সাংবাদিক রাজু হামিদ এই শিরোনামে একটি অনলাইন আড্ডায় আমন্ত্রণ জানালেন। সত্যিই তো, রাষ্ট্রের নামই যখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, তখন সে দেশের নাগরিকদের ‘প্রজা’ বলায় ক্ষতি কী!
করোনা মোকাবেলায় ‘রেড জোন’ ঘোষিত দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ লকডাউন এলাকা রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দা আমরা। আদতে ১৮ মার্চ থেকেই ব্যক্তিগতভাবে এবং ২৬ মার্চ থেকে সরকারিভাবে লকডাউনে আছি। যদিও সরকারি ভাষায় সেটি ছিল ‘সাধারণ ছুটি’। সেই ছুটি শেষে যখন গণপরিবহন চলাচল এবং জীবনযাপন স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া শুরু হলো, তার ঠিক ৮ দিন পরেই ৯ জুন মধ্য রাত থেকে রাজধানীর ফার্মগেট-পান্থপথ-গ্রিন রোড সংলগ্ন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের এই রাজাবাজার এলাকায় পূর্ণাঙ্গ লকডাউন শুরু হয়েছে। ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির সময়ে ঢিলেঢালা ভাব থাকলেও এবার আক্ষরিক অর্থেই এই এলাকায় পূর্ণাঙ্গ লকডাউন চলছে। বিশাল রাজধানী শহরের ছোট্ট এই এলাকায় হাজার চল্লিশেক মানুষের বাস। কিন্তু এখানে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩০ জনের বেশি। তাছাড়া প্রবেশ ও বহির্গমনে ৮টির মতো গেট থাকা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের চলাচল এবং সর্বোপরি ব্যবস্থাপনার সুবিধার কথা মাথায় রেখে অনেকটা কারফিউ স্টাইলের এই লকডাউন শুরু হয়। বলা হচ্ছে এটি পাইলট বা পরীক্ষামূলক। এখন প্রশ্ন হলো, লকডাউনে আমরা রাজাবাজারের প্রজারা আসলেই কেমন আছি?
চাকরিজীবীদের সমস্যা:
১. আমাদের এক প্রতিবেশী দম্পতি সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগসে চাকরি করেন। যে কোম্পানির ওষুধ সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়। তার মানে ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মতো এসেনশিয়াল ড্রাগসের এই কর্মীরাও জরুরি সেবার আওতায় পড়েন। কিন্তু লকডাউনে বাস্তবায়নে দায়িত্বরত পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের বের হতে দেননি। বলেছেন, তাদের কাছে ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়া আর কাউকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়ার নির্দেশনা নেই।
২. একটি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের একজন মধ্যম স্তরের কর্মীকে দেখা গেলো অফিসে যাওয়ার অনুমতির জন্য গেটে এসে পুলিশকে অনুরোধ করছেন। তিনি অনুমতি পাচ্ছেন না। কিন্তু অফিস থেকে তাকে বলা হয়েছে, যেভাবেই হোক অফিসে যেতে হবে। না হলে চাকরির অসুবিধা হবে। বিষয়টি নিয়ে তিনি রাজাবাজারে সংবাদ কাভার করতে আসা একজন টেলিভিশনের সাংবাদিকের সাথেও কথা বললেন। সাংবাদিক তাকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। তিনি জানান, কয়েকজনকে টেলিফোন করেছেন। কিন্তু কেউ ফোন ধরেননি।
৩. সরকারি নির্দেশনা রয়েছে যে, রেড জোনভুক্ত এলাকার কোনো বাসিন্দার যদি অন্য এলাকায় অফিস হয়, তাহলে তিনি সেখানে যাবেন না এবং এ কারণে তার চাকরির কোনো সমস্যা হবে না বা তার বেতনও কাটা যাবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, খোদ সরকারি এবং দেশের স্বনামধন্য অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠানও এই বিষয়টি উপেক্ষা করে তাদের কর্মীদের অফিসে যেতে বাধ্য করছে এবং না গেলে এই অনুপস্থিতি ছুটি হিসেবে গণ্য করছে।
মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ:
লকডাউন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামও চ্যানেল আইয়ের ‘টু দ্য পয়েন্ট’ অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, রেড জোনের কোনো বাসিন্দা যদি অফিসে যেতে না পারার কারণে সমস্যায় পড়েন, তাহলে সেই সমস্যা সমাধানে তিনি নিজে উদ্যোগী হবেন। আমি পূর্ব রাজাবাজারের একজন বাসিন্দা এবং গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে, এই এলাকার সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মীই এখন অফিসে যেতে না পারার কারণে সমস্যা পড়ছেন। দয়া করে এ বিষয়ে আপনি সুদৃষ্টি দেবেন।
দোকানদারদের সংকট:
আমাদের বাসার নিচেই বড় মুদির দোকান। লকডাউনের দ্বিতীয় দিন দুপুরে দেখলাম দোকানের এক কর্মচারী মুখে মাস্ক পরে বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী রমজান, দোকান বন্ধ, তো দাঁড়ায়া আছো ক্যান?’ সে বললো, ভেতরে দোকান পরিস্কারের কাজ চলছে। তার মানে লকডাউনের সুযোগে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজ চলছে। কিন্তু এই দোকানের ইতিহাসে একটানা দুই বা তিন সপ্তাহ দোকান বন্ধ রাখার অভিজ্ঞতা এটিই প্রথম। সুতরাং একটানা এতদিন দোকান বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হবে, সেটি পুষিয়ে নিতে সরকার কী সহায়তা দেবে, তা নিশ্চিত নয়। লকডাউন শেষ হওয়ার পরে ওই মাসের দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল ও অন্যান্য খরচ তো দোকানদারকে ঠিকই শোধ করতে হবে। লকডাউনভুক্ত পুরো রাজাবাজারে এরকম দোকানদারের সংখ্যা অনেক।
