চট্টগ্রাম থেকে: বিসিবির নির্বাচক কমিটি চলছে দুই সদস্য দিয়ে। একজন হাবিবুল বাশার, অন্যজন কমিটির প্রধান মিনহাজুল আবেদীন। নির্বাচক প্যানেল নামে আরেকটি কমিটিতে আছেন তিন সদস্য। হেড কোচ, ম্যানেজার ও ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান। চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে যখন বাংলাদেশের কোচ তখন কার্যকর হওয়া এ প্রক্রিয়া বহাল আছে এখনো। খেলোয়াড় নির্বাচনের কাজে এত মানুষের হস্তক্ষেপ ভালো ফল বয়ে আনবে না, এমন মনোভাব থেকেই ২০১৬ সালের জুনে প্রধান নির্বাচকের পদ ছেড়েছিলেন ফারুক আহমেদ।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু হোটেলে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন ফারুক। সম্প্রতি নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে সেটি নিয়েও কথা বলেন সাবেক এ নির্বাচক।
‘নির্বাচক তো অনেকেই আছে এখন। এখানে বোর্ড পরিচালক নির্বাচক, ম্যানেজার নির্বাচক, ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ থেকেও নির্বাচক আছে। আমরা মনে হয় পাঁচ-সাত জন নির্বাচক। আমি যখন ইস্তফা দিয়েছি তখন নির্বাচক ছিল দুইজন, সাথে খালেদ মাহমুদ সুজন ছিল ম্যানেজার হিসেবে নির্বাচক। তারপর সমন্বয়ের জন্য পরিচালনা বিভাগের প্রধান থাকবেন নির্বাচক। নির্বাচক তো আসলেই অনেকজন, একজন তো না। বিষয়টা ইতিবাচক হলে আমি থাকতাম। তবে এই নিয়ম কাজ করবে না আসলে। কেননা যখন ভালো করবে তখন কেউ কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা করবে। আবার যখন খারাপ করবে তখন একে অপরের দিকে আঙুল তুলবে।’
নির্বাচকদের সিদ্ধান্তের সঠিক ব্যাখ্যা থাকতে হবে
একটা দলের পারফরম্যান্স ভালো বা খারাপ যাবে এটা খুব স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। সেই সাথে আমাদের মাথায় রাখা দরকার অন্য জিনিসগুলো আমরা ঠিকমতো করতে পারছি কিনা। সেক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন উঠেছে, আমাদের দল নির্বাচন হোক বা যেকোনো কিছু। সবার পারফরম্যান্স সবসময় একই হবে না, যা খুবই স্বাভাবিক। যেটা নিয়ে আমরা শঙ্কিত তা হচ্ছে অন্যকিছু ঠিক মতো হচ্ছে কিনা। আমার কাছে মনে হয় সিলেকশনের দায়িত্ব এমন কাউকে দিতে হবে যে নিজের একটা একাউন্টেবলিটি তৈরি করতে পারে। মানে কেউ যখন সুযোগ পেল তাহলে কেনো সুযোগ পেল বা কেউ বাদ পড়লে কেনো বাদ পড়ল- এই ব্যাখ্যা কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা খুব একটা দেখতে পাই না। আর দল হারলে যে অস্থিরতা তৈরি হয় সেটাও কাম্য না।
