ব্রাজিলের উপর চাপের পাহাড়। লিওনেল মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে শিরোপাখরা কাটাতে মরিয়া। অন্যদিকে রদ্রিগেজ কলম্বিয়ার হয়ে ফের মেজর টুর্নামেন্টে আলো কাড়তে প্রস্তুত। এসব নিয়েই শুক্রবার রাত থেকে কোপা আমেরিকার ৪৬তম আসর শুরু হচ্ছে।
ইনজুরির কারণে নেইমার কোপা আমেরিকা থেকে ছিটকে পড়ায় স্বাগতিক ব্রাজিল হোঁচট খেলেও দলটিতে তারকার অভাব নেই। সেরা তারকাকে ছাড়াই একযুগ পর কোপা আমেরিকার শিরোপা জিততে মরিয়া সেলেসাওরা। শুক্রবার (বাংলাদেশ সময় শনিবার সকাল ৬.০০ টায়) বলিভিয়ার বিপক্ষে টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে লড়বে ব্রাজিল।
কোপা আমেরিকার সমৃদ্ধ ইতিহাস
ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন টুর্নামেন্টগুলো একটি কোপা আমেরিকা। ১৯১৬ সালে টুর্নামেন্ট যাত্রা করে। প্রথমদিকে প্রায় প্রতিবছরই কোপার আসর বসতো। টুর্নামেন্টের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বকাপ ফুটবল ও ইউরো কাপ চালু হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে দুই, তিনবছর পর কোপার আসর বসতো। এখন সেটি চার বছর পরপর হচ্ছে। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ শুরু হলেও কোপার জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।
এই শতাব্দীতে কোপা আমেরিকার শিরোপাজয়ী দলগুলো
সাল-আয়োজক দেশ-চ্যাম্পিয়ন
২০০১-কলম্বিয়া-কলম্বিয়া
২০০৪-পেরু-ব্রাজিল
২০০৭-ভেনেজুয়েলা-ব্রাজিল
২০১১-আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ে
২০১৫-চিলি-চিলি
২০১৬ (শতবর্ষী আসর)-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চিলি
কোপা আমেরিকার অংশগ্রহণকারী দলগুলোতে অনেক নতুন কোচ রয়েছেন, নতুন অনেক খেলোয়াড় দিয়ে দল গড়া হয়েছে। নতুন খেলোয়াড়-কোচদের অনেকেই বিশ্ব ফুটবলে নিজেদের আসন পাকা করবেন, আবার অনেকেই চলে যাবেন আলোচনার বাইরে।
স্বাগতিক ব্রাজিলের উপর চাপের পাহাড়
ব্রাজিলের জার্সিতে ৯৭ ম্যাচে ৬০ গোল করা নেইমার ইনজুরির কারণে ছিটকে পড়ায় টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার আগেই হোঁচট খেয়েছে ব্রাজিল। তারপরও হট-ফেভারিটদের তালিকাতেই থাকছে সেলেসাওরা।
কোপা আমেরিকায় স্বাগতিক দলগুলো বরাবরই ভালো করে থাকে। তবে শিরোপা জয়ের জন্য এবারের ব্রাজিলের মতো আর কোনো দল চাপে ছিল কিনা সেটিও আলোচনার বিষয়।
গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়া ব্রাজিলের মনে এখনো ঘরের মাঠে ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ১-৭ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার স্মৃতি টাটকা। কোপা আমেরিকার গত তিন আসরে একবারও কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডি পেরোতে পারেনি ব্রাজিল। এরমধ্যে গত বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে সেলেসাওরা।
