একের পর এক ব্লগার খুন হচ্ছেন, হচ্ছেন হামলার শিকারও। হামলায় চলতি বছর মারা গেছেন চারজন। সব মিলিয়ে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছে ৫ জন ব্লগারের নাম। এবার হামলার শিকার হলেন নিহত এক ব্লগারের বইয়ের প্রকাশকেরা।
শনিবারের হামলায় একজন প্রকাশক নিহত হয়েছে। শনিবার দুটি প্রকাশনা কার্যালয়ে পৃথক হামলা হয়। ব্লগারদের বই প্রকাশের জন্য হামলা হয়েছে প্রকাশকদের ওপর। উগ্রবাদীদের হামলায় নিহত ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের লেখা বই প্রকাশ করায় হামলা হয়েছে দুটি প্রকাশনা সংস্থার দুই স্বত্বাধিকারীর ওপর। এই হামলায় একজন নিহত ও তিনজন আহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। হামলায় আহত প্রকাশনা সংস্থা ‘শুদ্ধস্বর’ মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল ও অপর দুজন তারেক রহিম, রনদীপম বসু নিজেরাও ব্লগে লেখালেখি করেন। আর নিহত ফয়সাল আরেফিন দীপন প্রকাশনা সংস্থা ‘জাগৃতি’র মালিক। টুটুল ও দীপন তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করেছেন।
উগ্রবাদীরা একর পর এক ব্লগারকে হত্যা করেও ব্লগারদের দমাতে পারেনি। ব্লগারদের লেখা ছাপানো বন্ধ করতে এখন তাই হামলার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন প্রকাশকেরা। পর পর দুটি হামলার উদ্দেশ্য প্রকাশকদের মধ্যে ভয় টুকিয়ে ব্লগারদের লেখা না ছাপানোর বার্তা।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার রাজিব হায়দার মিরপুরে নিজ বাড়িতে খুন হন। কিন্তু সেই খুন নিয়ে নানা আলোচনা হলেও এ কোনো বিচার হয়নি। এই ঘটনার দুই বছর পর চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় খুন হন ব্লগার অভিজিৎ রায়। এর পরের মাসে খুন হন আরেকজন। ৩০ মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান, ১২ মে অনন্ত বিজয় দাস এবং ৭ আগস্ট নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় খুন হন। হামলার শিকার হন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর ও হামলার বিচার কবে পাওয়া যাবে তা কেউই বলতে পারছে না।
প্রতিটি মৃত্যুই কষ্টদায়ক। কাল-নির্ধারিত পরিপক্কতায় আবৃত যে মৃত্যু, ভীষণ বেদনা জড়িয়ে থাকে তাতেও। অকালমৃত্যু ব্যথাতুর করে আমাদের, মর্মাহত করে তীব্রভাবে। আর হত্যাকাণ্ড? বর্বর প্রাণনাশের ঘৃণ্য ঘটনা? আমাদের অনুভূতিকে অসাড় করে দেয়, স্তব্ধ করে দেয় মনোজাগতিক চেতনাকে! এ কেমন দেশ! এ কেমন বায়ু-মৃত্তিকা, যেখানে পরমায়ু এতো অনিশ্চিত, যেখানে মতপার্থক্যের কণ্ঠস্বর চিরতরে রুদ্ধ করে দেয় অস্ত্রসজ্জিত পেশীশক্তিতে বলীয়ান প্রেতের দল! কেন আমাদের সংবিধান, আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর নথিবদ্ধ বিন্যাস, আমাদের প্রশাসনিক প্রতিশ্রুতি, আমাদের বিচার ব্যবস্থার অঙ্গীকার অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে নিপতিত হয় বারবার! আমাদের পঠিত বিদ্যা, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, পুরুষানুক্রমিক শিক্ষা আমাদের শিখিয়েছে, অসির চেয়ে মসির শক্তি বেশি! অথচ এই মৃত্যু উপত্যকায় সদাসন্দেহ সংশয়ে আচ্ছন্ন আমরা! ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ড সজোরে আঘাত করে আমাদের চিন্তার ভিত্তিতে!
অসির পরাক্রমে নিস্তেজ নিষ্প্রাণ মসি বারবার প্রবল করে তোলে অচিন্তনীয় এক মাৎস্যন্যায়ের আশংকাকে! ভীষণ কষ্ট হয়! ভীষণ কষ্ট হয় আমাদের! মানুষের প্রতি এমন পাশবিকতা কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না কোন মানুষ, কোনদিন!ঘাতকরা নির্বিঘ্নে কেড়ে নিচ্ছে দেশের মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী মানুষদের। অথচ তারা অধরাই থেকে যাচ্ছে! আমরা কী এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?
