চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কেন কাঠগড়ায় ই-কমার্স?

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ই-কমার্স। আমরা তাকে কেন কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। আসলে তার কী দোষ? লুটপাট, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কিংবা পরিকল্পিত জুয়ার সঙ্গে ই-কমার্সের সম্পর্ক কি?

তথ্য ও যোযোগাযোগ প্রযুক্তির চরম বিকাশের যুগে চল্লিশোর্ধ মানুষের মাথা বেশ মোটা মোটা লাগে। অনেক জায়গায় অনভ্যস্ততার ধাক্কায় উপড়ে পড়ার যোগাড় হয়। হোঁচট তো খেতে হয় প্রতিদিন। অন্তত. আমি এই গোত্রের।

প্রথমে একটি গল্প বলতে চাই। ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘কৃষিতে নারীর ভূমিকা’ শীর্ষক তিন দিনের কর্মশালায় যোগ দিয়েছি। নারীবেষ্টিত পরিবেশ। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে নারীরা এসেছেন। তাদের বেশভূষা যাই হোক, তথ্য তত্ত্ব আর প্রজ্ঞায় তারা এত বেশি উজ্জ্বল যে, তা আমার মতো মানুষের নাকাল হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কর্মশালায় টানা বসে থাকতে ভালো লাগে না। আমি মোবাইলে তিন’শ রুপির একটি প্যাকেজ বাণ্ডেল ঢুকিয়ে সোশাল মিডিয়ায় বুদ হয়ে আছি। হঠাৎ মোবাইল স্ক্রিনে একটি বার্তা পেলাম। ধামাকা অফার। কুইজে অংশ নিয়ে কোটিপতি হওয়ার সুযোগ। লিংকে ঢুকতেই অডিও বেজে উঠলো। অমিতাভ বচ্চনের রেকর্ডেড ভয়েস। তিনি শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। ‘কোন বানেগা ক্রোরপতি’র ভঙ্গিতে। দুয়েক মিনিট পর তিনি সহজ সহজ প্রশ্ন করছেন। আমি মোবাইল বাটনে নাম্বার চেপে তার জবাব দিচ্ছি। এভাবে টানা পনের মিনিট। হঠাৎ ভয়েসটি বন্ধ হয়ে গেল। সাতদিনের জন্য ভারী যে ইন্টারনেট প্যাক কিনেছিলাম, তা শেষ। নিজের জিহ্বা নিজে কামড়ে ‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’ প্রবাদটি মনে মনে আওড়াতে থাকলাম।

আমি লটারী ধরতে ভয় পাই। কোনোদিন লটারি জিততে পারিনি। আমার প্রিয় মানুষেরা বিভিন্ন সময়ে যেসব প্রাইজবণ্ড দিয়েছেন সেগুলোও মিলিয়ে দেখা হয় না। প্রাইজবণ্ডের নাম্বার ধরে খুঁজে খুঁজে নাম্বার মেলানোর কাজটি পণ্ডশ্রম মনে হয়। লটারিতে ভয়ের কারণ হলো, বাল্যবেলায় মার্বেল দিয়ে খুচরো টাকার জুয়া খেলা শিখেছিলাম। জমানো টাকা কিংবা মায়ের ড্রয়ার থেকে চুরি করা টাকা নিয়ে দৌড়ে গিয়ে লেখাপড়া না জানা টোকাই প্রকৃতির ছেলেদের কাছে দুয়েক মিনিটে হেরে আসতাম। যতবার হারতাম ততবার তাৎক্ষণিক মনে হতো, এই জেতাটা আমিও জিততে পারতাম। কিছু পরে মনে হতো, জুয়া খেলা পাপ। মহাপাপ। আরো পরে মনে হতো দুয়েকবার খেললে কিছুই হয় না। জিততেও তো পারি। এসব তো ভাগ্যের ব্যাপার।

২০০০ সালের কথা। ঢাকায় দৈনিক খোলাকাগজে কাজ করি। রামপুরার একটি ব্যচেলর ফ্ল্যাটে থাকি। আমি থাকি এক রুমে। অন্য রুমগুলোতে গাদাগাদি করে বেশ কিছু তরুণ থাকেন। তারা নানান কাজ করেন, সে সঙ্গে ডেসটিনির সঙ্গে যুক্ত। তরুণগুলোকে চোখের সামনে ফুলে ফেপে উঠতে দেখছি। টাকার নেশায় তারা মাতাল। এক তরুণের ছোট ভাই গ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছে। সে আমার ঘরে উঁকি ঝুঁকি মারে। একদিন সকালে আমার মানিব্যাগ শূন্য করে সে লাপাত্তা। আমি কিছুক্ষণ আগেও মানিব্যাগে টাকাগুলো গুণে রাখলাম। বাথরুম থেকে ফিরে দেখি টাকা নেই। ওই ছেলেটিও নেই। বুঝে গেলাম। কাউকে কিছু বললাম না। তরুণেরা কেবল ধনী হয়ে উঠছে, তাদের একজনের ছোটো ভাইকে চোরের বদনাম দিলে আমার টেকা দায় হবে। শুধু বুঝলাম, টাকার নেশায় উন্মাতাল বড় ভাইয়েরা ছোটো ভাইয়ের মধ্যেও টাকার ক্ষুধা জাগাতে সমর্থ হয়েছে।

