বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা একটা সুখের সময় পার করলো। বিশ্বকাপে দুরন্ত পারফর্ম করার পর ঘরের মাঠে টাইগাররা যা করলো সেটা রীতিমতো বিস্ময় জাগানিয়া। পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ শুধু ওয়ানডে সিরিজ জেতেনি, যে স্টাইলিশ জেতা তারা জিতেছে; তাতে ক্রিকেট দুনিয়ার বাকি সদস্যদের ভাবনার একটা বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ।
তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে টিম টাইগার্স। প্রত্যকটা জয়ই দু’দলের ফারাকটা স্পষ্ট করে দিয়েছে। প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশ জেতে ৭৯ রানে, যেখানে প্রায় পাঁচ ওভার (২৮ বল) বাকি থাকতে অলআউট হয় পাকিস্তান। দ্বিতীয় ম্যাচে ব্যবধানটা আরও বড়। প্রায় ১২ ওভার (৭১ বল) বাকি থাকতে বাংলাদেশ জেতে ৭ উইকেটে। তৃতীয় ম্যাচে ৬৩ বল হাতে রেখে টাইগারদের জয় ৮ উইকেটের।
আপাত: দৃষ্টিতে পাকিস্তান সেরা দল ছিলো কিনা সেটা নিয়ে কেউ কেউ সামন্য প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছেন। প্রায় দু’বছর পর ওয়ানডে ফরম্যাটে ফিরে অধিনায়ক হয়েছেন আজহার আলী। বিশ্বকাপের পর মিজবাহ-উল হক ও শহিদ আফ্রিদি ওয়ানডে থেকে অবসর নিয়েছেন। ইউনিস খান ছিলেন বিশ্রামে। পেসার মোহাম্মদ ইরফানের ইনজুরি এবং আহমেদ শেহজাদ ও উমর আকমল আচরণগত কারণে দল থেকে বাদ পড়েন।
এতেগুলো বিষয়ের পরও পণ্ডিতরা পাকিস্তানকেই ফেভারিট বলছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ প্রত্যেকটি ম্যাচেই তাদের পর্যূদস্ত করেছে। সেটা আগে ব্যাট করে হোক বা টার্গেটে খেলে হোক। টি২০ ম্যাচে আফ্রিদি-শেহজাদ-গুলরা ফিরলেও বাঘের হুংকারের সামনে টিকতে পারেননি কেউই।
বাংলাদেশ প্রত্যেকটা ম্যাচ কতোটা আরামে জিতেছে এবং দু’দলের পার্থক্য কতোটা পরিসংখ্যানেই সেটা স্পষ্ট। তিন ওয়ানডে ম্যাচে বাংলাদেশ উইকেট হারিয়েছে মোট ১১টি। গড়ে প্রতি ৭৪ রানে একটি উইকেট হারিয়েছে তারা এবং ওভার প্রতি রান তোলার গড় প্রায় সাড়ে ছয়। বিপরীতে গড়ে ২৯ রান পর পর উইকেট হারায় পাকিস্তান। মোট উইকেট হারায় ২৬টি। গড়ে প্রতি ৩৩ বল পরপর উইকেট হারায় তারা যেখানে বাংলাদেশ হারায় ৭০ বলের ব্যবধানে।
আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ের টপ আট দলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এবারই প্রথম ৩-০ বা তার চেয়ে বেশি ব্যবধানে সিরিজ জেতেনি। এর আগে নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও একইভাবে জিতেছে টাইগাররা। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে প্রথমে ৪-০ ব্যবধানে এবং ২০১৩ সালে ৩-০তে হারায় বাংলাদেশ। আর ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের ঘরের মাঠে হারিয়েছিল ৩-০ ব্যবধানে, যদিও বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলার কারণে পূর্ণ শক্তির দল মাঠে নামাতে পারেনি ক্যারিবীয়রা।
আগের সিরিজগুলোর ম্যাচে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খুবই কাছাকাছি ব্যবধানে জিতেছে বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডকে ৪-০তে হারানো সিরিজের দুই ম্যাচ জিতেছিলো ৯ রানে। একটি ম্যাচ ৩ রানের জয়। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ জিতেছিলো তিন উইকেটে এবং ছয় ও সাত বল হাতে রেখে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৩ সালের সিরিজের শেষ ম্যাচে মাত্র চার বল বাকি থাকতে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। সিরিজে কিউইদের ২৫ উইকেটের বিপরীতে ২৬ উইকেট হারিয়েছিলো টাইগাররা।
নিউজিল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিনটি সিরিজেই বাংলাদেশর ব্যাটিং গড় ছিল ৩৫-এর নিচে। এ থেকেই বোঝা যায়, প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো করলেও ব্যাটসম্যানরা পুরোপুরি কক্ষপথে ছিলেন না। দুটি সিরিজেই রান তোলার গড় ছিল ছয়ের নিচে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাটিং গড় আগে জেতা সিরিজগুলোর চেয়ে ৪৬ বেশি।