যেহেতু আমরা সিলেকশনের কাজ ভালোমতো করছি না, তাই অস্থিরতা খুব সহজেই হয়ে যায়। একটা-দুইটা ম্যাচ খারাপ করলে মনে হয় ঠিক হচ্ছে না, আবার অনেক ধরণের পরিবর্তন। একটা ছেলেকে দেখি অনেক পরে নিয়ে আসা বা কাউকে দিয়ে আমরা স্থিতি আনতে পারছি না। আমি মনে করি এটা আমাদের জন্য বিরাট ব্যাপার। অনেক সময় হয় কি, আমরা আমাদের সব ফরম্যাট গুলিয়ে ফেলি। টেস্টে আমরা ভালো করিনি, কিন্তু টি-টুয়েন্টিতে পরের বছর বিশ্বকাপ আছে। এখন কিন্তু আমাদের এক বছরের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগানো দরকার আছে। সেক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন দলে। হয়তো এই টিম থিতু হতে পারবে না। তাহলে এই দল ভালো করতে পারবে না বিশ্বকাপে। এই পুরো ব্যাপারটাই আশা করব বোর্ড যেন আরেকটু দক্ষতার সঙ্গে পালন করে।
বিশ্বকাপের কথা যদি বলেন, আমরা কিন্তু অষ্টম হয়েছি। তবে আমরা সেখানে ভালো কিছু ম্যাচ খেলেছি। সব মিলিয়ে পারফরম্যান্স ভালো হয়নি। তার আগে আমরা তেমন ভালো করিনি ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু এটা নিয়ে আমাদের অস্থির হলে চলবে না। এখন যদি এটার দিকে না দেখে অন্য প্রক্রিয়াগুলোর দিকে আমরা নজর দেই, তাহলে এটা ঠিক হয়ে যাবে।
এক ম্যাচ খেলিয়ে বাদ দেয়ার পক্ষে নন ফারুক
এটা দলের উপর দারুণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এখন কিন্তু আমাদের মূল ক্রিকেটার আছে ৪-৫ জন। এর বাইরে আমরা কিন্তু বলতে পারি না যে ছয় নম্বর বা সাত নম্বরে আমাদের কারা আছে। এটা তরুণদের জন্য বা দলে যারা জায়গা পাচ্ছে না তাদের জন্য ভালো হচ্ছে না। তরুণ কেউ আসলেও এমনভাবে পারফর্ম করতে চায় প্রথম ম্যাচ থেকে যে, তাকে দলে জায়গা করে নিতে হবে। এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ না। যখন ঘরোয়া থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটা ক্রিকেটার যায়, সেটা বড় স্টেপ আপ। সেখানে আমাদের ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। কিছু ক্রিকেটার আছে এসে মাত্রই মানিয়ে নিতে পারে। যেমন মোস্তাফিজ এসেই পারফর্ম করে এক জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে। আবার অন্য কাউকে সময় দিতে হতে পারে।
যদি মনে করা হয় কাউকে ওই পজিশনে দরকার, তাহলে ৫-৭ ম্যাচ তাকে সেই পজিশনে সুযোগ দিতে হবে। এটার আরেকটা কারণ, এখন মনে হয় টিমে অনেক নির্বাচক। আমি জানি না যে কয়জন দল নির্বাচন করে। ২-৩ জনের যদি একটা নির্বাচক প্যানেল থাকে, ওরা কোনো ক্রিকেটারকে বুঝেশুনে দলে নিতে পারবে। ওই তরুণ ক্রিকেটার ভালো খেলে কিনা সেটা সময়ই বলে দিবে। কিন্তু ওকে ব্যাক করার জন্য অন্তত নির্বাচক থাকবে। যে বলবে, ওকে এই কারণে নিয়েছি বা নেইনি। ইদানিং দেখা যায় একটা ক্রিকেটারকে এক ম্যাচ খেলিয়ে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। এতে পুরো দলের ব্যালেন্স নষ্ট হয়। কিছু কোর ক্রিকেটারের কারণে এখনও আমরা সেভাবে ভুগছি না। কিন্তু আমার মনে হয় এভাবে চলতে থাকলে ভালো হবে না। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’
‘ফরম্যাট অনুযায়ী ক্রিকেটার তুলে আনতে হবে’
