কোনো খেলাই, বিশেষ করে ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, রাগবি, ব্যাডমিন্টন এমনকি সাজানো মারামারির খেলা রেসলিংও শুধু খেলা নয়; যেরকম বৌচি বা ছিবুড়ি কিংবা কানামাছি নিতান্তই খেলা। বরং এসব খেলা মানেই এখন বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, বিলিয়ন ডলার-রুপি আর টাকার জুয়া। সেইসাথে এই উপমহাদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান প্রশ্নে ক্রিকেট অনেক বেশি রাজনীতি এবং সাধারণ মানুষের কাছে এখন দেশপ্রেম আর বিদ্বেষেরও বড় অনুসঙ্গ।
একটা সময় পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তানের খেলা হলে পুরো বাংলাদেশ যেন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেতো। বহু মানুষের বাসায় এ দুই দেশের পতাকা ওড়ানো হতো। কিন্তু যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছি, সেই দেশের পতাকা ওড়ানোর কড়া সমালোচনা শুরু হলে, পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো বন্ধ হয়। যদিও এখনও দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব বিহারি ক্যাম্প রয়েছে, সেখানে নাকি এখনও ভারত-পাকিস্তান বা বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলা হলে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো হয়।
তবে ভারত-পাকিস্তান মহারণ ঘিরে বাংলাদেশে একসময় যে উন্মাদনা ছিল, সেখানে ভারতপ্রেম, পাকিস্তানবিদ্বেষ, হিন্দু-মুসলমান এমনকি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো বিষয়ও যুক্ত হয়ে যেতো। ভারতের সমর্থন করা মানেই তিনি আওয়ামী লীগ আর পাকিস্তানের সমর্থন করা মানেই তিনি বিএনপি-জামায়াত; মুসলমান বলেই পাকিস্তানের সমর্থন এরকম সরল সমীকরণ আর স্বীকারোক্তিও বহু বছর এই দেশে চলেছে। কিন্তু সেই জায়গাটি এখন বদলে গেছে। এখন ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে সেই উন্মাদনা চোখে পড়ে না। এর একটি বড় কারণ, একটা লম্বা সময় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির ক্ষমতায় থাকা, যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ নানা কারণেই দেশে পাকিস্তান মানসিকতার লোক কমেছে বা না কমলেও তারা প্রকাশ্যে পাকিস্তানের সমর্থন করে না বা করলেও সে বিষয়ে আওয়াজ দেয় না। বরং ভারত-পাকিস্তানের সেই উন্মাদনাটা এখন বাংলাদেশ-ভারত অথবা বাংলাদেশ-পাকিস্তানে নিবদ্ধ হয়েছে।
বাস্তবতা হলো, ক্রিকেট খেলা হয় এশিয়া (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, আরব আমিরাত), ইউরোপ (ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড), ওশেনিয়া (অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড), আফ্রিকা (দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে) এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)। পুরো উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় ক্রিকেট নিয়ে কোনো উন্মাদনা নেই। ওই দুই বৃহৎ অঞ্চলের মানুষ আদৌ ক্রিকেট খেলে কি না বা খেললেও যে সেটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো ব্যাপার কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। আবার ইউরোপের শক্তিশালী দেশ যেমন ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি বা পর্তুগালের মতো দেশে ফুটবল নিয়ে যে উন্মাদনা, যে বাণিজ্য তার সিকি ভাগও নেই ক্রিকেট নিয়ে। এশিয়ার উল্লিখিত দেশগুলোর বাইরেও ক্রিকেট নিয়ে ওই অর্থে কোনো মাতামাতি নেই। কিন্তু সেই তুলনায় ফুটবলের উন্মাদনা, ফুটবলের অর্থনীতি, ফুটবলের জনপ্রিয়তা অনেক অনেক বেশি।
যদিও আমাদের দেশে ফুটবল ভুলতে বসা একটি ক্রীড়ার নাম। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফুটবলের গতি ফেরানোয় বাফুফে (বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন) কিছু উদ্যোগ নিলেও সেগুলো আখেরে কোনো ফল তো দেয়ইনি, বরং উঠেছে নানাবিধ দুর্নীতি আর অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ। ফলে দেশে সার্বিকভাবেই ফুটবলের সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যে কোনো আলো নেই, তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া সম্ভব। বরং তার বিপরীতে ক্রিকেট এখন অনেক বেশি মাত্রায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। ক্রিকেটাররা কিছু একটা ভালো করলেই সরকারি প্রণোদনার অংশ হিসেবে ফ্ল্যাট, নগদ অর্থ এবং সেই সাথে বাড়তি পাওনা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনে শুভেচ্ছা।
