‘মা’ শব্দটি মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক মমতাময়ী রুপ। যিনি তার সন্তানদের সকল সময় আগলে রাখেন পরম মমতায়। সন্তানদের খাওয়া-ঘুম থেকে শুরু করে পড়ালেখা’সহ প্রায় সবকিছুই মায়ের ডিপার্টমেন্ট। এমন মায়েদের বাইরেও রয়েছে কিছুটা অন্যধরণের মা। প্রচলিত স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও তাদের রয়েছে অতিরিক্ত কিছু চ্যালেঞ্জ।
ওইসব মায়েরা ২৪ ঘণ্টা সংসারে সময় দিতে না পারলেও তাদের কর্মক্ষেত্র, সংসার সফলভাবে সামলে চলেছেন। মানসিক বা শারীরিকভাবে কোন ক্লান্তি নেই তাদের। নানা চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিয়োজিত এ মায়েরা। মেধা, কর্ম, মনন, সৃজনশীলতা, মাতৃত্ব সব দিক দিয়েই তারা শ্রেষ্ঠ।
মা দিবস উপলক্ষ্যে চ্যানেল অাই অনলাইনকে ওইসব মায়েদের প্রতিনিধিত্ব করা কয়েকজন গর্বিত নারী জানিয়েছেন তাদের কর্ম-সংসারসহ নানা কথা।
মা যখন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা:
মাহমুদা শারমীন নেলী, পুলিশের মতো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিয়োজিত এই মা। একমাত্র সন্তান যারীন সুবাহ সুহা’র বয়স ৬ বছর। সন্তান জন্মের পরপরই শুরু করেন বিসিএসের প্রস্তুতি। ৩৪তম বিসিএসে সফল হয়ে যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে। সুহা’র বয়স যখন সাড়ে ৩ বছর তখন যোগ দেন পুলিশ একাডেমি সারদার বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে। সেই ১ বছর মেয়ে সুহা’কে ছেড়ে দুরে থাকা অনেক বেশি কষ্টের হলেও মেয়েই ছিলো সেসময় তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
অসুস্থ হলে শত কষ্টের মাঝে একদিনও বিরত থাকেননি ট্রেনিং থেকে শুধু মেয়ের কথা ভেবেই।
এ বিষয়ে নেলীর বলেন: ‘একটা দিন অসুস্থ থাকায় ট্রেনিং করতে না পারা মানে সেই একদিন আমি আমার মেয়ের কাছ থেকে দুরে থাকবো। আর তাই শত কষ্টের মাঝেও ৩৬৫ দিনের মাঝেই সম্পন্ন করেছি প্রশিক্ষণ।’
লেখাপড়া, কর্মক্ষেত্র, পরিবার সকল ক্ষেত্রেই সফল এ পুলিশ কর্মকর্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছেন।
২০০৬ সালে নিজ মাকে হারানো এ পুলিশ কর্মকর্তা মায়ের কাছ থেকে যা আশা করতেন সেই ক্ষেত্রটা তৈরি করতে চান নিজের মাঝে। যা পাননি তার সবকিছুই মেয়েকে দিতে চেয়েছেন। এজন্য তার চেষ্টাটাও আপ্রাণ।
অফিসের ফাঁকে ফাঁকে দেখে আসেন মেয়েকে। নিজ হাতে চেষ্টা করেন মেয়েসহ পরিবারের সবাইকে রান্না করে খাওয়াতে। নেলীর চাওয়া তার মা যেমন তার আদর্শ ছিলেন তার মেয়েও ঠিক তার মাকে তেমনই আদর্শ মেনে এগিয়ে যাক সামনের দিকে।
জনগণের সুস্থতাসহ পরিবারের দায়িত্ব যার:
ছাবিকুন নাহার, পেশায় চিকিৎসক। পড়াশুনা, চাকরি, সন্তানের দেখভাল সব করে চলেছেন নিপুণ হাতে। বিয়ের আগেই হারিয়েছেন শ্বশুর-শাশুড়ি’কে। আর তাই সেখান থেকে সমর্থন দেয়ার মত পাননি কাউকে।
অল্প বয়সে বিয়ে, পড়াশুনা, চাকরি সব মিলিয়ে অত্যন্ত প্রতিকূল সময় পার করতে হয়েছে ছাবিকুন নাহারকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পর পর দুটো সন্তানকেই জন্মের আগেই হারিয়েছেন। তবে স্বামীর সহযোগিতা ও নিজের আত্মবিশ্বাসে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। আত্মপ্রত্যয়ী এ নারী গর্ভাবস্থায়ই সফলভাবে সম্পন্ন করেন এফসিপিএস পার্ট ওয়ান। সফল হন ৩০তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে।
বর্তমানে কর্মরত আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগের মেডিকেল অফিসার হিসেবে। পাশাপাশি কাজ করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমির প্রভাষক হিসেবে।
সফল এ জননী বর্তমানে দু’সন্তানের মা। বড় ছেলে আহনাফ সাদিদ অহন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র । কর্মক্ষেত্রে সুচারুরুপে দায়িত্ব পালনের পর চেষ্টা করেন পরিবারকে সময় দিতে। ছোট সন্তান আরনাফ রাদিদ মিহন এখনো পর্যন্ত মায়ের কাছেই পড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সংসার কর্মক্ষেত্র সামলাতে প্রথম প্রথম কিছুটা বেগ পেলেও এখন সামলে উঠেছেন অনেকটাই। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক স্বামী মো. আবুল কালাম আজাদের অবদানও কোন অংশে কম নয়।
জনগণের সুস্থতার দায়িত্বসহ সবকিছু সামলে তিনি এখন একজন সফল মা এবং একজন সফল নারী।
প্রশাসন থেকে সংসারে সবখানে তিনি:
আয়েশা সিদ্দীকা, কর্মরত আছেন ঢাকার মিরপুরের এসিল্যান্ড হিসেবে। ৩১তম বিসিএসের মাধ্যমে যোগ দেন প্রশাসন ক্যাডারে। ৪ বছরের ছোট্ট শ্রেয়সী সুভাষিনীর গর্বিত মা তিনি। শরীয়তপুরের মেয়ে আয়েশা ছোট থেকেই পড়ালেখায় ছিলেন অন্য অনেকের থেকে এগিয়ে। ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করেন তিনি। ভেতরে সবসময়ই ছিলো ভালো কিছু তাকে করতেই হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেই অবস্থান থেকেই তার কর্মক্ষেত্রে যোগদান।
সেসময় ৫ মাস বয়সী ছোট্ট শ্রেয়সী’কে নিয়ে যোগ দেন চাকরিতে। একজন গৃহকর্মী, আয়েশা আর ছোট্ট মেয়েকে নিয়েই ছিল তার পরিবার।
ছোট্ট মেয়েকে রেখেই পালন করেছেন মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ পেশাগত সকল দায়িত্ব। তবে সেসময়ে সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বারবার।
পারিবারিকভাবে খুব বেশি সমর্থন না পেলেও দমে যাননি অদম্য এ নারী। আত্মনির্ভরশীল, আত্মবিশ্বাসী এই মা সবসময়ই চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করেই সন্তানকে গড়ে তুলতে।