ব্রাজিল এর আগে যতবার কোপা আমেরিকা আয়োজন করেছিল, প্রতিবারই শিরোপা জিতেছে। অতীত ইতিহাস, গত কয়েক আসরের ব্যর্থতা ও ২০১৪ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার কারণে এবার শিরোপা জয়ের জন্য ব্রাজিলের উপর সীমাহীন চাপ থাকবে।
কোপা আমেরিকার গ্রুপিং
গ্রুপ এ: ব্রাজিল, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা ও পেরু।
গ্রুপ বি: আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, প্যারাগুয়ে ও কাতার।
গ্রুপ সি: উরুগুয়ে, ইকুয়েডর, জাপান ও চিলি।
কোপায় ব্রাজিলের ম্যাচের সূচি (বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী)
ব্রাজিল-বলিভিয়া (শনিবার সকাল ৬টা)
ব্রাজিল-ভেনেজুয়েলা (বুধবার সকাল ৬টা)
ব্রাজিল-পেরু (শনিবার রাত ১২.৩০মিনিট)
আর্জেন্টিনার ম্যাচের সময়-সূচি
আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়া (রোববার রাত ৩.৩০মিনিট)
আর্জেন্টিনা-প্যারাগুয়ে (বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা)
আর্জেন্টিনা-কাতার (রোববার রাত ১২.৩০মিনিট)
‘সিরিয়াস’ লিওনেল মেসি
আর্জেন্টিনার হয়ে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ এবং অলিম্পিকে সোনা জেতার সুখস্মৃতি আছে মেসির। তবে সিনিয়র টিমের হয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো মেজর শিরোপা জিততে পারেননি বার্সেলোনা ফরোয়ার্ড। এবার সেই আক্ষেপ দূর করতে মরিয়া মেসি।
কয়েকমাস আগেও কোপা আমেরিকার এবারের আসরে মেসির অংশ নেয়া অনিশ্চিত ছিল। গত বছর আর্জেন্টিনার হয়ে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন কিং লিও। সম্প্রতি জাতীয় দলে ফিরেই জোড়া গোল করেছেন এলএম টেন। কোপায়ও সেই ফর্ম ধরে রাখতে পারলে দারুণকিছু হতে পারে মেসি ও আর্জেন্টিনার জন্য।
এদিকে আগামী বছর কলম্বিয়াকে নিয়ে কোপা আমেরিকার ৪৭তম আসর আয়োজন করবে আর্জেন্টিনা। ফলে এক বছরের মধ্যে দুবার শিরোপা জয়ের সুবর্ণ সুযোগ পাচ্ছে আর্জেন্টিনা! মেসি কি সুবর্ণ সুযোগ লুফে নিতে পারবেন?
আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকার ফাইনালে তিনবার ওঠার পাশাপাশি বিশ্বকাপেরও ফাইনালে (২০১৪) একবার উঠেছেন মেসি। বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে যায় আলবিসেলেস্তেরা। অন্যদিকে ২০০৭ সালে কোপার ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল পরাজয়ের তেতো স্বাদ উপহার দেয় আকাশী-নীলদের। আর ২০১৫ ও ২০১৬ সালের কোপার ফাইনালে চিলির কাছে টাইব্রেকারে হেরে শিরোপা-স্বপ্ন বিসর্জন দেয়ার দগদগে ক্ষত নিয়েই ব্রাজিলে পা রেখেছেন মেসি-আগুয়েরো-ডি মারিয়ারা।
সেই ক্ষতে এবার প্রলেপ দিতে পারবে ১৯৯৩ সালের পর কোনো মেজর শিরোপা না জেতা আর্জেন্টিনা? আকাশী-নীল জার্সিতে প্রথম শিরোপা জয়ের অপেক্ষা ফুরাবে মেসির?