আমার তিনটি গল্প আমি আজকের বাস্তবতার সঙ্গে মেলাতে চাই না। প্রথম গল্পটি আমার মতো সাধারণ মানুষের লোভকে স্পষ্ট করেছে। লোভের কারণেই ধরা খেতে হয়। পরের গল্পটি হচ্ছে সবাই সব জুয়া পারে না। টোকাই প্রকৃতির ছেলেদের জুয়া সরল সচেতন মনে খেলতে গেলেই জিতে আসা যায় না। তৃতীয় বিষয়টি হলো, টাকার নেশায় উন্মাতাল বড় ভায়েরা ছোট ভাইদের মধ্যে যেভাবে টাকার নেশা ধরিয়ে দেয়, সে বিষয় নিয়ে।

আমাদের দেশে বহু বড় ভাই এখন দ্রুত টাকা বানানোর মেশিন নিয়ে নেমে গেছেন। আমরা ক্যাসিনো দেখেছি, রংমহল দেখেছি, মাদক সাম্রাজ্য দেখেছি, প্রাসাদ অট্টালিকা, ভূমিদস্যু সবই দেখেছি। মানুষের পটেকের টাকা যাদুমন্ত্রবলে নিজের পকেটে নেয়ার কৌশলও দেখেছি। আমাদের দেশে এমএলএম বাণিজ্য শুরু হয় পবিত্র তকমা দিয়ে। শুরুর সেময় সেটি দেশের অর্থনীতির জন্য বড় এক আশীর্বাদ হিসেবে সাড়া ফেলে দেয়। কেউ সামাজিক দায়বদ্ধতার গল্প শোনায়, কেউ সমাজের জঞ্জাল সাফ করার দায়িত্ব নিয়ে নেয়, কেউ ক্ষমতার ছত্রছায়ায় জীবনকে ঐশ্বর্যবান করে তোলার এমন মহৎ দৃষ্টান্ত গড়ে তোলেন, যেখানে পৌঁছাতে বহু যোগ্যতার প্রয়োজন হয়ে বলে আমরা সেসব দুরাশা ত্যাগ করে সাধারণ মানুষ হয়ে থাকি। কোনোভাবে তাদের সঙ্গে যদি পরিচিত হতে পারি, সেটুকুই বড় লাভের ব্যাপার। কমিউনিকেশনের যুগে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির মতো। অনেকেই বলে থাকেন সম্পর্কই সম্পদ।

বলতে চাই ই -কমার্স প্রসঙ্গে। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ থেকে শুরু করে অনলাইন বাণিজ্যের প্রত্যেকটি প্লাটফরমকে আমরা ই-কমার্স বলতে পারি। পৃথিবী এখন ই-কমার্সে চলে গেছে। প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে, মানুষের টাকা পকেটস্থ করার ফাঁদ খোলা হয়েছে। ই-কমার্স ইলেকট্রনিক কমার্স নামেও পরিচিত। পণ্য বা সেবা ক্রয় – বিক্রয়, অর্থ স্থানান্তর, এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমের (ইন্টারনেট) মাধ্যমে তথ্য স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া। এই নেটওয়ার্ক মানুষকে দূরত্ব এবং সময়ের সীমাবদ্ধতা ছাড়াই ব্যবসা করতে দেয়।  এই ব্যবস্থা আমাদের জীবনকে সহজতর করেছে। করোনাকালে আমাদের জীবনের অচলায়নে অসাধারণ এক সুবিধা দিয়েছে ই-কমার্স। পরিবর্তিত ও যান্ত্রিক পৃথিবীতে পণ্য কেনা-বেচার জন্য অনলাইন মাধ্যমের সুবিধাটিকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এই অনলাইন ব্যবস্থাটি অত্যন্ত সহজ ও নিরাপদ। এখানে তেমন কোনো ফাঁক ফোকর থাকার কোনো কারণ নেই, যেখানে একজন গ্রাহক বা ভোক্তা প্রতারিত হতে পারেন। কারণ, পণ্য নির্বাচন থেকে শুরু করে মূল্য পরিশোধের সকল ক্ষেত্রেই ভোক্তার সচেতন বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। এখানে যেটি প্রয়োজন সেটি হলো অক্ষরজ্ঞান। বোধ করি, অক্ষরজ্ঞান না থাকলে কেউ অনলাইনে কেনাকাটার ধারেকাছেও যাবেন না, বা যান না। তাহলে শত শত বা হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার কারবারটি কি যান্ত্রিক? এই যজ্ঞটির জন্য কোনো যন্ত্র না প্রযুক্তির দায়? এটি কি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কারসাজি হতে পারে? নিশ্চয় না। তাহলে ই কমার্সকে আমরা দায়ী করি কেন ?