মৌলবাদী-জঙ্গিদের তৎপরতা কিন্তু প্রকাশ্য। তারা বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে-ব্লগে-ফেসবুকে সমান সোচ্চার। এসব জায়গায় তারা তাদের বিকৃত ধর্মমত ফিরি করে। তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের লাইক দেয়। অপছন্দের ব্যক্তিদের মুরতাদ-নাস্তিক ঘোষণা করে। হত্যার পরোয়ানা পাঠায়। গালগাল করে। আমাদের দেশে এই ধর্মীয়-জঙ্গিরা এখন পর্যন্ত যাদের তালিকা প্রস্তুত করে হত্যার ঘোষণা দিয়েছে-তাদের অনেককেই তারা হত্যা করেছে। জঙ্গিদের হিটলিস্টে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন। ছিলেন রাজিব। ছিলেন অভিজিৎ। তাদের প্রত্যেককেই হত্যা করা হয়েছে। আরও অনেকেই তাদের হিটলিস্টে আছেন। তারা বাঁচবেন যদি ঘাতকরা দয়া করেন। এর বাইরে তাদেরকে বাঁচানোর বা তাদের বাঁচার সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না! ওরা তালিকা প্রকাশ করে, খুনের হুমকি দিয়ে একের পর এক প্রগতিশীল এবং দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করছে। অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না। রাষ্ট্র ব্যর্থ, সরকার ব্যর্থ, আইন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা-সবই ব্যর্থ! প্রশ্ন হলো যারা তালিকা প্রকাশ করে, প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে মানুষ খুন করছে, সরকার তাদের কেন ধরছে না? বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারছে না? যারা ব্লগে-ফেসবুকে তালিকা প্রকাশ করে হত্যার হুমকি দিচ্ছে-তাদের সনাক্ত করা কী অসম্ভব? আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে সরকার জনগণের ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এত এত গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী পুষছে কেন? কেন অপরাধীরা ধরা পড়ে না? ধরা পরলেও কেন বিচার কাজ এগোয় না? কেন অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করা যায় না? সমস্যা কোথায়? এটা কী তদন্তকর্মকর্তাদের গাফিলতি, দক্ষতার অভাব, না অন্য কিছু? কেন তদন্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না? বিচারকের সমস্যা? পিপির সমস্যা? সমস্যা দূর করার উদ্যোগ কোথায়? কমদিন ধরে তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই, তাহলে অপরাধীদের ধরা যায়, অপরাধ প্রমাণ করা যায়, তাদের বিচার কাজ যথাযথ ভাবে হয় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা যায়-সে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন?
বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ক্ষমতায় থাকে তখন জঙ্গিরা প্রকাশ্যে হামলা চালায়। গ্রেনেড-বোমা কেড়ে নেয় প্রগতিশীলদের প্রাণ। কিন্তু কোন হামলার বিচার হয় না। এমনকি মামলাও হয় না। আমরা সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করি: ওরা জঙ্গি-মৌলবাদী শক্তি, ওরা তো এমন করবেই। আমাদের দরকার একটি ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা দেশ পরিচালনা করবে। যারা ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদকে নির্মূল করবে।
এই বিবেচনা থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আমরা অনেকেই স্বস্তি পাই। ভাবি-এবার বুঝি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠীর অতীতের কর্মকাণ্ডের বিচার হবে। আমরা শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ পাব। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু ঘটে না। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখনও প্রগতিশীলদের প্রাণ যায়। ছুরি-চাপাতির আঘাতে। বোমায়। তখন মামলা হয়। কিন্তু মামলা এগোয় না। অপরাধীদের সনাক্ত করা যায় না। তাদের বিচার হয় না। এদিকে অপরাধীচক্র ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। তারা আবারও অস্ত্রে শান দেয়। আবারও তালিকা তৈরি করে। আবারও হত্যা করে। আমরা আবারও কঁকিয়ে উঠি। বিলাপ করি। চিৎকার করি। কিন্তু আমাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরানো বন্ধ হয় না। জঙ্গি ঘাতকদের হাতে আমাদের মৃত্যুর মিছিল তাতে বন্ধ হয় না।
