ক্রিকেট দিয়ে দেশ এগোয় না। দেশের নাম ফাটে। দেশ এগোয় শিক্ষায়, গবেষণায়, উদ্ভাবনে। হ্যাঁ, ক্রিকেটে আমরা অনেক খানি এগিয়েছি। বহির্বিশ্বে ক্রিকেটভক্ত মানুষের কাছে আমাদের দেশের নাম ছড়িয়েছে। এটা অবশ্যই সুসংবাদ। কিন্তু আমাদের আসল উন্নতির পরিচয় যেখানে, যা দিয়ে একটি দেশ এগোয়, সেই শিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবনে আমরা কতটুকু এগোচ্ছি? আদৌ কি এগোচ্ছি?
গবেষণা ছাড়া শিক্ষাকে আর শিক্ষা ছাড়া দেশকে এগিয়ে নেওয়া অসম্ভব। পৃথিবীর সব দেশেই গবেষণাকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা সবচেয়ে কম মূল্য দিই গবেষণাকে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণা প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয় না। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাজেটে বিজ্ঞানভিত্তিক উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখন এই ‘বিজ্ঞানভিত্তিক উচ্চ শিক্ষা’ বাদ দিয়ে শুধু গবেষণায় কতো টাকা বরাদ্দ সেটা জানতেও গবেষণার দরকার! পরিমাণটা যে খুব বেশি নয়, তা অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়। দেশের সবচেয়ে সেরা বিদ্যাপীঠের বাজেটের দিকে তাকালেও বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৬৬৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বাজেট (প্রস্তাবিত) পেশ করা হয়েছে। বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের মাত্র ২ শতাংশ। আগের বছর এটি ছিল মাত্র সাড়ে আট কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, এর সিংহভাগ খরচ হবে (৭৮.৫৯ শতাংশ) শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়।
এই হচ্ছে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় গবেষণাখাতে ব্যয় বরাদ্দের চিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো তবু কিছু টাকা ধরা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে গবেষণায় কোনো টাকাই বরাদ্দ থাকে না! বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর ৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। এর মধ্যে সরকারি ১০টি ও বেসরকারি ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। উচ্চশিক্ষায় গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ না রাখার ঘটনা সম্ভবত বাংলাদেশেই প্রথম। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে নতুন জ্ঞান ও তথ্যের অনুসন্ধান। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ না রাখায় নতুন জ্ঞান কীভাবে তৈরি করবে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মৌলিক কাজই হচ্ছে গবেষণা করা। গবেষণাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (প্রাথমিক-মাধ্যমিক-কলেজ) পার্থক্য। অথচ সারা বিশ্বের মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাকে প্রাধান্য দিলেও আমাদের এখানে এ খাতে তার চিত্র উল্টো।
ক্রিকেটে বিশ্বের প্রথম দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম আছে। কিন্তু অংক, বিজ্ঞান গবেষণায় কি আছে? নাম্বার থিওরি, ফিজিক্স, অপটিক্স, মেটামরফিক রক কিংবা ভূমিকম্প গবেষণায় কি আছে? আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্রিকেট ছাড়া কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের কোনো অবস্থান ও কৃতিত্ব নেই। এমনকি বিনোদনের জগতেও নেই। বিনোদন কিংবা ক্রীড়া জগতে আমাদের অবস্থান যেমনই হোক, তা নিয়ে বড় বেশি খেদ নেই, কেননা তাতে জাতি হিসেবে আমরা খুব বেশি উন্নতি বা অবনতির সীমায় পৌঁছতে পারব না! আমাদের আফসোস অ্যাকাডেমিশিয়ানদের নিয়ে, যাঁরা উচ্চশিক্ষার জগতে যুক্ত, বিশ্ববিদ্যালয় বা ইনস্টিটিউটগুলোতে পড়ানো এবং গবেষণার কাজে ব্যাপৃত। আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাগ কাটার সুযোগ তাঁদেরই রয়েছে৷
একাডেমিক প্রত্যেকটা বিষয়কে আট-দশটা করে প্রধান ভাগে ভাগ করা যাক৷ যেমন ফিজিক্স৷ এর ভাগগুলো হতে পারে অপটিক্স, সাউন্ড, স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদি ইত্যাদি৷ অঙ্কের ভাগগুলো হতে পারে টপোলজি, অ্যালজেবরা, নাম্বার থিওরি, এই সব৷ উল্লিখিত বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের গবেষকদের স্থান ঠিক কোথায়?
এই উত্তর জানার জন্যে পরিশ্রমের কোনও প্রয়োজন নেই৷ আন্তর্জাতিক শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতিগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি৷ একমাত্র শান্তির ক্ষেত্র ছাড়া এই দেশের কেউ নোবেল পাননি!