খাবার-দাবারে সমস্যা নেই:
যেহেতু লকডাউনভুক্ত এলাকা থেকে ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়া কাউকেই ঢুকতে বা বেরোতে দেয়া হচ্ছে না এবং যেহেতু দোকানপাট সবই বন্ধ—ফলে এই এলাকায় প্রতিদিন সকালে খাদ্যপণ্যবাহী নির্ধারিত ট্রাক আসে। এ সময় মাইকিং করা হয়। এলাকার লোকজন গিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেন। ট্রাকে চাল-ডাল-মাছ-মাংস-সবজি, সবই আছে। ফলে স্বচ্ছল মানুষের খাদ্য সংকট হওয়ার শঙ্কা নেই। যদিও অনেকেই লকডাউন শুরুর আগের দিনই দু তিন সপ্তাহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন চাল-ডাল-আলু-পিঁয়াজ-তেল-লবণ-আটা-চিনি-মাছ-মাংস-সবজি, ইত্যাদি কিনে রেখেছেন। তবে গরিব এবং যারা দিনের আয়ের উপরে নির্ভরশীল যেমন ক্ষুদ্র দোকানদার বা এরকম পেশার সাথে যুক্ত, তাদের ঘরে বিনামূল্যে খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। তাছাড়া লকডাউন শুরুর দুতিন দিনেই বোঝা যাবে না যে, কারো বাসায় আসলেই খাবার সংকট হয়েছে কি না বা খাবার সরবরাহে কোনো জটিলতা আছে কি না? এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো অভিযোগ মেলেনি।
করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা:
পূর্ণাঙ্গ লকডাউনে রাজাবাজার এলাকার মানুষের সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয়েছে এই যে, এখানে নাজনীন স্কুলের ভেতরে করোনা পরীক্ষার একটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে অন্য এলাকার মানুষেরা যেখানে দিনের পর দিন ঘুরেও করোনা পরীক্ষার সিরিয়াল পাচ্ছেন না, তখন এই লকডাউনভুক্ত এলাকার মানুষেরা নির্ঝঞ্ঝাটে নমুনা পরীক্ষা করাতে পারছেন। জানা গেছে, প্রথম দুদিনে এখানে ৩২ জন করোনার নমুনা দিয়েছেন।
আগে থেকেই এটি পরিস্কার করে বলা ছিল যে, কোনো যানবাহন ভেতরে প্রবেশ করবে না বা বেরও হবে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল, কেউ অসুস্থ হলে বা কাউকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন হলে কী ব্যবস্থা? তখন জানানো হলো যে, এরকম পরিস্থিতিতেও অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করতে পারবে। প্রথম দুদিনে বাসার ব্যালকনি থেকে একাধিকবার অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করতে দেখেছি। দুঃখজনক হলো, লকডাউনের দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার সকালে করোনায় আক্রান্ত একজনকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। তাকেও অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে গিয়েছিল।
মানুষ বেরোতেই চায়:
প্রথম দিন সকালেই অনেক লোককে দেখা গেছে অফিসে যাওয়ার জন্য তারা গেটে গিয়ে আটকে গেছেন। কারণ তাদের অনেকের কাছেই বিষয়টি পরিস্কার ছিল না যে ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়া অন্য কাউকে বেরোতে দেয়া হবে না। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনেও অনেকে এভাবে বেরোতে চেয়েছেন। প্রত্যেকেই জরুরি কাজের কথা বলেছেন। ফলে কোথাও কোথাও দেয়াল টপকে, আবার কোথাও বাঁশের বেড়ার নিচ দিয়ে বেরিয়ে গেছেন—এরকম ছবিও গণমাধ্যমে এসেছে। কেউ কেউ স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় বেরিয়ে গেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কতটা কাজে দেবে এই লকডাউন?
১. রাজাবাজারে লকডাউনের এই পরীক্ষা দুই থেকে তিন সপ্তাহ চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সময়ে এই এলাকায় ওষুধের দোকান ছাড়া সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। যানবাহনও বন্ধ। ফলে পুরো এলাকায় এখন সুনসান নিরবতা। প্রশ্ন হলো, এই এলাকার বাসিন্দা যেসব ডাক্তার-নার্স-সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য প্রতিদিন কর্মস্থলে যাচ্ছেন আসছেন—তারা বাইরে থেকে যে করোনাভাইরাস শরীরে বহন করে আসবেন না এবং সেই ভাইরাস পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এবং আবার যখন বাইরে যাবেন তখন বাইরে অন্য কারো শরীরে সংক্রমিত করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?
২. দুই বা তিন সপ্তাহ লকডাউনের ফলে রাজাবাজারে হয়তো করোনাভাইরাস আর খুব একটা সংক্রমিত হবে না বা নতুন রোগী শনাক্ত হবে না। কিন্তু এই সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিশাল অংশ যে আনলকড থাকলো, সেখানে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা? বিচ্ছিন্নভাবে আরও কয়েকটি জায়গায় লকডাউন করা হচ্ছে বটে, সেটি আখেরে সমস্যা সমাধানে সামগ্রিকভাবে কতটা সুফল বয়ে আনবে?
৩. বাংলাদেশের মতো বিশাল জনগোষ্ঠীর এবং অতি জনঘনত্বের দেশে একসাথে একটানা দুই বা তিন সপ্তাহ কারফিউ স্টালে পূর্ণাঙ্গ লকডাউন করে রাখা আদৌ বাস্তবসম্মত? যদি সেটি সম্ভব না হয়, তাহলে করোনাকে কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে? নাকি এই ভাইরাসকে সঙ্গী করেই আমাদের দীর্ঘদিন থাকতে হবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)