‘আমার চার দেয়ালের ঘরে ছোট একটি জানালা। কখনও খুলিনি। একদিন মনে হল খুলে দেখি। খুললাম, দেখি বিশাল এক আকাশ। ইচ্ছে হল আকাশ ছুঁতে, পারলাম না। বন্ধ করে দিলাম জানালা। আবার যখন রাত নেমে এলো মনে হল, এখন দেখি আকাশ কেমন? দেখি সারা আকাশে জোছনার আলো আর তারারা সে আলোতে হাসছে। মনটা আমার ভিজে গেল চাঁদের আলোতে। ঘরের দরজা খুলে সবুজ মাঠে মন ভিজাতে চাইলাম, হল না। কারণ আমি এ ঘরে বন্দী। আমার কোনও নন্দিনী নেই, যে আমাকে নিয়ে যাবে ঘরের বাইরে। তাই চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিলাম জানালা।
তারপর আপন মনে সাজাতে লাগলাম আমার পৃথিবী। সে এক অন্য রকম পৃথিবী। যেখানে আছে আমার ভাল লাগা কিছু স্বপ্ন, আছে নিজের ভালবাসার আপন রূপ। এমনি করে ধীরে ধীরে ‘নিজেরই অজান্তে আমি হলাম ‘আমার আমি।’
কাব্যিক হলেও এ কথাগুলো কোন নারীর নতুন জীবনের আলাপন নয়। এ শুধু তার জীবনের সুপ্ত বাসনা। তবে জীবন স্রোতে ভাসতে ভাসতে নারী হারিয়ে ফেলে নিজেকে। কারো স্ত্রী, কারো মা হয়ে নিজেই নিজের কাছে অচেনা এক মানুষ হয়ে যায়। ভুলে যায় সেও একজন মানুষ।
আসলে গল্প কোনদিন জীবন হয় না। জীবন থেকেই গল্প হয়। তাই হয়ত লেখকরা সমাজের মানুষের মাঝে খুঁজে জীবনের বোধকে। অচেনা নামের এক নারীর নতুন করে বাঁচার সে কথাগুলো বলে দিলো; ‘নিজেকে জানতে হলে নিজের জন্য বাঁচতে হবে।’
নারী স্বাধীন হয়ে কতটা পরাধীন তা কেবল সে নিজে জানে। পরিবার সমাজের নিয়ম নীতির অনিয়ম হলে নারীকে সইতে হয় যন্ত্রণা। আর আধুনিক কালে নারী নিজের কথা বললে তারে বলে ‘নারীবাদী’। কিন্তু পৃথিবীতে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে নিজের মত করে বাঁচার। তবে সে অধিকারটা নারীদের বেলায় মানতে চায় না পুরুষ শাসিত পরিবার-সমাজ। তাই এ সমাজে কত নারী নিজের মত করে বাঁচার স্বপ্নকে শেষ করে দেয় তার ইয়ত্তা নেই।
আর যে প্রতিবাদ করে তাকে হয়তো বিসর্জন দিতে হয় সংসার নামের চার দেয়ালের ঘরটি। যেখানে সম্পর্কের বাঁধনটা বড় আলগা। লোক দেখানো ভালোবাসার খেলাতে নিজের আপন সত্ত্বাটিকে হারিয়ে বাঁচার কোন অর্থ হয় না- এ উপলব্ধিটা হয়েছিল অচেনার। তাই সে কেবল নারী নয় একজন মানুষ হিসাবে গড়েছে আপন পৃথিবী। পেয়েছে নিজের ঠিকানা।
‘ আমার আমি ‘ -এ আমিটাকে আবিষ্কার করতে গিয়ে অচেনাকে যে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়া করাতে হয়েছে, তার অন্তরালে রয়েছে কেবল বিসর্জন।.সে হারিয়েছে বৈষয়িক অনেক কিছু। কিন্তু পেয়েছে পরমাত্মার সান্নিধ্য। না এটা কোন বৈরাগ্য জীবন নয়। বরং এটা সংসারের অংকটা কাটাকাটি করে সরল পথে চলার সিদ্ধান্ত কেবল। নারীও মানুষ,তার ও নিজস্ব সত্ত্বা আছে এটা বুঝতে চায় না সমাজ, পরিবার। তাই জটিলতা আসে দাম্পত্য জীবনে। আর সেক্ষেত্রে দোষটা বেশির ভাগ পড়ে নারীর উপরে।
সমাজের আট দশটা মেয়ের মত অচেনার জীবনেও শৈশব কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে প্রেম এসেছিল। তারপর বিয়ে সংসার এ নিয়েই বেশ চলছিল। শুধু জৌলুষ আর বিলাসী সোসাইটি, পরিবারের কাছে নিজের পরিচয়টা হারিয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ। বাবার দেয়া অচেনা শারমিন নামটা পালটে গিয়ে কাগজে কলমে হলো অচেনা চৌধুরী। আর সবাই চিনতেন মিসেস চৌধুরী নামে। আসলে এটাই এ সমাজের রীতি। মেয়েরা যতই যশ খ্যাতি অর্জন করুক না কেন স্বামীর পরিচয়টা হলো সবচেয়ে বড় সীল।
যুগ পাল্টাচ্ছে কিন্তু মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি। আর সে কারণে ডিভোর্সি বা সিঙ্গেল উইমেন বিষয়টাকে সাধারণ ভাবে নিতে পারে না এখনো মানুষ ।