অবশ্য বাংলাদেশের গবেষকদের বিচার করবার সময় তাঁদের অ্যাকাডেমিক প্রতিবন্ধকতাটাও মাথায় রাখতে হবে৷ না হলে অবিচার হবে তাঁদের উপরে৷ গবেষণার জগতে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় গবেষকদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই আছে ছোটো ছোটো কিছু দল৷ এই দলগুলি মূলত উপবিভাগভিত্তিক৷ অর্থাৎ ধরা যাক অপটিক্স৷ তারও অনেক ভাগ৷ এই রকম যে কোনও বিষয়ের এক এক ভাগের হয়তো আছে এক একটা দল যাঁরা বিভিন্ন ভালো ভালো জার্নালে সেই ভাগের গবেষণাপত্র প্রকাশকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেন৷ আর সেই দলে না ঢুকতে পারলে উচ্চমানের জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা কঠিন, এ কথা সংশ্লিষ্ট সকলেই জানেন এবং অনেকেই মুখেও মানেন৷ এ কথাও ঠিক যে বাংলাদেশের মতো দেশে থেকে এবং গবেষণা করে সাঙ্ঘাতিক কঠিন ওই দলগুলোতে ঢোকা৷ যাঁরা সত্যিকারের খুব ভালো, তাঁরাই হয়তো এখানে থেকে এটা পারেন৷ কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতাকে হিসেবে ধরেও সব মিলিয়ে আমাদের গবেষণার অবস্থাটা কিন্তু খুবই হতাশাব্যঞ্জক।
করদাতাদের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে চলেছে উচ্চশিক্ষার মহোত্সবে৷ কিন্তু সেখানে গবেষণার হাল খুবই করুণ। ফলে আমাদের উচ্চশিক্ষিত ছাত্রদের উজ্জ্বলতর অংশই পাড়ি দেন বিদেশে৷ সামান্য অংশ উচ্চতর শিক্ষার জন্যে, আর বেশির ভাগই আরও ভালো, সমৃদ্ধ জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষায়৷ উচ্চশিক্ষায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে আমরা মূলত আমেরিকা এবং সঙ্গে অন্যান্য কিছু দেশকে বছরের পর বছর উপহার দিয়ে চলেছি কিছু ফিনিশড প্রোডাক্ট, যা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতিতে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে৷
আর কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমরা আমাদের জন্যে তৈরি করে চলেছি মূলত মধ্যমানের কিছু গবেষক৷ যাঁরা জ্ঞানকে ‘ফলদায়ক’ করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। গবেষণাখাতে যতোটুকু যা ব্যয় হচ্ছে যার অনেকাংশই অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়৷ সরকারি অর্থে অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে চলেছে মধ্যমানের প্রায়-ফলহীন প্রোজেক্ট আর কনফারেন্সের নামে দেশে-বিদেশে বেড়ানো৷ আমাদের দেশে গবেষণায় যেমন বরাদ্দ নেই, আবার কে কি বিষয়ে গবেষণা করবে, সে বিষয়ে কোনো সুষ্ঠু নিয়মনীতি ও দিকনির্দেশনা নেই। গবেষণা ফান্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে পৃথিবীর সব দেশেই প্রতিযোগিতা আছে। আমেরিকায় এই ফান্ডিং-এর জন্যে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা৷ এ ছাড়াও সেখানে অ্যাকাডেমিকসের ফান্ডিং এজেন্সিগুলোর একটা বড়ো অংশই বেসরকারি (আমাদের দেশে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ফান্ড দেয় না)! আর ইউরোপে, যেখানে সরকারি সংস্থাই ফান্ডিং-এর প্রধান উৎস, সেখানেও তা ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতাপূর্ণ৷ যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েই অর্জন করতে হয় সেই অর্থ৷
কিন্তু আমাদের দেশে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো নীতি নেই। স্বজনপ্রীতি এ ক্ষেত্রেও আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রেখেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি বদলানো প্রয়োজন। প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দাগ কাটার মতো সম্ভাবনাগুলোকে খুঁজে বের করে সযত্নে লালন করা৷
আমাদের শিক্ষা গবেষণায় অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রয়োজন বিদেশে পাড়ি দিতে চাওয়া ছাত্রদের উজ্জ্বলতর অংশকে ধরে রাখা বা সময়মতো দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা। অন্তত তাঁদের মধ্যে যারা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জগতে থাকতে চায় তাঁদের৷ যারা বিদেশে পাড়ি দেন তাদের সবাই যে সাঙ্ঘাতিক ভালো, তা হয়তো নয়৷ কিন্তু যাঁরা প্রকৃতই সাঙ্ঘাতিক ভালো, তাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। এই সাংঘাতিক ভালোরা যারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দাগ কাটতে পারবেন, প্রয়োজনে তাদেরকে বেশি মাইনে ও সুবিধা দিতে হবে, তারা বিদেশে থাকলে যা পেতেন দিতে হবে তাই৷
মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষার সঙ্গে গবেষণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গবেষণাহীন শিক্ষা কোনোদিন কাঙ্ক্ষিত ফল উপহার দিতে পারে না। বরং গবেষণাহীন শিক্ষায় প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিপরীত ফলের আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশে শিক্ষায় গবেষণার রুদ্ধদ্বার আজও খোলেনি। যেটুকু আছে তা স্বার্থের কালিতে আর পলিসির প্যাঁচে পড়ে গঙ্গাজলে ইঁদুরডুব দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আজ মৌলিক গবেষণার পরিবর্তে ব্যবসায়িক স্বার্থে রাখে ঈগল দৃষ্টি। এত প্রতিকূলতার পরও সরকারের আন্তঃবিভাগগুলো যে গবেষণা করে থাকে, সেখানে সমন্বয়হীনতা অন্তহীন। যার ফলে গবেষণার প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে সুদূরপরাহত। তাই প্রত্যাশিত ফল পেতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মৌলিক গবেষণায় বরাদ্দ ও প্রণোদনা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের আন্তঃবিভাগগুলো-যেমন ইউজিসি, মাউশি, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ, এনসিটিবি, ব্যানবেইস, নায়েম, বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রকল্পের মধ্যে সমন্বয় রেখে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। নায়েমের মতো প্রতিষ্ঠা করতে হবে জাতীয় শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা গবেষকের পদ সৃষ্টি করতে হবে। আরেকটি কথা। মুড়ি-মুড়কির পার্থক্য করাটা খুবই দরকার৷ চাই সম্পদের পরিকল্পিত সুষ্ঠু বিভাজন ও যথাযথ ব্যয় নিশ্চিত করা৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)