তারেক রহমান পাসপোর্ট সারেন্ডার করে ভিনদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছেন বলে বিভিন্ন মহলে কথা উঠেছে। স্বদেশে তার বিরুদ্ধে জারি রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তিনি পলাতক দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত হলো আর তার পদে পদায়িত করা হল আরেক দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমানকে।
দেশের বাইরে থেকে যদি দল চালানো যেতো তখন আর কারও বিদেশ গমনের সময় তার পদে অন্য কাউকে ভারপ্রাপ্ত হিসাবে নিয়োগের কথা আসতো না। বিএনপির এই সিদ্ধান্ত কি চেয়ারপার্সনের ব্যক্তিগত ইচ্ছায় না দলীয় ফোরামের ইচ্ছায়? কিন্তু এর পেছনে কি যুক্তি? কোন যুক্তিতে দলে অনেক সিনিয়র নেতা থাকা স্বত্বতেও অল্পবয়সী জুনিয়র পলাতক ব্যক্তিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন করা হল? চেয়ারপার্সন হওয়ার মতো দলে আর কেউ কি যোগ্য ছিলও না? নাকি যোগ্য ছিল কিন্তু বিশ্বস্ত ছিলও না? যদি ব্যাপারটা তা-ই হয় দলের প্রধান দলের অভ্যন্তরে বিশ্বাস করার মতো কাউকে পেলেন না। সেটা বেছে নিতে হল দলগত ভাবে নয় পারিবারিক ও রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে। তাহলে যদি বলা হয় বিএনপিতে দলীয় আদর্শিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। এমন বলাটা কি অযৌক্তিক হবে?
দলটি লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেনি। বিএনপির উত্থান ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে।বাম, ডান, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের এক অভূতপূর্ব মিলনমেলা হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলটিতে।
দলটিতে কেউ আসে মন্ত্রী হতে, কেউ আসে এমপি হতে। বিভিন্ন দলছুট সুবিধাবাদীরা প্রেসিডেন্ট জিয়ার দলে যোগদান করে। যদি জিয়া প্রেসিডেন্ট না হতো কোন কোন নেতা যোগ দিতো তখন? ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা সকলেরই খুব পছন্দের। যেমন সরকার দলের সংসদ সদস্যের এপিএস অনেকেই হতে চাইবে কিন্তু বিরোধী দলের বেলায় এ পদে আগ্রহী হবে আর কতজন? মন্ত্রীর আশেপাশে থাকতে কত মানুষের আকাঙ্ক্ষা।এই আগ্রহটা কি মন্ত্রীর প্রতি কিংবা তার দলের প্রতি আনুগত্যে? মোটেই না। এটা স্রেফ ক্ষমতা সঙ্গকে ভোগ করার আকাঙ্ক্ষাই নয় কি? এরকম সঙ্গের সঙ্গী হতে আগ্রহীদের নিয়েই গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট, জাগ দল ও ইউথ ফোরাম প্রভৃতি।
ক্ষমতা সঙ্গের আকাঙ্ক্ষা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও জেগে ওঠে। প্রতিটা গ্রামে গ্রামে গড়ে তোলে গ্রাম সরকার। এখানে একজন গ্রাম সরকার, একজন সচিব ও কয়েকজনকে নিয়ে কমিটি গঠিত হয়। গ্রাম সরকার কমিটির লোকেরাও ক্ষমতা সঙ্গ পেতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার দলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। জিয়া যদি প্রেসিডেন্ট না হয়ে গ্রাম সরকার গঠনের আহ্বান জানাতো কয়জন এ আহ্বানে সাড়া দিতো?
একটা মজার কথা বলেছিলেন বর্তমান পানি সম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। বর্তমানে জাতীয় পার্টির একাংশ নিয়ে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী হিসাবে আছেন। বিগত দিনে এরকম ক্ষমতার অংশীদার হিসাবে তিনি বলেছিলেন, ‘গৃহস্থের ঘরের মুরগী খুঁইট্টা খায়। আমরা ও তাই।’ এই খুঁইট্টা খাওয়াটা আমাদের রাজনীতিকে গ্রাস করে ফেলেছে। গৃহস্থের যদি ধান চাল, গম না থাকে তাহলে তাকে ঘিরে খুঁইট্টা খাওয়া মুরগী কয়জন থাকতো?
