বিশ্বকাপে নজরকাড়া পারফরম্যান্স, এরপর টানা চারটি ওয়ানডে সিরিজ জয়ে নিজেদের ভালোর সব সীমানা ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ। অথচ গত অক্টোবরের আগেই ছিলো অন্য চিত্র। হারের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতে ক্লান্ত বাংলাদেশ ওয়েস্টইন্ডিজ সফর শেষ করে দেশে ফিরেছিলো ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে।
এরপর মাসখানেক বিশ্রাম নিয়ে বিশ্বকাপের আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হোমসিরিজে স্বপ্নযাত্রার শুরু।
জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে প্রায় ভুলতে বসা অধরা জয়ের স্বাদ আবারো পায় বাংলাদেশ। শুধু জয়ের দেখা পাওয়াই শুধু নয়, টেস্ট-ওয়ানডে দুই সিরিজেই ধবলধোলাই করে একসময়ের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী জিম্বাবুয়েকে দিয়েই শুরু। যদিও ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শতভাগ সাফল্যের পরও বিশ্বক্রিকেটের নজর কাড়া শুরু হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে বিশ্বকাপে নিজেদের ইতিহাস সেরা সাফল্যের ডালি সাজিয়ে বিশ্বক্রিকেটের মনোযোগ নিজেদের উপর নেওয়া শুরু করে বাংলাদেশ।
প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালের স্বপ্নপূরণের পর ভারতের কাছে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বলি হওয়া ম্যাচ হেরে ক্রিকেটভক্তদের ভালোবাসা আর সমর্থন এবং ক্রিকেটবিশ্বের প্রশংসা ঝুড়ি নিয়ে দেশে ফিরে টাইগাররা।
এরপরের গল্পটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। একে একে পাকিস্তান, ভারত ও সবশেষে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ওয়ানডে সিরিজে হারিয়ে নিজেদের নতুন করে চেনানোর কাজটা ভালোভাবেই করেছে টিম টাইগার্স। ওয়ানডে ফরম্যাটে যে কোনো দলের জন্য এখন নিশ্চিত আতঙ্কের নাম বাংলাদেশ।
শুধু ওয়ানডেই নয় ক্রিকেটের অন্য দুই ফরম্যাটেও উন্নতির স্পষ্ট স্বাক্ষর রেখেছে টিম বাংলাদেশ। সবশেষ তিন টেস্টে ‘ড্র’ করার পেছনে বৃষ্টির অবদানই বেশি হলেও এরমাঝেই যতোটুকু সুযোগ মিলেছে নিজেদের ভালো করার অদম্য ইচ্ছা এবং এর পারফরম্যান্সে এর প্রতিফলন টাইগাররা বেশ সফলভাবেই ঘটিয়েছে। এরমধ্যে পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনা টেস্টের ড্র করে দুর্দান্তভাবে ম্যাচে ফেরার সক্ষমতারও পরিচয় মিলেছে।
টেস্ট বেশি খেলার সুযোগ না থাকলেও বৃষ্টিবাধার পরও সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে চট্টগ্রাম ও ঢাকা টেস্টে সুযোগ পেয়েই নিজেদের সামর্থ্যের জানান দিয়েছে টাইগাররা। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ জেতা হয়েছে এই সময়ের মধ্যেই।
গত ১০ মাসে ২০ ম্যাচে ১৫ জয় পাওয়া বাংলাদেশের ভেতর শক্তিশালী এক ক্রিকেট রাষ্ট্রেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে ক্রিকেটবিশ্ব। সাফল্যের বিচারে প্রাপ্তির ডালাই শুধু পূর্ণ হয়নি, মাশরাফি-মুশফিক-রিয়াদ-সাকিব-তামিম-নাসির-রুবেলদের সঙ্গে নজরকাড়া পারফরম্যান্স দিয়ে দলে জায়গা পাকাপোক্ত করার সঙ্গে তারুণ্যে জয়গান গাইছেন সৌম্য-মুমিনুল-লিটন-তাসকিন-তাইজুল-জুবায়ের-মুস্তাফিজুরের মতো নতুন বিশ্বমানের তারকারা।
সবাই মিলে পারফরম করায় দলে জায়গা নিয়েও তৈরী হয়েছে মধুর সমস্যা। বিশ্বকাপে দারুন পারফরম্যান্স দেখালেও এনামুল হক বিজয়ের ইনজুরির সুযোগ ওয়ানডে দলে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন সৌম্য সরকার। ইনজুরি কাটিয়ে দলে ফিরেও তাই একাদশে সুযোগ হয়নি এনামুল হক বিজয়ের।