ঘাতকেরা যাকে-তাকে মারছে না। বেছে বেছে জাতির শ্রেষ্ঠ-সন্তানদের মারছে। কেবল আক্রোশ নয়, এর পেছনে আছে গভীর পরিকল্পনা। বাঙালি জাতিকে ন্যাড়া বানানো, স্তাবক-মেরুদণ্ডহীন বানানো। যুক্তি-বুদ্ধি-বিজ্ঞান যারা চর্চা করে তাদের সরিয়ে একদল বিশ্বাসী লেজনাড়া বুদ্ধুর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। ধর্মের আলখেল্লায় যেখানে ঢাকা থাকবে মুক্তবুদ্ধির উদার জমিন। তারা আমাদের সমাজটাকে টেনেহিঁচড়ে মধ্য যুগে নিয়ে যেতে চায়। অথচ এর কোন প্রতিকার হচ্ছে না। ঘাতকদের নির্মূলকরণের নেই কোন কার্যকর পরিকল্পনা। মুখে মুখে আমরা চেতনার রোশনাই উড়াচ্ছি। চেতনার স্থপতিদের মরতে দিয়ে চেতনা ফেরি করে বেড়াচ্ছি শুধু বুলি আর বক্তৃতায়! সররকার কী করছে? সরকারের কর্তা ব্যক্তিরাও বুলি আউড়ে সমস্যার সমাধান দিচ্ছে। কিন্তু বাণী-বাক্য-সান্ত্বনাই কী এই সময়ে জরুরি দাওয়াই? দরকার যথাযথ ঘাতক-বিনাশী উদ্যোগ। মনে রাখা দরকার যে সবসময় ন্যায়ের পক্ষই জেতে না । অসভ্যদের হাতে অনেক সভ্যতা-ই ধ্বংস হয়ে গেছে ।সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন তৎপর হচ্ছে না? কেন তারা শত্রু এবং ঘাতক চিহ্নিত করে প্রতিকারের পথে হাঁটছে না? বাংলাদেশের মেধাবী মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছে কিছু জংলি অসভ্য। এভাবেই কি তাহলে সব কিছু চলতে থাকবে? বাংলাদেশের পুরোটাই ধীরে ধীরে গিলে খাবে ওরা? আমরা মানবববন্ধন করব, কালো ব্যাজ পড়ব, ফেসবুক-টুইটারে আবেগঘন স্ট্যাটাস লিখব, কালো প্রোফাইল পিকচার দেব। কিন্তু ওদের কিছুই হবে না। ওরা চাপাতিতে ধার দেবে। প্রতিদিন ধার দিয়ে শানিয়ে রাখবে অস্ত্র। একবেলার কর্মসূচি শেষে আমরা যে যার মত ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু ওরা ঘুমাবে না। ওরা আবার নতুন কাউকে হত্যার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করবে!
আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতায়, অবিমৃষ্যকারী ভূমিকার কারণে এই দেশ ক্রমেই ধর্মান্ধ বর্বরদের দখলে চলে যাচ্ছে। হিংস্র খুনীদের তালুকে পরিণত হচ্ছে। এই ধারা চলতে পারে না। এখন সময় এসেছে নতুন করে হিসেব মেলানোর, নতুন হিসেব করার। এই হত্যাকাণ্ড প্রতিকারের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। জননিরাপত্তা বিধান করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সরকার যদি একক শক্তিতে না পারে তবে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সহায়তার জন্য ডাক দিক। সবাই মিলে বসে ঘাতক-দানববিনাশী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক। কিন্তু এভাবে আর চলতে পারে না। দেশে একটি সরকার আছে, সরকার পারে, মৌলবাদী ঘাতকদের পক্ষে নয়, সরকার মুক্তবুদ্ধির পক্ষে-এটা সরকারকেই প্রমাণ দিতে হবে। সরকার যদি চালাকির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায়, তাহলে আগামীতে ঘাতকের চাপাতির কোপের জন্য তাদেরও প্রস্তুত হতে হবে। কারণ যারা চাপাতি নিয়ে এগোচ্ছে, তারা সরকারকে ছেড়ে কথা বলবে না। ২১ আগস্ট কিন্তু সেই সাক্ষ্যই দেয়। আর নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে সরকার আরও অপাক্তেয় হয়ে পরবে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের এসব বিষয় গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখা উচিত।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)