হঠাৎ এমন কোপাকুপি বেড়ে গেল কেন? রিফাত হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানার ধানদিয়ায় এক ভ্যানচালককে কুপিয়ে আহত করেছে দুর্বৃত্তরা। আহত ভ্যান চালকের নাম মো. শাহিন হোসেন (১৪)। ছেলেটির কাছে থাকা ব্যাটারিচালিত নতুন ভ্যান ছিনিয়ে নিতে দুর্বৃত্তরা এই হামলা চালায়। এদিকে রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তার নাম ইয়াসিন (১৬)।
৩০ জুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে রায়েরবাজারের নিমতলী এলাকার টালি অফিসের জরিনা স্কুলের পাশে বাংলা সড়কের গলিতে এ ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরেই কি কোপবাজরা এমন সর্বত্র বেপরোয়া হয়ে উঠছে? রিফাত শরীফের খুনি সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফারাজী দুজনই ক্ষমতাধরদের ঘনিষ্ঠজন৷ রিফাত ফারাজীর আপন খালু বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। এছাড়া রিফাতের চাচাতো দাদা মরহুম লতিফ ফারাজী ২০ বছর আগে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের ঘনিষ্ঠজন নয়ন। এছাড়া বরগুনা পৌরসভার কাউন্সিলর রইসুল ইসলাম রিপনের ছেলে জনিরও ঘনিষ্টজন সে। এসব ঘনিষ্ঠজন শক্তিতেই কি তারা বেপরোয়া?
২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাতে নয়নের বাসায় অভিযান চালায় বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ । এ সময় বিপুল পরিমাণ মাদক, দেশীয় অস্ত্র ও এক সহযোগীসহ নয়নকে গ্রেফতার করে তারা৷ তার বাসা থেকে উদ্ধার করা মাদকের মধ্যে ছিল ৩০০ পিস ইয়াবা, ১২ বোতল ফেন্সিডিল ও ১০০ গ্রাম হেরোইন। এসব করেও সে কিভাবে বহাল তবিয়তে থাকলো? আরেক খুনি রিফাত ফারাজী বরগুনা সদর উপজেলার রায়েরতবক গ্রামের দুলাল ফারাজীর ছেলে। দুলাল ফারাজী সাবেক জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মরহুম লতিফ ফারাজীর ভাতিজা ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দুলাল ফারাজীর ভায়রা। এই রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই কি স্থানীয়দের কাছে একটি মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেনি রিফাত ফরাজী? রিফাতের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের ওপর হামলা, মারধর এগুলো ছিল তার দৈনন্দিন ব্যাপার৷ এই রিফাত ফারাজীকে বাঁচাতেই নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকী মিন্নি এবং তার পরিবারের লোকজনকে মুখ না খুলতে হুমকি দিলেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন৷ ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়াই কি এইসব সামাজিক দুর্বৃত্তদের এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠার মূল উৎস নয়?
পুলিশ নিজেই বলছে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে তাদের সিসি ক্যামেরার আওতায়৷ নিয়মানুযায়ী সিসি টিভির মাধ্যমে নজরদারির জন্য একটি কন্ট্রোল রুম থাকে।
যতদূর জানা গেছে সেই কন্ট্রোল রুমটি বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অবস্থিত। যেখানে কন্ট্রোল রুম এবং সার্বক্ষণিক নজরদারি ছিল সেখানে ঘটনার পরপরই কেন তড়িৎ গতিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ? এদিকে দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও তাদের বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এতে কি এটা পরিস্কার নয় যে নিহতের পরিবারও আক্রান্ত হতে পারে? এ কোন মগের মুল্লুকে বসবাস করছি আমরা? পুলিশ নিরাপত্তা দেবে৷ কিন্তু পুলিশের নিরাপত্তা কি আছে?
পুলিশের (এএসআই) মোঃ রফিকুল ইসলাম পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার জয়কুল গ্রামে অভিযোগের তদন্তে গেলে হামলার শিকার হয়েছেন। গুরুতর জখম রফিকুল ইসলামকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে প্রথমে কাউখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে। এসব কিসের আলামত?
বরগুনা সদরে প্রকাশ্য দিবালোকে শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা মামলার মূল আসামিরা জেলা আওয়ামী লীগের চিরচেনা দুই প্রতিপক্ষের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এমনটাই একে অপরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে পাওয়া গেছে। বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর পক্ষের লোকজনের অভিযোগ, রিফাতের হত্যাকারী রিফাত ফারাজী ও রিশান ফারাজী বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সাবেক সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। দেলোয়ার হোসেনের প্রশ্রয়েই এ দুই ভাই রিফাত হত্যার মতো অপরাধে দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে দেলোয়ার হোসেন দাবি করেছেন, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে এবং জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুনাম দেবনাথের ছত্রছায়ায় রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ডসহ অন্যরা বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছে বলে তিনি শুনেছেন। এখানে কার কথা সত্য এমপির না জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের?
রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের মদদেই যে কোপাবাজরা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এতে আর সন্দেহ কার? অপরাধ করেও তারা ধরাছোঁয়ার উর্ধ্বে থেকে আরও বড় অপরাধ সংগঠিত করে চলে তারা৷ সেজন্য মানুষও হারিয়ে ফেলছে আইনের প্রতি নির্ভরতা৷ টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে স্কুলছাত্র হৃদয়ের উপর হামলাকারী আসামিদের গ্রেপ্তার না করায় মহাসড়ক অবরোধ করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা৷ ২৪ ঘ্ন্টার মধ্যে অপরাধী গ্রেপ্তার না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেন তারা৷ সিলেটে দুদু খান নামের এক ধর্ষককে পিটিয়ে হত্যা করলো জনতা৷ সিলেটের বন কলাপাড়া পয়েন্টে এ ঘটনা ঘটে৷ নিহত দুদু খান স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মী ছিলেন। তিনি এক সময় মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ছিলেন৷ আরও ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খানের ঘনিষ্টজন৷ তবে কি রাজনৈতিক ক্ষমতার বলেই সে এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল? আর সেজন্যই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল জনতা? এই ক্ষুব্ধতার কী মূল্যায়ন আছে ক্ষমতাবাজদের কাছে? কোন পথে ছুটছে দেশ ও দেশের মানুষ? তারা কোন পথে ঠেলে দিচ্ছে এই দেশটাকে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)