আর এই সামর্থ্যের পেছনে কারো একক অবদান নয় বরং সম্মিলিত প্রয়াসের সফল উদাহরণ ঘটিয়েছে টিম টাইগার্স। এর প্রমাণ পরিসংখ্যান। গত ১০ মাসে ওয়ানডেতে বেশি রান করা ১০ ব্যাটসম্যানের মধ্যে নেই বাংলাদেশের কেউ। টেস্টেও একই অবস্থা। বোলিং-এ শীর্ষ দশে টেস্টে তাইজুল ইসলাম এবং ওয়ানডেতে সাকিব আল হাসানই বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি।
ওয়ানডেতে ২০ ম্যাচে সাকিবের উইকেট সংখ্যা ৩০, মাশরাফি নিয়েছেন ১৮ ম্যাচে ২৬ উইকেট, রুবেল ২২টি, মুস্তাফিজ ১৮টি, আরাফাত সানি ১৬টি, তাসকিন ১৪টি আর নাসির ১২টি উইকেট শিকার করে হয়েছে সম্মিলিত প্রয়াসের স্বপ্নযাত্রার সারথী।
ওয়ানডে ফরম্যাটে ব্যাটিং এও সেই সম্মিলিত প্রয়াসেরই প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। গত ২০ ম্যাচে ৮২৪ রান নিয়ে ওয়ানডেতে টিমটাইগার্সের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম।
পাঁচশোর বেশি রান করেছে চারজন। তামিম, সৌম্য, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও সাকিবের। আর তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটে মিলিয়েও হাজারের বেশি রান চারজনের। ১৪৭২ রান নিয়ে সবার উপরে তামিম ইকবাল।
এই সময়ে বদলেছে ব্যাটিংয়ের ধরণও। গত অক্টোবরের আগে ২৮৯ ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ওভারপিছু রান যেখানে ৪.৩৩ করে সেখানে সবশেষ ২০ ম্যাচে ওভারপিছু সেই রানের গড় ৫.৬০ করে।
সামনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠে দুটি টেস্ট খেলার সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ। বৃষ্টি বাধায় সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে পারফরম্যান্সের মাঠের অনুবাদ করতে না পারার ক্ষুধা নিশ্চিতভাবেই টেস্টের অন্যতম শক্তিশালি দলের বিপক্ষে করতে প্রস্তুতি নেবে টিম বাংলাদেশ।
আর স্বপ্নযাত্রার পথে মৌসুমের শেষ মিশনে টাইগাররা অসিদের বিপক্ষেও দারুন খেলার স্বাক্ষর রাখবে, প্রত্যাশার সঙ্গে শুভকামনা আর সমর্থন নিয়ে সেই অপেক্ষায়ই থাকছেন ক্রিকেটভক্তরা।
স্বপ্নযাত্রা পথে ক্রিকেটারদের যতো কীর্তি:
১. পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের উদ্বোধনী জুটিতে তামিম ইকবাল-ইমরুল কায়েসের তোলা ৩১২ রান একই সঙ্গে উদ্বোধনী জুটি এবং দুই বাঁহাতি ওপেনারের জুটিতে সর্বোচ্চ।
২. ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেকে হ্যাটট্রিক করা প্রথম বোলার তাইজুল ইসলাম এই কীর্তি গড়েন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতে।
৩. ওয়ানডে ইতিহাসে দ্বিতীয় বোলার হিসেবে ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ম্যাচেই ৫ বা এর বেশি উইকেট নেওয়া বোলার মুস্তাফিজুর রহমান।
৪. ক্যারিয়ারের প্রথম তিন ওয়ানডে ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ১৩ উইকেট নেয়ার কীর্তিও গড়েন মুস্তাফিজুর রহমান। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডও এই বাঁহাতি পেসারের।
৫. সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে ওয়ানডে ক্রিকেটে চার হাজার রান ও ২০০ উইকেটের মাইলফলক সাকিব ছুঁয়েছেন ১৫৬ ম্যাচ খেলে।
৬. বাংলাদেশের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা দুই ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি পেয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও তামিম ইকবাল।
৭. পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ৪০টি চার পেরেছেন ওপেনার তামিম ইকবাল। তিন ম্যাচ সিরিজে এটি বিশ্বরেকর্ড।
৮. টেস্ট অভিষেকে চার বলের মধ্যে ৩ উইকেট নেওয়া চতুর্থ বোলার মুস্তাফিজুর রহমান।