সংসারের নিয়মকে সে উপেক্ষা করিনি। বরং মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা ছিল নিরন্তন। কিন্তু সে সাথে নিজের ভেতরে সত্ত্বাকে প্রতিটা মুর্হূতে গলা টিপে হত্যা করছিল প্রতিনিয়ত।
সৌরভের কাছে ভালোবাসাটা হয়ে গেলো রুটিন মাফিক জীবনের অংশ। ভার্সিটি জীবনের সৌরভকে সে খুঁজে পেতাম না সংসারের নিত্যকার দিনে। অচেনার জন্য সৌরভের সময়ের বড় অভাব। নিয়ম করে বছরে দুবার বিদেশে ঘুরতে যাও, মেয়ের স্কুল, পার্টি, ক্লাব আর পরিপাটি করে ঘর সাজানোই অচেনার কাজ। আর সাজানো সে ঘরে অচেনা যেন সৌরভের মনের মত করে সাজানো এক পুতুল। বলা যায় অন্য সব শো পিসের মত আর একটা শো পিস।
কিন্তু সৌরভ আর অচেনা এমন ভালোবাসার ঘরের স্বপ্ন দেখিনি। আসলে নজরুলের ‘ স্বপ্নে দেখি একটি নতুন ঘর,তুমি আমি দুজন প্রিয়’ – এমন ঘর বাস্তবে হয় না। তাই বিয়ের পর কিছুদিন যেতেই সব বদলে গেল। সৌরভ এখন আর নীল আকাশ দেখে কিংবা সমুদ্রের পাড়ে কনে দেখা আলোতে নিজেদের মনের কথা জানতে চাইত না। তার কাছে ভালোবাসার প্রকাশের মাধ্যম হলো, অচেনাকে বিশেষ বিশেষ দিনে দামী দামী গিফট দেয়া। ক্লাব পার্টিতে লোক দেখানো প্রেম। আর পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোতে আলাপন তার কাছে ছেলেমানুষি আবেগ। তার চেয়ে অন্ধকার ঘরে শরীরের খেলাটাই ছিল বেশি উপভোগ্য। সেখানে অচেনার অনুভূতি বড় মূল্যহীন। নিজের চাহিদাটুকু মিটিয়ে নিতে পারাতেই সৌরভের সুখ।
সংসার নামের এমন বন্দীশালা থেকে অচেনা নিজের মত করে বাঁচতে চাওয়াতে তাদের জীবনে ঝড় উঠে।
মিসেস চৌধুরী থেকে অচেনা শারমিন হয়ে বাঁচতে চাওয়াটাকে মানতে পারেনি সৌরভ চৌধুরী। ৩০ বছরের চেনা সৌরভকে বড্ড অপরিচিত মনে হলো তখন । স্বামী সন্তান সবাই সবার জগতে ব্যস্ত। তাদের কাছে অচেনার ভালোবাসা, আদর প্রেম বা চাওয়া পাওয়ার কোন মূল্য নেই।
খুব বেশি কিছু নয়, সে কেবল তার মত করে বাঁচার জন্য একটা স্বপ্ন দেখেছিল। সংসারের দায় চুকিয়ে কিছু অনাথ ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে পাহাড় আর সমুদ্রের কাছে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করে থাকতে চেয়েছে। জায়গাটা তার বাবার দেয়া। কিন্তু সৌরভ নাকি সেখানে রিসোর্ট করার পরিকল্পনা করেছে। কারণ ব্যবসায়িকভাবে লাভের চিন্তা না করে এমন জায়গাতে স্কুল আশ্রম করা কথা চিন্তা করা বোকামি।
অচেনার এ স্বপ্ন তাদের কাছে মনে হলো আবেগী মনের পাগলামি। কিন্তু পৃথিবীতে কিছু মানুষতো তার আবেগ নিয়ে বেঁচে থাকে। অনেকক্ষেত্রেই সে আবেগ বাস্তবের কাছে পরাজিত হয়। কিন্তু অচেনা সৌরভ আর ছেলের বাস্তবের কাছে হার মানতে পারিনি।
তার নিজের ভেতরের আমিটা ২৫ বছরের সংসার জীবনে প্রতিবাদ করলো। সিদ্ধান্তে অনড় থেকে সংসার থেকে মুক্তি নিলো অচেনা । যদি ও সৌরভ কাগজে কলমে মুক্তি দেয়নি। তবু সব কিছু উপেক্ষা করে সৌরভের সাজানো ঘরের দম দেয়া প্রাণহীন অচেনা চৌধুরী নামের পুতুলটা বিত্ত বিলাস বিসর্জন দিয়েছে। নতুন জীবনের সন্ধানে অচেনা নিজেকে পাহাড় ঘেঁষা বিশাল সমুদ্রের কাছে সর্মপিত করেছে ।
নিষ্পাপ ছোট ছোট শিশুরাই এখন তার দিন রাত্রি। তাদের অচেনা মায়ের নন্দিনী নিষ্পাপ শিশুগুলো। আর সে সাথে সুউচ্চ পাহাড়ের উদারতা আর উত্তাল সাগরের ঢেউগুলো পার্থিব জীবনের সবটুকু জঞ্জাল সরিয়ে দিয়েছে বলে; অচেনার আমার আমি আপন মনে গেয়ে উঠে,
‘”ভয় হতে তব অভয় মাঝে নূতন জনম দাও হে॥
দীনতা হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে,
জড়তা হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে॥”
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)