চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কোনো একক স্কুলের প্রতি আমার দাসত্ব নেই: হাসান রোবায়েত

হাসান রোবায়েত, এই সময়ের কবি। আলোচিত কবি। একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার দ্বিতীয় বই ‘মীনগন্ধের তারা’। কবিতার প্রতি তার নিষ্ঠা চোখে পড়ার মতো। তিনি সন্ধান করেন নয়া ভাষার। নানান কারণেই তিনি আলোচিত-সমালোচিত। কবিতা, ভাষা প্রকরণ, আলোচনা-সমালোচনা ইত্যাদি নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে খোলামেলা কথা বলেছেন কবি।

কেমন আছেন?
ভালো আছি জামিল।

আপনার দ্বিতীয় বই প্রকাশ হলো। অভিনন্দন!
ধন্যবাদ।

প্রকাশনা নিয়ে কথা বলা যাক। প্রথম বইয়ের প্রকাশনা নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়েছিলো বলেই শুনেছি। আপনি খুশি ছিলেন না সব মিলে। এবার নতুন প্রকাশক থেকে বই আসলো। এটাও ১৫ তারিখের পর। সব মিলে প্রকাশনা বিষয়ক বিষয়-আশয় বা বিড়ম্বনা নিয়ে যদি বলেন…
‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’ [চৈতন্য, ২০১৬]। অর্থাৎ প্রথম বইটার প্রকাশনা-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। বইটা নানান কীর্তি-কাণ্ডের পর বেরিয়েছিল ২০১৬ সালে। সেবার ব্যাপক ভালোবাসা পেয়েছিল বইটা। কিন্তু দেখা গেল ২০১৭ সালের বইমেলায় বইটার অবিক্রিত কপিগুলো আর চৈতন্যের স্টলে রাখা হলো না। মেলা শুরুর আগে থেকেই প্রকাশককে ফোন করে আমি জানতে চেয়েছিলাম বইটা ‘১৭ এর মেলায় থাকছে কিনা! তিনি জানিয়েছিলেন ‘থাকবে’ কিন্তু রাখা হয়নি। তারপর প্রায় ১০ দিন পর আবার ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, বইটা থাকছে কিনা মেলায়! তিনি বলেছিলেন ২০ তারিখের পর থাকবে। কিন্তু রাখা হয়নি। এরপর আবার জানতে চেয়েছিলাম—তিনি আগের উত্তরই দিয়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বইটা সেবারের মেলায় আর ওঠেইনি। পরে উনার সাথে কথা বলে বাকি কপিগুলো আমি নিয়ে নিয়েছিলাম মেলার পরে। এবারের মেলায় ‘মীনগন্ধের তারা’ [জেব্রাক্রসিং, ২০১৮] ১৭ তারিখে এসেছে। সেটা নিয়ে অবশ্য আমার কোনো অভিযোগ নেই। প্রকাশক মাঝখানে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাজটা একটু বিলম্ব হয়। জেব্রাক্রসিং এর প্রকাশক দন্তন্য ইসলামের সাথে নিয়মিতই কথা হয়েছে। তিনি মন দিয়েই কাজটা করার চেষ্টা করেছেন।

দুইটা বই এখন আপনার। আপনার বই দুইটা গুরুত্ব পাচ্ছে। ‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের হয়েছে। ক্যামন লাগে? পশ্চিমবঙ্গে রেসপন্স ক্যামন?
পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমার বই এর ব্যাপারে সব সময়ই অভাবনীয় রেসপন্স পেয়েছি আমি। ভারতের অনেক পাঠক চেয়েছেন বইটা পড়তে। নানান সময় তারা আমাকে জানিয়েছেন সেসব কথা। বিশেষ করে ভারতের বাংলাভাষি তরুণ কবিরা ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছেন সব সময়। তারপর, প্রকাশনা সংস্থা ‘বৈভাষিক’ এর কাছ থেকে অফার পাই আমার বই ভারতে প্রকাশের ব্যাপারে। এভাবেই ‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’র পশ্চিমবঙ্গ সংস্করণ বের হয়। বইটা পড়ে বেশ কয়েক জন পাঠক তাদের ভালোলাগা-মন্দলাগা জানিয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে। কেমন লাগে! ভালো লাগে নিশ্চয়ই। বাংলা ভাষায় লেখা একটা বই পৃথিবীর নানান প্রান্তের বাংলাভাষিরা পড়ছেন এটা সুখকরই বটে।

