভাইরাসের ভয়ংকর থাবা খামচে ধরছে বাংলাদেশকে। যার হাত থেকে জাতিকে বাঁচাতে দিন দশেক আগে পুরো বাংলাদেশকেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সাধারণ মানুষের মধ্যে মেলামেশা বন্ধ ছাড়া এর সংক্রমণ ঠেকাতে সম্ভব নয় বলে, ২০১৮ সালের সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মল) আইনের প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। আর এর ১০ দিন পর রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬০টি জেলাতেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, শনিবার পর্যন্ত আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার। সরকারি হিসাবেই মৃত্যুর সংখ্যা ১৪০ জন।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছে। সেই শঙ্কার কথা সরকার বা অন্য কেউই উড়িয়ে দিচ্ছে না। আর সে কারণে ১ মাসের বেশি সময় ধরে পুরো দেশকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সব ধরণের প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগেই। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে নামানো হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরকেও, যারা পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করছে। নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে উপাসনালয়ে জমায়েত। কিন্তু এসব উদ্যোগের মধ্যেই আমরা দেখেছি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলছে।
এই যখন দেশের অবস্থা, তার মধ্যেই বন্ধ থাকা তৈরি পোশাক কারখানাগুলো সীমিত পরিসরে আজ রোববার থেকে পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ। মালিকদের দাবি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধু কারাখানার আশেপাশে থাকা শ্রমিকদের কাজ করানো হবে। গ্রাম থেকে কাউকে আনা হবে না। তাদের এই সিদ্ধান্তে সরকারও সম্মত। ওই সংগঠন দুটি বলছে, প্রথম ধাপে দুই দিনে (রোববার ও সোমবার) ঢাকা নারায়ণগঞ্জের বেশ কিছু কারখানা খোলা হবে। পরের তিন দিন (মঙ্গল-বৃহস্পতিবার) আশুলিয়া, সাভার, ধামরাইসহ বিভিন্ন এলাকার এবং ২-৩ মে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ এলাকার কারখানাগুলো চালু করা হবে।
কারখানা মালিকরা আরও বলছেন, আপাতত মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৩০ শতাংশ চালু করা হলেও পর্যায়ক্রমে তা বাড়ানো হবে। শ্রমিকদের সামাজিক দূরুত্ব নিশ্চিত করতে কারখানার ভেতরে মেশিনের লাইনও কমিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু তাদের এসব কথা যে শুধু ‘কথার কথা’ হবে না-সেই নিশ্চয়তা দেওয়ার কেউ নেই। এমন কি মালিকদের কথিত মনিটরিং টিম ছাড়া অন্য কোনো সংগঠন বা সংস্থার কথাও জানা যাচ্ছে না, যারা প্রকৃতই সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে, যাচাই করবে।
কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, তৈরি পোশাক মালিকরা অসংখ্যবার তাদের প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করেছেন। সর্বশেষ তার বড় উদাহরণ সরকারের কাছ থেকে কয়েকবার সময় নিয়েও শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন না দেওয়া। এমনকি প্রথম পর্যায়ে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিও কারাখানাগুলো মানেনি। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর গত ৬ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত দুই দফায় কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। যদিও এরই মধ্যে জরুরি ক্রয় আদেশের কথা বলে বহু কারখানা চালু রেখেছে।
তাই মালিকদের কথা যে ঠিক থাকবে না, তার প্রমাণ এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে। গত দুইদিন বহু শ্রমিককে চাকরিচ্যুতির হুমকি দিয়ে ফোন করে ঢাকা নিয়ে আসা হয়েছে। এমনকি রাতের আঁধারেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন পোশাক শ্রমিকরা।
আর এত বড় সংখ্যক শ্রমিকের স্বাস্থ্যবিধি কিভাবে তারা মানবেন? এ জন্য কোনো গাইডলাইনও প্রকাশ্যে আনেনি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। শ্রমিকরা কি পিপিই, মাস্ক ও হ্যান্ডগ্লভস পরে কাজ করবেন? সেই পরিমাণ সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়ার মতো সক্ষমতা এই মুহূর্তে কারখানা মালিকদের আছে? যদি তা থাকেও সে জন্য যে বিশাল খরচ; সেই ব্যয় বহনের ইচ্ছা বা প্রস্তুতি আছে? থাকলে কিভাবে তা করা হবে? কোন প্রক্রিয়া এসব বাস্তবায়ন করা হবে? তার পরিকল্পনা কি সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাব আসলে কারাখানা মালিকদের কাছে নেই। এমনকি তাদের সংগঠনের কাছেও নেই। থাকলে সবিস্তারে প্রকাশ করা হতো।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীই এখন করোনাভাইরাস মহামারী থেকে বাঁচতে একমাত্র উপায় হিসেবে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের চেষ্টা করছে। এ জন্যই মাসের পর মাস লকডাউন চলছে পৃথিবীর প্রায় দেশেই। অথচ শুরু থেকেই আমরা চলছি উল্টো পথে। বারবার ঘরে থাকতে বলা হলেও তা মানছি না অনেকেই। এ জন্যই হাট-বাজার-চায়ের দোকানে ভিড়। পাড়ায়-মহল্লায় উৎসবের আমেজ। আমরা করোনার ভয়াবহতা অনুভবই করতে পারছি না। গুরুত্বও দিচ্ছি না।
বিজিএমইএ দাবি করেছে, বিভিন্ন কারখানার অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্রয় আদেশ বাতিল করে দিয়েছে ক্রেতারা। এ কারণে অনেকেই ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু ক্ষতি তো শুধু পোশাক মালিকদেরই হচ্ছে না। দেশর প্রতিটি খাত ক্ষতিগ্রস্থ। তাই বলে কি অন্যরা তাদের মতো ‘সব গেল, সব গেল’ করে চিৎকার করে মরছে? আবার সবার আগে তো সরকার তাদেরকেই প্রণোদনা হিসেবে ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ দিয়েছে। বিজিএমইএ নিজেরাও স্বীকার করেছে এই অর্থ দিয়ে তাদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।
তারপরও কেন লাখ লাখ শ্রমিককে, পুরো দেশকে করোনাভাইরাসের আরও বড় ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়ার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? তারা কি কারখানা খুলে দেওয়ার আগে আইইডিসিআর-এর ছাড়পত্র নিয়েছেন? কোন কোন এলাকা ঝুঁকিমুক্ত, কোন কোন এলাকায় ঝুঁকি আছে- এসব নিশ্চিত করা হয়েছে? শুধু বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ক্রয় আদেশের কথা মাথায় না রেখে, মানুষের জীবনের কথাও ভাবতে হবে। মালিকদের কেউ কারখানায় যাবেন না। তাই তাদের কারোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কম। ক্ষতি যা হবে ওই গরীব শ্রমিকেরই। সাথে বাংলাদেশেরও। তাই আরেকবার ভাবুন। না হলে সামনের দিনগুলোতে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হবে দেশকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)