এবার বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি উইকেট হারিয়েছে পাকিস্তান। এই সিরিজে উইকেট প্রতি বাংলাদেশের ব্যাটিং গড় ৭৪ দশমিক ৫৪। যেকোনো সিরিজেইে এটি বাংলাদেশের সেরা। এর আগে ২০০৬ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে সিরিজে এই গড় ছিল সর্বোচ্চ ৪৪ দশমিক ৩৩। আগে শীর্ষ আটের দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় ছিলো ৪৩-এর নিচে। সেটা গত এশিয়া কাপে।(যদিও আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২২২ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। তবে ভারতের বিপক্ষে ২৭৯ ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩২৬ রান করেছিলো।) এছাড়া ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে হারা সিরিজে ব্যাটিং গড় ছিল ৪০এর উপরে।
আগে বা পরে যাই হোক, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ তাদের সেরা জায়গায় পৌঁছেছে। এসময় বাংলাদেশের বোলিং গড় ২৮ দশমিক ৪২। যা শীর্ষ আট দলের বিপক্ষে খেলা যে কোনো সিরিজের চেয়ে ভালো। সেঞ্চুরির দিক দিয়েও পাকিস্তান সিরিজ স্মরণীয়। সিরিজে চারটি সেঞ্চুরি করেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা (তামিম ইকবাল দুটি, মুশফিকুর রহিম ও সৌম্য সরকার একটি করে সেঞ্চুরি)। এরআগে সর্বোচ্চ ছিল তিনটি। ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের তিনটি সেঞ্চুরি করেছিলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।
বিপরীতে পাকিস্তানের পক্ষে একমাত্র সেঞ্চুরি করেন অধিনায়ক আজহার আলী। সিরিজে বাংলাদেশের ছয়টি হাফসেঞ্চুরির বিপরীতে পাকিস্তান সাতটি হাফসেঞ্চুরি পেলেও গড় ছিলো অনেক কম।
বিশ্বকাপ শুরু পর থেকে নয় ইনিংসে বাংলাদেশের পাঁচজন ব্যাটসম্যান ওয়ানডেতে ৩শ’র বেশি রান করেছেন। তাদের প্রত্যেকের গড়ই ৪০-এর উপরে। এর মধ্যে শুধু মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের স্টাইক রেটই ৮৫’র কম। এক সেঞ্চুরি ও চারটি হাফসেঞ্চুরি নিয়ে এগিয়ে আছেন মুশফিক। তার স্টাইক রেটও ১১০-এর কাছাকাছি। দুটি করে সেঞ্চুরি ও হাফসেঞ্চুরি আছে তামিম ইকবালের। যার মধ্যে পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা দুটি সেঞ্চুরি তার। সিরিজে ৩১২ রান করেছেন তামিম। যে কোনো সিরিজে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বিশ্বকাপে ছয় ইনিংসে ৩৬৫ রান করেছিলেন মাহমুদুল্লাহ।
বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। তারা এখন ছোট-মাঝারি ইনিংসকে সেঞ্চুরিতে রূপান্তর করছেন। সর্বশেষ ছয়টি ওয়ানেডে ম্যাচে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে ছয়টি সেঞ্চুরি পেয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে সর্বনিম্ন ২৭ ওয়ানডেতে ছয় সেঞ্চুরি দেখেছিলো তারা। সেটাও ২০১২ সালে। আর এক পঞ্জিকাবর্ষে এই প্রথম ছয় সেঞ্চুরি পেলো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। সর্বোচ্চ চারটি সেঞ্চুরি ছিলো এর আগে।
পাকিস্তানের পর বাংলাদেশের টার্গেট এখন ভারত। জুনেই পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে আসছে তারা। এক পঞ্জিকাবর্ষে টপ আট দলের বিপক্ষে মোট পাঁচটির বেশি ম্যাচ জেতেনি বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতকে যদি তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করতে পারে; তাহলে আরো একটি রেকর্ডের মালিক হবে টাইগাররা।
ফেভারিট হিসেবেই সিরিজে মাঠে নামবে ভারত। তবে পাকিস্তান সিরিজ থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাংলাদেশও প্রমাণ করবে ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ যুগ আসছে। তথ্যসূত্র: ক্রিকইনফো