কাবাডি বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হলেও বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশই এই খেলা কখনো সচক্ষে দেখেছে বলে মনে হয় না। গ্রামগঞ্জে ঈদ বা পয়লা বৈশাখের মতো উৎসবকে কেন্দ্র করে কালেভদ্রে এই খেলার হয়তো আয়োজন হয়, কিন্তু এই খেলার নিয়ম-কানুন সত্যি বলতে কি আমিও জানি না। কারণ এই খেলাটি আমাকে কখনো টানেনি। বরং আমরা যখন খেলা বুঝতে শুরু করি, তখন কোর্টনি ওয়ালশ-অ্যামব্রোস, ব্রায়ান লারা, ওয়াসিম আকরামদের দাপট। ফলে খেলা বলতে মাঠে গিয়ে ওই ক্রিকেটই। কাবাডি আমাদের কাছে নিতান্তই একটি গেঁয়ো এবং শ্রমিকশ্রেণির মানুষের খেলা বলে মনে হতো। বস্তুত এরকম ধারণাই আমাদের দেয়া হতো। আর ফুটবল খেলা মানেই আমরা দেখেছি অমুক স্কুল তমুক স্কুলের মারামারি, মাঠের ভেতরে খেলোয়াড়দের উশৃঙ্খলতা ইত্যাদি। ফলে এই খেলাটি সুদূর মফস্বলে বসেও আমরা ঠিক এনজয় করতে পারিনি। বরং আমাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে তুলনামূলক মার্জিত এবং কেতাদুরস্ত খেলা বলে পরিচিত ক্রিকেট।
বছর কয়েক আগ পর্যন্ত আমাদের কাছে এটি স্রেফ একটি খেলাই ছিল। কিন্তু সেই জায়গাটি বদলে গেছে ক্রিকেটে বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নতির ফলে। কারণ একটা সময় আমরা বাংলাদেশ মোটামুটি ভালো খেললেই বা বাজেভাবে না হারলেই খুশি হতাম। সেই জায়গায় আমরা এখন ধরেই নিই যে, বাংলাদেশ যেকোনো দেশকে হারানোর ক্ষমতা রাখে, যেকোনো আন্তর্জাতিক আসরে চ্যাম্পিয়ন বা রানার্সআপ না হলেও অন্তত সেমিফাইনাল খেলতে পারে। এটি অনেক বড় অর্জন। ভারত-পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের সব পরাক্রমশালী ক্রিকেট দলকেই বাংলাদেশ হারিয়েছে।ফলে ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশে মানুষের আবেগ-অনুভূতি আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রখর।
বড় আসরে বাংলাদেশ খেলতে গেলেই রাজধানীতে তো বটেই, অন্যান্য বড় শহরের রাস্তার মোড়ে, পাড়ায় মহল্লায় বড় পর্দায় খেলা দেখার আয়োজন চলে। বিশেষ করে ভারতের বিরুদ্ধে যখন সাকিব-তামিমরা ছয় হাঁকায় তখন সমস্বরে যেন চিৎকার করে ওঠে পুরো দেশ। আবার যখন হেরে যায়, তখন একসাথে যেন মুহ্যমান হয়ে পড়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। এখানে ক্রিকেট আর স্রেফ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এখানে ক্রিকেট পুরো দেশের মানুষকে নিয়ে আসে অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। দল-মত নির্বিশেষে সবাই একাট্টা বাংলাদেশ প্রশ্নে। এখানে কোনো রাজনৈতিক বিভাজন বা বিশ্বাস কিংবা আদর্শ কোনো পাত্তা পায় না।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবিসংবাদিত সহায়তার পরও ক্রিকেট প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষের যে আবেগ অনুভূতির জোয়ার তৈরি হয়, যেরকম ভারতবিরোধিতায় কেঁপে ওঠে পুরো দেশ, তার পেছনে ক্রিকেটবিশ্বে ভারতের আধিপত্য, বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের প্রশ্নবিদ্ধ পরাজয়- ইত্যাদিরও ভূমিকা কম নয়।
এটি এখন আর রাখঢাক বা গোপন করার বিষয় নেই যে, ক্রিকেট নিয়ে এখন কী ভয়াবহ জুয়া চলে! প্রতি বলেই জুয়া চলে। সেটা পাঁচতারকা হোটেল থেকে পাড়া-মহল্লার সেলুনে পর্যন্ত। কিন্তু তারপরও যখন বিদেশে মাটিতে বাংলাদেশের ১১জন খেলোয়ার খেলতে নামেন, তাদের পেছনে সব কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে যায় ১৭ কোটি মানুষ; নানা বিতর্ক আর সমালোচনার পরও সম্ভবত এটাকেই বলে দেশপ্রেম।
জয় হোক ক্রিকেটের; জয় হোক বাংলাদেশের; কলুষমুক্ত হোক ক্রিকেটবিশ্ব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)