একটা চরম সত্য কথা বলেছিলেন সেদিন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। আমরা কি দেখছি? আওয়ামী লীগ নেতাকে দেখি হয়ে যায় বিএনপি নেতা, বিএনপি নেতা হয়ে যায় আওয়ামী লীগ নেতা, বাম নেতা হয়ে যায় ডান নেতা, বিএনপি নেতা হয়ে যায় জাতীয় পার্টি নেতা।
তারেক রহমানের উত্থান ছিল ক্ষমতা সঙ্গের ভিত্তিতেই। তিনি এমপি, মন্ত্রী এসবের কিছুই ছিলেন না। ছিলেন প্রধান মন্ত্রীর পুত্র। যদি বেগম খালেদা জিয়া প্রধান মন্ত্রী না থাকতেন তখন তার কথিত হাওয়া ভবনে কে যেতো? বাংলাদেশের রাজনৈতিক গৃহস্থের নাম ক্ষমতা। এই গৃহস্থ পরিবারের কেউ কেউ সরাসরি সদস্য থাকে। এর উঠোনের চাল, গম খুঁইট্টা খায়। অন্যরা সুযোগ খুঁজে উঠোনে প্রবেশের। তারেক রহমান যখন গৃহস্থ পরিবারের যুবরাজ ছিল তখন সবাই তাকে তোয়াজ করতে হাওয়া ভবনে ছুটতো।
তারেক রহমান যখন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ছিলেন তখন হয়ে ওঠেন রাজনীতির যুবরাজ। অনেক সিনিয়র বিজ্ঞ বিজ্ঞ নেতা নিজের নেতৃত্বের চেয়ার রক্ষা করতে তাকে তোয়াজ করে চলতেন। যুবরাজ তারেকের সুদৃষ্টি পেতে গলদঘর্ম হতেন তারা। আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার মতো প্রবীণ, বিজ্ঞ বাম নেতাও তারেক রহমানের তোয়াজ করতে থাকেন।
ওয়ান ইলেভেনের সময় ক্ষমতার চাল,গম যখন ফখর উদ্দীন-মঈন উদ্দীনদের হাতে চলে যায় তখন মান্নান ভুঁইয়ার ভোল পাল্টে যায়। তখন তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে কথিত সংস্কারপন্থী গ্রুপ।এ গ্রুপে ছিলেন সাবেক বামনেতা আলী নওয়াজ খৈয়ম, জহিরউদ্দীন স্বপন প্রমুখ। আলী নওয়াজ খৈয়ম ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ও রাজবাড়ি পৌরসভার চেয়ারম্যান। জহিরউদ্দীন স্বপন ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি। তারা দুজনই বাম হতে ডানে এসে চরম ডান ও সুবিধাবাদী হয়ে ওঠেন।
সংবাদ শিরোনাম হয়, ‘আনে স্বপন খায় মোহন’। জহিরউদ্দীন স্বপন তার ভাই মোহনকে দিয়ে গড়ে তুলেন একটি লুটপাটের সিন্ডিকেট। ক্ষমতা পেলে তা যে চলে যেতে পারে এমনটি কেউ ভাবেনা। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে রাজপথে দুই তরুণীকে বিবস্ত্র করার ঘটনা ঘটেছিল। এই ঘটনার প্রতিবাদ করায় তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং এডভোকেট সাহারা খাতুন গ্রেপ্তার হয়েছিল।সেদিন যারা এই ঘটনার সৃষ্টি করেছিল তারা আজ কোথায়?
ক্ষমতা যারা পায় তারা আর তা হারানোর বিষয়ে ভাবেনা। বিএনপির আমলে টিভিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলা হত মরহুম মুজিবুর রহমান। জিয়াউর রহমানকে বলা হতো শহীদ জিয়াউর রহমান। তিনি কি কোন যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন? শহীদের সংজ্ঞায় কি বলে? ১৭/২/১৯৯৫ সালে দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয় বিভাগে একটা কলাম লিখেছিলাম। যার শিরোনাম ছিল: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশী কর্মকাণ্ড। এতে লিখেছিলাম, ‘১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পেরিয়ে গেল। নীরবে, নিভৃতে।সরকারি প্রচার মাধ্যম রেডিও টেলিভিশনে কোন অনুষ্ঠান করা হয়নি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। লাখো বাঙালি পরিবেষ্টিত সদ্যকারামুক্ত মুজিবের ছবি দেখতে পায়নি, এদেশের নতুন প্রজন্ম। যাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের উল্টো ইতিহাস পড়িয়ে অকাল কুষ্মাণ্ড বানিয়ে রাখা হচ্ছে অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে।’ সেদিনের সেই পরিকল্পনাকারীরা আজ কোথায়?