আমরা যদি গত এক-দেড় বছর দেখি, তাহলে কত ক্রিকেটার খেলেছে সেটা আমরা বলতে পারব না। এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, ফরম্যাটের ভিত্তিতে ক্রিকেটার উঠিয়ে আনতে হবে। যদি দেখেন আফগানিস্তান, দুই-তিন বছরে ওরা যা উন্নতি করেছে তা অসাধারণ। তাদের ১৩ জন টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটার এসেছে। টেস্ট আর টি-টুয়েন্টি দলে মাত্র তিনজন একই প্লেয়ার- রশিদ, নবি আর আসগর। ওরাও কিন্তু এই ধারাটা ধরেছে যেকোনো ফরম্যাটে। আমি নিশ্চিত যে ছেলের প্রতিভা আছে সে কয়েক ফরম্যাটে খেলতে পারে। যেমন কালকে একজন লেগস্পিনারকে দেখেছি। তার কিন্তু সেভাবে কোনো পরীক্ষা দিতে হয়নি। সে প্রতিভাবান, কিন্তু তার প্রতিভাকে আমাদের খুব ভালোভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে। তাকে ঘরোয়াতে সব ম্যাচ খেলাতে হবে, দুর্বল প্রতিপক্ষের সাথে চার দিনের ম্যাচ খেলাতে হবে। এখন তাকে যদি পরের ম্যাচে আমরা দেখি খুব ভালো করল না, এরপর তাকে ফেলে দেই। সে কিন্তু ভালো কিছু করতে পারবে না।
এখন আমার মনে হয় আরেকটা জিনিস মিসিং। তা হচ্ছে, কোন খেলোয়াড়কে কোন ফরম্যাট দিয়ে শুরু করব সেটাও আমরা বুঝতে পারছি না। যেমন নাজমুল হোসেন শান্ত। ছেলেটা প্রতিভাবান। কিন্তু কোন ফরম্যাট দিয়ে শুরু করে ওকে মানিয়ে নিয়ে আরেক ফরম্যাটে আনা হবে সেটাই আমরা করতে পারছি না। আমরা দেখেছি শান্ত খুব কঠিন একটা জায়গায় খেলার সুযোগ পেল, ভালো করল না। সেটা নিউজিল্যান্ডে, টেস্টে। সে বাদ হয়ে গিয়েছে ৫০ ওভারের ম্যাচ থেকেও। এখন আবার দেখি টি-টুয়েন্টি দলে। এটা কিন্তু তরুণ একটা খেলোয়াড় থেকে অনেক বেশি চাওয়া হয়ে যায়।
আবার সাদমানকে দেখেন, সে কিন্তু লংগার ভার্সনের খেলোয়াড়। সে কিন্তু সেটাই খেলছে। এটা শুধু সাদমান নয়, বাকিদের জন্যও দরকার। এখন একটা ছেলেকে ডেব্যু করাতে কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখলে ভালো, যাতে করে সে মানিয়ে নিতে পারে। যেমন মানানসই ফরম্যাট, হোম কন্ডিশন বা দুর্বল প্রতিপক্ষ এগুলো। এখন যেটা হচ্ছে, হয়তো কারো মধ্যে পটেনশিয়াল আছে তাকে ট্রায়াল ব্যাসিসে সুযোগ দেয়া হল। তাকে হয়ত অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সি উইকেটে সুযোগ দেয়া হল যেখানে সে ভালো করতে পারল না। তাকে যদি আমি প্রতিভাবান মনেই করি, তাহলে তো আরও বেশি সুযোগ দিতে হবে। এই বিষয়গুলো আমাদের করে ফেলা উচিত দ্রুত। নয়তো দলটা আরও ব্যালেন্স ছাড়া হয়ে যাবে।
আমিনুলকে কেমন দেখলেন ফারুক
আমিনুলকে খেলতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক খেলতে হবে। ওকে দলের সঙ্গে রেখে অনুশীলন করাতে হবে। লেগস্পিনার হওয়া কিন্তু সহজ না। সময়ের সাথে সাথে সে যেন এগিয়ে যেতে পারে, মানিয়ে নিতে পারে। আমিনুলের প্রতিভা আছে। কাল যেটা দেখেছি ওর অনেক টার্ন নেই, কিন্তু ভালো জায়গায় বল করেছে। কালকের প্রতিপক্ষ দুর্বল ছিল। ভালো প্রতিপক্ষের সাথে যখন সে খেলবে, তখন কিন্তু আবার মার খেতে পারে। ওটাও দেখতে হবে। তখন যদি তাকে ছেড়ে দেই তাহলে কিন্তু হবে না।