চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ক্যান্সার হাসপাতালের তিন কর্মকর্তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ

আইসিইউর জন্য কেনা উচ্চমাত্রাসম্পন্ন কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র (ভেন্টিলেটর) স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারে অবহেলা করায় জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিআরএইচ) সাবেক ও বর্তমান তিন কর্মকর্তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এই তিন কর্মকর্তা হলেন: এএমএম শরিফুল আলম, মোল্লা ওবায়দুল্লাহ ও মানস কুমার বসু। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫ লক্ষ টাকা আদায় করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে এএমএম শরিফুল আলম ও মোল্লা ওবায়দুল্লাহ অবসরে গেছেন।

স্বাস্থ্য সচিবকে এই তিন কর্মকর্তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায়ের নির্দেশ দিয়ে আদালত বলেছে, হাসপাতালের উন্নয়ন তহবিলে আদায় করা টাকা জমা করতে হবে। ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের কাছ থেকে পিডিআর (পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি এ্যাক্ট, ১৯১৩) আইন অনুযায়ী টাকা আদায় করতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার রায় দিয়েছেন।

রায়ে বলা হয়েছে, ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক মোয়ররফ হোসেন দাবি করেছেন ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর ও ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই পাঠানো দুটি চিঠির মাধ্যমে ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়াকশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারকে (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) ভেন্টিলেটরগুলো সচল করার অনুরোধ করেছেন।

কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সিরাজুল ইসলামের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী নিমিউ কোনো চিঠি পায়নি।

এমন প্রেক্ষাপটে মোয়াররফ হোসেন নিমিউকে আদৌ চিঠি দিয়েছিলেন কিনা, সে বিষয়টির অধিকতর তদন্ত করতে সাত কার্যদিবসের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের উচ্চ পদস্ত তিন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। এবং এই কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে করতে হবে।

তদন্তে মোয়ররফ হোসেনের দাবির পক্ষে প্রমাণ না পাওয়া গেলে তার কাছ থেকেও ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে বলা হয়েছে। আর যদি এটা প্রমাণ হয় যে, নিমিউ অ্যান্ড টিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিষয়টি গোপন করেছেন, সেক্ষেত্রে নিমিউ’র সে সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আব্দুল কাইয়ুম (যুগ্ম সচিব, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ও যুগ্ম সচিব মো. রেজানুর রহমানের কাছ থেকেও ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে বলেছেন আদালত।

আদালত তার রায়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ যথাযথভাবে ব্যয়ের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে দেশের সব সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণে কিছু নিয়ম-নীতি অনুসরণ করতে বলেছেন। যেমন:

* চিকিৎসার জন্য যেকোনো যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা সামগ্রী বা ওষুধ কেনার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ কমিটি দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চাহিদা নিরূপন করে সরকারি ক্রয় বিধিমালা অনুসরণ করে সর্বোচ্চ মান সম্পন্ন চিকিৎসা সামগ্রী, যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে হবে।

* চাহিদা চূড়ান্ত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চাহিদা সম্পন্ন যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো/ইমারত নির্মাণ প্রয়োজন কিনা তা নিরূপন করতে হবে; অবকাঠামো দ্রুত প্রস্তুত হওয়া সাপেক্ষে যন্ত্রপাতি কিনতে হবে।

* সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি পরিচালনা রক্ষণাবেক্ষনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যাক উপযুক্ত কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তবে মূল্যবান যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ রাজস্ব খাতে হওয়া উচিত। আউট সোর্সিংয়ে নয়। কারণ আইট সোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো জবাবদিহিতা থাকে না।

* যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে অসম্ভব ও অতিমূল্য নির্ধারণ করে প্রাক্কলন তৈরি করা হয়; প্রাক্কলন নির্ধারণে সঠিক ও বাস্তবসম্মত মূল্য নির্দারণ করতে হবে।

* ঠিকাদারের কাছ থেকে যন্ত্রপাতি গ্রহণ বা বুঝে নেওয়ার আগে সরবরাহকৃত পণ্যের মান ও গুণ নিশ্চিত হতে হবে।

* জরুরিভিত্তিতে কোনো যন্ত্র কেনা বা চালু করার ক্ষেত্রেও একইভাবে শর্ত পূরণ করতে হবে।

* প্রতিটি হাসপাতালে সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করতে হবে; যাদের দায়িত্ব হবে যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সামগ্রীর যথাযথ মান নিরীক্ষা করা এবং যন্ত্রপাতিগুলো কার্যকর ও সচল রাখা।

* কোনো যন্ত্রপাতি মেরামত ও কিংবা ওভার হোলিংয়ের প্রয়োজন হলে অবশ্যই যন্ত্রপাতি চালু ও রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বপ্রাপ্তদের জানাতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ না নিলে তদারকির জন্য গঠিত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটিকে তা একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে বিষয়টি জানাবেন।

* এ বিষয়ে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করে দায় নির্দারণ করবেন। আর্থিক ক্ষতি হলে যার কারণে ক্ষতি হবে তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

* স্থাপিত প্রতিটি যন্ত্রের কক্ষের বাইরে যন্ত্রের কর্মক্ষমতা ও মেয়াদকাল লিখিতভাবে উল্লেখ করে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখতে হবে, যাতে যন্ত্রটির মেয়াদকাল ও বর্তমান অবস্থা দৃশ্যমান থাকে।

* উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করা যেতে পারে। যাতে যন্ত্রপাতিগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর থাকে।

এছাড়া রায়ের দেওয়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি-অনিয়ম প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হল।

গত ২ জানুয়ারি ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে এনআইসিআরএইচ’র আইসিইউ’র জন্য কেনা উচ্চমাত্রাসম্পন্ন কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারে অনিয়ম-অবহেলা সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

সেই প্রতিবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মনোজ কুমার ভৌমিক হাইকোর্টের নজরে আনার পর আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেয়। সেই সঙ্গে যন্ত্র স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারে কর্তৃপক্ষের অনিয়ম-অবহেলা খতিয়ে দেখে স্বাস্থ্য সচিবকে প্রতিবেদন দিতে বলেন আদালত।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর এ বিষয়ে আদালত শুনানি নিয়ে রুল নিষ্পত্তি করে আজ রায় দিলেন।