তারা কি তাদের আজকের অবস্থা তখন কল্পনা করতে পেরেছিলও? যদি পারতো তাহলে রাজনীতি সুস্থতার দিকে ধাবিত হতো। তখন ছিলও দোররা মেরে নারী হত্যা। যখন তখন যে কাউকে মুরতাদ ঘোষণা করা।ছিলও ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম। ফতোয়াবাজরা শুক্কুরীর জানাজা হতে দেয়নি। কুকুর বেড়ালের মত তার লাশটা মাটিতে পুঁতে ফেলেছে। এসব ফতোয়াবাজরা তৎকালীন সরকারের প্রশ্রয় পেয়েই এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
ক্ষমতার স্পর্শ কেন জানি বর্তমান ছাড়া সবকিছু ভুলিয়ে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে ক্ষমতা চলে গেলে কী পরিণতি হতে পারে। তা কেউ ভাবছেনা। তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হয়ে বর্তমান কে ঘিরেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন।
একদিন ক্ষমতা চলে যাবে ক্ষমতা থাকার সময় তিনি তা ভাবেন নি। গণতন্ত্র মানি তবে তালগাছটা আমার থাকতে হবে। তালের পিঠা আমি আর আমার পরিবারই শুধু খাবে। এই আমি ও আমার মনোবৃত্তিই যে একদিন নিজের ভয়ানক বিপদ ডেকে আনে তা যখন বোঝার দরকার তখন বোঝানে না কেউ। বোঝে সময় হারিয়ে।
বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর উপর গ্রেনেড হামলা হয়েছে। এমএস কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। আইভী রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকাতেও খুন হয়েছে অনেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা।
সেদিন ক্ষমতার উন্মাদনায় ক্ষমতা হারানোর কথা ভাবতে পারেনি তারা। এখন যেমন আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতাও ভুলে গেছে ক্ষমতা হারানোর অসহায় দিনটির কথা। একসময়ে ক্ষমতার উন্মাদনায় মদমত্ত তারেক রহমান আজ ক্ষমতা হারিয়ে বিদেশে পলাতক আছে। সরকার যাকে দেশে আনতে চায় কিন্তু যিনি যে দেশে আসতে চায় না। এমন দেশের একটি রাজনৈতিক দল কেনইবা তাকেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বানালো? একটি রাজনৈতিক দল কতটা দেউলিয়া হলে একজন পলাতক আসামীকে দলের চেয়ারম্যান বানাতে পারে? খালেদা জিয়া তো দেশে আছেন। নেতাকর্মীদের মাঝেমাঝে তার সাথে দেখা করার সুযোগ রয়েছে। তারেক রহমানতো দেশেই নেই।তার সাথে দেখা করারও সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় বেগম খালেদা জিয়াই যদি দলের চেয়ারম্যান থাকতো তবে সমস্যা কি ছিল?
বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র পরিচয় ছাড়া তারেক রহমানের রাজনৈতিক কি প্রজ্ঞা রয়েছে? এতে কি দলে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়নি? বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করল। আবার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করলো। বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে কোন নির্বাচন নয়ও বলছে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য মনোনয়ন প্রতিযোগিতাতেও লিপ্ত রয়েছে তারা। স্ববিরোধিতা ও ভুলে ভরা অপরিপক্ক সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতাই হলো তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বানানো।
এই অপরিপক্ক ও ভুল সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় কোন ভবিষ্যতের পানে ছুটছে বিএনপি? ভবিষ্যতটা কেমন হতে পারে তা দৃশ্যমান করার দায়িত্বও অনাগত ভবিষ্যতেরই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)