উরুগুয়ে হুমকি
উরুগুয়ে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে সাউথ আমেরিকার অন্যতম সেরা দল নিয়ে গিয়েও ব্যর্থ। শেষ ষোলো থেকে বিদায় নেয় অস্কার তাবারেজের দল। তবে কোপা আমেরিকার টুর্নামেন্টে উরুগুয়েকে হিসেবের মধ্যে রাখতেই হবে। পরিসংখ্যান সেটিই বলে। কোপা আমেরিকার সবচেয়ে বেশি ১৫টি শিরোপা জেতা দলের নাম উরুগুয়ে। আর্জেন্টিনার চেয়ে একটি শিরোপা বেশি জিতেছে উরুগুইয়ানরা। ব্রাজিল শিরোপা জিতেছে সেখানে ৮ বার।
ঐতিহাসিকভাবেই স্বাগতিকদের স্বপ্ন চূর্ণ করার গৌরবময় রেকর্ড রয়েছে উরুগুয়ের। ১৯৫০ সালে স্বাগতিক ব্রাজিলকে কাঁদিয়ে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল উরুগুয়ে। ২০১০ সালে গ্রুপপর্বে স্বাগতিক সাউথ আফ্রিকা এবং ২০১৮ বিশ্বকাপে রাশিয়াকে হারের স্বাদ উপহার দেয় দেশটি। তাবারেজের অধীনেই স্বাগতিক আর্জেন্টিনা ও ভেনেজুয়েলার কোপা অভিযান শেষ করে উরুগুয়ে। এবার কি ব্রাজিলের স্বপ্ন চুরমার করে শিরোপা জিততে পারবেন লুইস সুয়ারেজ, এডিনসন কাভানি, ডিয়েগো গডিনরা?
কলম্বিয়া ও চিলি
কোপা আমেরিকার গত দুই আসরের শিরোপাজয়ী দলের নাম চিলি। ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে শিরোপা জেতে চিলিয়ানরা। হ্যাটট্রিক শিরোপার স্বপ্ন দেখতেই পারে চিলি। অন্যদিকে বড় দলগুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে হামেস রদ্রিগেজের কলম্বিয়া।
সারপ্রাইজের অপেক্ষা
কোপা আমেরিকার আলোচনার অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে দুই অতিথি দলকে নিমন্ত্রণ জানানো। সাধারণত কোপার আসরে কনক্যাকাফ অঞ্চলের দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে টুর্নামেন্টের আয়োজক কনমেবল। তবে শনিবার থেকে কনক্যাকাফ গোল্ডকাপ শুরু হতে যাওয়ায় সেটি সম্ভব হয়নি। ফলে ৪ গ্রুপ ১৬ দলের পরিবর্তে ৩ গ্রুপ ও ১২টি দল নিয়ে টুর্নামেন্ট আয়োজিত হচ্ছে। আর দুই অতিথি দল হিসেবে জাপান ও কাতারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে কনমেবল।
১৯৯৯ সালে প্যারাগুয়েতে কোপা আমেরিকার আসরে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে জাপানের। এশিয়ান পরাশক্তিরা সাউথ আমেরিকান শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে দ্বিতীয়বারের মতো খেলতে যাচ্ছে। অন্যদিকে কোপায় প্রথমবারের মতো খেলতে যাচ্ছে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক কাতার। ফলে আগামী বিশ্বকাপের আয়োজক দেশটি বিশ্বমঞ্চে নামার আগে আদর্শ প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
কোয়ার্টারে থাকছে না অতিরিক্ত সময়ের খেলা
নকআউট পর্বে যদি নির্ধারিত সময়ের খেলা অমীমাংসিত থাকে, তথা- কোয়ার্টার ফাইনালে যদি নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষে খেলা অমীমাংসিত থাকে তবে পেনাল্টি শ্যুটআউটে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।
সেমিফাইনাল, তৃতীয়স্থান নির্ধারণী এবং ফাইনালে যদি নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষে খেলা অমীমাংসিত থাকে, তবে অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা মাঠে গড়াবে। এরপরও ফলাফল না হলে পেনাল্টি শ্যুটআউটে ফলাফল নির্ধারিত হবে।
সেমিফাইনাল, তৃতীয়স্থান নির্ধারণী এবং ফাইনাল ম্যাচে চতুর্থ বদলি খেলোয়াড় মাঠে নামাতে পারবে দলগুলো। অন্য ম্যাচগুলোতে যথারীতি তিনজন বদলি খেলোয়াড় মাঠে নামতে পারবেন।