স্মৃতি থেকে বলছি, আপনার প্রথম বই প্রকাশিত হবার পর একজন মন্তব্য করলেন কবিতাগুলো ছন্দে নেই। তো সেই সুত্রে আপনি বই প্রত্যাহারের কথা বলছিলেন। সেই প্রসঙ্গে যদি বলতেন..?
‘ছন্দে নেই’ এমন মন্তব্য করেছিলেন কিনা এখন আর মনে নাই। তবে বইটার শেষ কবিতা ‘ঘূর্ণ্যমান দেরাজের গান’ দীর্ঘকবিতা, ওটা কিন্তু ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে লেখা। সুতরাং ছন্দ নাই কথাটা মনে হয় ঠিক ছিল না। তবে, ঠিক কী কারণে অমন বলেছিলাম তার হেতুটা এখন মনে পড়ছে না। তবে, বেশ মেজাজ খারাপ করেই অমন ঘোষণা দিয়ে ছিলাম। ইম্ম্যাচিউর টাইপের ঘোষণা ছিল ওটা।

‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’ থেকে ‘মীনগন্ধের তারা’ এই মাঝের সময়টাতে আপনাকে অনেক বেশি পরিশ্রমী মনে হয়েছে। ভাষা ও প্রকরণের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এইদিকে মনোযোগী হবার পেছনে কি তাড়না কাজ করেছে?
মূলত আমি একটা ভাষার মধ্যে বাস করি। আমার চিন্তার সবকিছুই ভাষা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। তাই ভাষা তার সব দৈবচয়ন নিয়ে কীভাবে হাজির হতে পারে একটি টেক্সটে এবং তৈরি করতে পারে ইউনিক টেক্সচার- মূলত এ সবই আমাকে ঠেলে দেয় নতুন কিছু খোঁজার দিকে। আমার সমস্ত দ্বৈরথ তাই ভাষার সাথেই; আইডিয়ার সাথে নয়। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি ভার্সেটাইল প্রকরণে বিশ্বাস করি। কোনো একক স্কুলের প্রতি আমার দাসত্ব নাই। যেহেতু টেক্সটই পড়তে চাই আমি তাই সেইটা কোন স্কুলকে বিলং করে সেটা আমাকে বদার করে না। তাই, নানান প্রকরণে টেক্সটকে সাজাতে চেষ্টা করেছি।

হাসান রোবায়েতের প্রথম বই ‘ঘুমন্ত ফুলের মার্কারি’
হাসান রোবায়েতের প্রথম বই ‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’

আপনার যে দুইটা সমালোচনা করা হয় তার একটা হল দুর্বোধ্যতা আরেকটা হল ইসলামধর্মী-গন্ধী কবিতা। দার্শনিক দিক দিয়ে যেন একটু পেছনে ফিরছেন আপনি এমন অভিযোগ দেখা গেছে। এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
দেখেন, দুর্বোধ্যতা একটা আপেক্ষিক ফেনোমেনা। এটা একেক জনের কাছে একেক রকম। যে লেখাটা ‘ক’ এর কাছে দুর্বোধ্য সেটা হয়তো ‘খ’ এর কাছে সহজবোধ্য। তাই এই অভিযোগ নিয়ে আমি একদমই ভাবি না। সবাই সব ঘরানার লেখা পছন্দ করবেন না সেটাই স্বাভাবিক। আমি আমার টেক্সটই লিখতে চাই। কে সেটাকে কিভাবে দেখলো এটা তার ব্যাপার; একদমই আমার ব্যাপার না। ইসলামধর্মী-গন্ধী বাক্যটা খুবই পলিটিক্যাল। ইস্থেটিকসে এমন বাক্যের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। ধরেন, কেউ যখন সনাতন ধর্মের বিভিন্ন টার্ম ব্যবহার করেন তাকে কি ‘সনাতনধর্ম-গন্ধী’ বলা হয়? সম্ভবত না। ইসলাম ধর্ম-গন্ধী আপনি তখনই বলতে পারেন যখন কোনো টেক্সট মিশনারির কাজ করে। ধর্ম-প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে যে টেক্সট লেখা হয়। কিন্তু যদি আপনার জন-সংস্কৃতির টুলসকে আপনি টেক্সটে ব্যবহার করেন সেইটা কিন্তু কেবলই টেক্সট। কোনো গন্ধী-টন্ধির ট্যাগ তাতে লাগানোটা কাইন্ড অব হীনম্মন্যতা। এই ধরনের প্রোপাগান্ডা কেন চালানো হয় তা আমি বুঝি। তথাকথিত বাঙালি মুসলিম [জন্মসূত্রে] বুদ্ধিজীবীদের কেবল বইপত্র-বেইজড জ্ঞানের কারণে এইটা হয়। সম্ভবত তারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের নার্ভ রিড করতে পারেন না। দার্শনিক দিক থেকে এটা পেছনে ফেরা নয়। সম্ভবত মোর পলিটিক্যাল হয়ে ওঠা। একজন কবি তো মোর পলিটিক্যাল দ্যান আ পলিটিশিয়ান।

‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’ ও ‘মীনগন্ধের তারা’র পার্থক্য বা সিমিলারিটির জায়গাটা কী কী?
পার্থক্যটার উত্তর আপনার প্রশ্নেই আছে। প্রকরণের দিক দিয়ে অবশ্যই ‘মীনগন্ধের তারা’ আলাদা ‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’র থেকে। আর সিমিলারিটি হলো, আমি যে ভাষা ও ইমাজিনেশনের জগত নিয়ে কাজ করি। সেটাকেই স্টাব্লিশ করতে চেয়েছি। আমি এটাকে বলি ‘কার্ভড রিয়ালিটি’।

যারা পড়বে তাদের কথা ভাবা বা দায়বোধ করা কবির বিশেষ দায়িত্ব না। কিন্তু ‘মীন গন্ধের তারা’র শেষ পৃষ্ঠায় আপনি তিনটা কবিতা নিয়ে নোট দিলেন। তর্জমা করে দিলেন। এই যে দায়টা নিলেন, কেন?
এটা আসলে নতুন কিছু না। এলিয়টের কবিতার বইতেও এমন টীকা ছিল। আমি তো টীকাও দিইনি, কেবল কোরানের কয়েকটা আয়াতের অর্থ আর সোর্স উল্লেখ করেছি। আসলে কবিতাগুলো যখন পত্রিকায় ছাপা হয় তখন ইন্ডিয়ার অনেককেই আয়াতের অর্থ জানতে চেয়েছিলেন। যদিও তা না জানলেও কোনো সমস্যা ছিল না। তবুও দিলাম। এটা আসলে দায়বোধ না ঠিক। বইয়ের টেক্সট কিভাবে সাজানো হবে, তার জার্নিটা কেমন হবে তারও অংশ।

আপনি নিজের কবিতা নিয়ে নিজে গদ্যও লিখলেন। কেন?
আমার ইস্থেটিকস নিয়ে আমি লিখতে চাই। আমি কবিতাকে কীভাবে দেখি, সেই কনসেপ্ট কেমন! এসব প্ররোচনা থেকেই মূলত গদ্য লেখা। একটা নতুন ডিকশনের জন্য এই কাজটা জরুরি মনে হয়।

‘মীন গন্ধের তারা’ নিয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই। কবিতাগুলো নিয়ে বলুন। কবিতার ভাষা প্রকরণ বা আপনার কাছে হয়ে উঠা নিয়ে…
মন্তব্য অবশ্য আমিই জানতে চাই। হা হা। কবিতাগুলো নিয়ে রিয়েলি বলার কিছু নাই। তবে, একটা আনকোরা ভাষাভঙ্গি নিয়ে আমি আমার ইমাজিনেশনকে লিখতে চেয়েছি। এই টেক্সটগুলো সাম্প্রতিক সময়ে ভুলভাবে রিড হবার সম্ভাবনাই বেশি। আরও সময় দেওয়া দরকার টেক্সটগুলিকে। হয়তো, অনেক কাল পরে এসব লেখা তার পূর্ণ টেক্সচার নিয়েই হাজির হবে।

ধন্যবাদ
আপনাকেও ধন্যবাদ

মীনগন্ধের তারা
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
প্রকাশক: জেব্রাক্রসিং