কণ্ঠটা শুনলে যে কেউ তার দিকে একনজর তাকাবেন। কারণ, কণ্ঠটা যে এ দেশের মানুষের খুব চেনা, খুব প্রিয়! তিনি কয়েক হাজার সিনেমার প্রচারক মাজহারুল ইসলাম। ১৯৭১ সালের দেশ স্বাধীনের পর আজ পর্যন্ত প্রায় সব ছবির প্রচারে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। জানালেন, কতগুলো ছবির প্রচারক হিসেবে সেটা সংখ্যায় বলতে পারবো না। তবে, চার থেকে পাঁচ হাজার তো হবেই! এর বেশিও হতে পারে।
চ্যানেল আই অনলাইনকে মাজহারুল ইসলাম বলেন: আমি এবং নাজমূল হোসেন ছাড়া কেউ ছিল না। আমরা দু’জনেই সব ছবির প্রচারে কণ্ঠ দিয়েছি। ছোট ছোট বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ দেয়ার মাধ্যমে এই কাজ শুরু করি। এরপর নায়ক রাজ রাজ্জাকের ‘রংবাজ’ ছবির প্রচারে কণ্ঠ দেই। এরপর ১৫ মিনিটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কণ্ঠ দেই।
‘‘১৯৭৮ সালে মধুমিতা মুভিজের ‘আগুন’ ছবির প্রচারে কণ্ঠ দেয়ার মাধ্যেম নিয়মিত সিনেমার প্রচারে কাজ করতে থাকি। তখন সিনেমাহল ছিল হাজারের বেশি। সিনেমার ব্যবসা ছিল রমরমা। এখন হল এসেছে ২৫০ এর কাছে। এখন আর পরিচালকরা আগের মতো আমাকে দিয়ে সিনেমার প্রচারে কাজে লাগায় না। এখন নাকি এ ধরনের প্রচার দর্শকদের টানতে পারে না। এখন সবাই ফেসবুক, ইউটিউবকে গুরুত্ব দিচ্ছে। একেবারে যে ভয়েজ দিচ্ছি না তা নয়, মাঝেমধ্যে দিচ্ছি। আমি এখনও আমার যুবকের মতো কণ্ঠটা ধরে রেখেছি বলেই এখনও হয়তো আমাকে ডাকছে অনেকেই। এটা সম্ভব হয়েছে আল্লাহর রহমত এবং আমার চর্চার কারণে। সেই সাথে নিজেকে নিকোটিন ও অ্যালকোহল মুক্ত রেখেছি বলে’’, বলেন মাজহারুল ইসলাম।
শুধু তাই নয়, মাজহারুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দযোদ্ধা, বেতার ব্যক্তিত্ব, সর্বাধিক চলচ্চিত্র বিজ্ঞাপনের উপস্থাপক, বেতার নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা। মঞ্চ ও চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন বহুবার। মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমি রেডিওতে প্রচার হওয়া ৩০০ নাটকে নাটক। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে নায়ক হিসেবে শুরু। এরপর আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় জল্লাদের ফাঁসি, ঢাকা রেডিওর ‘দেবদাস’ সবদিক দিয়ে পরিচিতি পেয়েছি। পথ চলতে হোঁচট খেয়েছি, কিন্তু দমে যায়নি। রাজ্জাক, শাবানা, কবরী, ফারুক, সোহেল রানা, আলমগির, শাকিব, মিশাসহ সব তারকার নাম সিনেমায় প্রচার করেছি। অনেকে আমাকে শব্দ যোদ্ধা বলে থাকে। কিন্তু আমি নিজেকে ‘বিনোদন বন্ধু’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করি। আরো বলেন, আমার কাজের সন্তুষ্টির স্থান হলো ১৯৭৫ সালে ১৪ আগস্ট রাত পর্যন্ত বেতারে আমার কণ্ঠ প্রচার হয়েছে। তাছাড়া এই চলচ্চিত্র থেকে আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমি পাঁচকোটি টাকার বাড়িতে থাকি। লাখ টাকার গাড়িতে চড়ি। সবকিছু নিয়েই আমি খুব সন্তুষ্ট।
বিচার, স্লোগান ছাড়াও প্রায় ৬০টি সিনেমায় ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাজহারুল ইসলাম। বর্তমানে চ্যানেল আই এর মেগা সিরিজ ‘সাত ভাই চম্পা’তে অভিনয় করছেন তিনি। মাজহারুল ইসলাম বলেন, এই সিরিয়ালে কাজ করছি, যে ভালোবাসা পেয়েছি পুরো টিমের কাজ থেকে সেটা বলে বোঝাতে পারব না। কারণ এখন মানুষ সেভাবে গুরুজনদের সম্মান দেয় না। কিন্তু ‘সাত ভাই চম্পা টিম’ আমাকে যে সম্মান দিয়েছে যেটার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি জানি, ‘সাত ভাই চম্পা’ টিম যে পরিশ্রম করেছে সেটা সফলতা পাবে।’
প্রায় অর্ধশতাব্দী সময় ধরে বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করে আসছেন মাজহারুল ইসলাম। ফরিদা পারভিন, সুবীর নন্দী, শাম্মী আখতার, এন্ড্রু কিশোরসহ অনেক কণ্ঠশিল্পীর নাম ঢাকা বেতার থেকে প্রথম প্রচারিত হয়েছে মাজহারুল ইসলামের কণ্ঠে। এমনকি নায়ক মান্না মারা যাওয়ার আগে তার শেষ ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন তিনি। দেশের চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বহু সোনালি মুহূর্তকে দেখেছেন খুব কাছে থেকে। সেসব মুহূর্তকে সংরক্ষণ করতেই গড়ে তুলেছেন ‘সেতু রেকর্ডিং স্টুডিও’। এটি কেবল রেকর্ডিং স্টুডিও নয়। একটি অডিও-ভিডিও আর্কাইভ। পাওয়া যাবে ইতিহাসের স্বর্ণালি সব মুহূর্ত। মাজহারুল ইসলামের ভাষায়, ওখানে গেলে স্মৃতিকাতর হবেন যে কেউ! যেটার রাজধানীর বাংলামোটরে অবস্থিত।