চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

কোটা বনাম মেধা: চলমান বিতর্ক, ভ্রান্তি ও বাস্তবতা

‘কোটা বনাম মেধা’ বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে বেশ কিছুদিন যাবত। আমার মনে হয় উর্ধ্বকমা যুক্ত শব্দত্রয়ীর মাঝের ‘বনাম’ শব্দটিই আসলে যত বিতর্কের মূলে। বিভ্রান্তিও ছড়াচ্ছে ওই একটি শব্দই। এই শব্দটির কারণেই কোটা থাকা মানেই মেধাহীন এবং কোটা না থাকা মানেই মেধাবী এমন একটা অমূলক ধারণা কতিপয়ের মাঝে বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে।

‘আমরা মেধাবী, আমরা মেধাবী’ বলা অনেককেই দেখেছি কতটা অন্ত:সারশূন্য। পরীক্ষার আগের রাতে হাতে প্রশ্ন ধরিয়ে দিলেও পাস করে আসতে পারবে কিনা সন্দেহ। আবার কোটা সুবিধা পাওয়া অনেককেই দেখেছি তাদের কোন সুবিধা না দেওয়া হলেও তারা নিজের যোগ্যতায়ই যে কোন পরীক্ষায় উৎরে যাবেন।

কোটা সংস্কারের কথা উঠলেই কথিত মেধাবীরা অযথা কোটা সুবিধা পাওয়াদের আক্রমন করে নিজেদের যৌক্তিক দাবিকেই বরং বিতর্কিত করে তোলে। আর নিজেদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেয় কোটাসুবিধার আওতায় থাকার কারণে অনেক প্রকৃত মেধাবীরাও অযথা আক্রমন হজম করতে বাধ্য হন।

আরেকটা পক্ষ আছে যারা কিছু না জেনে না বুঝেই কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেয়। যেটা আসলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রকৃত অবস্থা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার কূটকৌশল ছাড়া কিছুই নয়।

কতিপয় কুলাঙ্গার স্বাধীনতাবিরোধী/রাজাকার ছাড়া ৭১ এ সবাই যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়ে কোন না কোনভাবে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সহায়তা করেছেন সে কথা সবাই যেমন জানেন, তেমনি অনেক প্রাজ্ঞ লোকই প্রকাশ্যে বলেন। সুতরাং যারা বলেন সংস্কারের দাবি মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা, আপনারা নিজেরাও জানেন আপনাদের দাবি কতটা ভিত্তিহীন।

‘পজিটিভ ডিসক্রিমিনেশন’ বলে একটা টার্ম আছে যেখানে বৃহত্তর সমতা অর্জনের জন্য রাষ্ট্র অনগ্রসর সম্প্রদায়কে বিশেষ সুবিধা দিয়ে অগ্রসরদের কাতারে নিয়ে আসার চেষ্টা করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সিস্টেমের কার্যকারিতা নিশ্চয়ই রয়েছে। তবে সিস্টেমটিকে হতে হবে ডায়নামিক। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় পর পর পুনর্মূল্যায়ন করে দেখতে হবে যে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে আসলে এটা কতটা কাজে আসছে বা আসলেই অনগ্রসর শ্রেণি সুবিধাটা পাচ্ছে কিনা, নতুন করে কেউ এই সুবিধার আওতায় আসতে পারে কিনা, সুবিধাপ্রাপ্ত কোন জনগোষ্ঠীর এ সুবিধা নেওয়ার প্রয়োজনীতা ফুরিয়েছে কিনা ইত্যাদি। কিন্তু স্থায়ী রূপে এ ব্যবস্থা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে থাকলে উল্টোপথে আবার নেগেটিভ ডিসক্রিমিনেশনও তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে এটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্ষোভেরও কারণ হয়ে উঠতে পারে।

এই টার্মের সঙ্গে সম্পূরক একটি প্রশ্ন এমন যে, কোটা সুবিধা নিয়ে একজন সচিব হয়েছেন। এখন তার ছেলেও কোটা সুবিধা পাচ্ছেন। তার মানে কি পদসোপানের সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছেও তিনি অনগ্রসর শ্রেণিতেই রয়ে গেছেন?

দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে সেখানে মেধা তালিকায় থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিয়ে পূরণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এতে অনেক বেকার এবং তার পরিবারের মুখে যেমন হাসি ফুটবে, তেমনি রাষ্ট্রযন্ত্রও হবে গতিশীল।

সুতরাং সরকারের কাছে অনুরোধ, গণদাবিতে পরিণত হওয়া তারুণ্যের আন্দোলনের প্রতি ন্যুনতম নজর দিয়ে হলেও কোটা সংস্কারে হাত দিন। তখন বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণে যদি মনে হয় কোন কোন ক্ষেত্রে কোটা আরও বাড়ানো উচিত তবুও হাত দিন। তাতে তারুণ্যের চাওয়া এবং রাষ্ট্রযন্ত্র উভয়ই উপকৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)