জোচ্চুরি যা ঘটেছে তা প্রাচীন কায়দায়। এখানে কোনো যন্ত্র বা প্রযুক্তির সহায়তা নেই। এখানে রয়েছে চটকদার বিজ্ঞাপন আর জুয়ার কারবার। ইভ্যালি ছিল শুধুই একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস। পরে তারা কী শুরু করলো? তারা বাজারের যে পণ্যের দাম দুই লাখ টাকা, সেইপণ্য ষাট, সত্তর, আশি হাজার বা এক লাখ টাকায় দেবার অফার দিয়ে বসলো। দেশের বিভিন্ন পণ্যপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক অফারের কার্ড বিক্রি শুরু করলো। এসব প্রতিষ্ঠান টাকা পেয়েছে, তাই ইভ্যালির অফার গিলেছে। আর এই অফারে সাড়া দিয়ে পণ্য কেনেনি কে? সমাজের সকল শ্রেণির মানুষই আছে। বিশেষ করে আছে শহরের শিক্ষিত সজ্জনেরা। ই-কমার্স প্লাটফরম হিসেবে সরকারি যে অনুমোদন তাদের ছিল, তার মধ্যে কি মানুষের অর্থ জমা নিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদে পণ্য প্রদানের এই কর্মযজ্ঞের অনুমতি ছিল? কিছুই ছিল না। কারো মনেই সন্দেহ হয়নি। একটি শ্রেণি সুবিধামতো ইভ্যালির অর্থনৈতিক সেবা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক সকল সেবাই গ্রহণ করেছে।

এখন ই-কমার্স বাণিজ্যের আড়ালে এই জোচ্চর বা জুয়াড়িদের ঘিরে দুটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। এক. সুফলভোগী, দুই. প্রতারিত। আমরা চাইলে প্রতারিতদের একটি তালিকা হয়তো প্রস্তুত করতে পারি। তাহলে যারা সুফল ভোগ করেছেন তাদের তালিকাটিও আমাদের প্রয়োজন। আমাদের দেখা দরকার জুয়ায় অংশ নিয়ে যারা ইভ্যালির মাধ্যমে বিপুল অংকের লাভ করে তৃপ্ত হয়েছেন, তারা কারা- এটিও দেখা হোক। সচেতন নাগরিকদের কি দেশ ও অর্থনীতিবিরুদ্ধ কোনো কিছু ধরিয়ে দেয়ার দায় নেই? আমরা নাগরিকরা কেন জুয়ায় আসক্ত হই? এর জবাব অবশ্য একটি আছে। তা হলো, সরকার আমাদের সুযোগ দিলে আমরা তো গ্রহণ করবোই। যেহেতু কেউ বাধা দিচ্ছে না, তাই মানুষ তো ওই প্রলোভনে এগিয়ে যাবেই।

বারবার বলতে ইচ্ছে করছে, কথায় কথায় ই-কমার্সকে দায়ী করাটা বাস্তবমুখি নয়, যৌক্তিকও নয়। এর সঙ্গে ই-কমার্সকে যুক্ত রাখাই উচিৎ নয়। কোনো ধর্মশালায় যদি কেউ অসততা করে, কারোর শালীনতাহানী করে, তাহলে ধর্মশালার কোনো দোষ হতে পারে না। এখানে এত বড় একটি অন্যায়ের সঙ্গে ই-কমার্সকে যুক্ত করা মানে অন্যায়কে খাটো করে দেখা। আমরা চাই ই-কমার্স – এর প্রসার ঘটুক নির্বিঘ্নভাবে। সরকারের তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দক্ষতায়, সততায় ও চেতনায় শক্তিশালী হয়ে উঠুক, যাতে যেকোনো উদ্যোগের সঙ্গে সঠিক শর্তাবলী জুড়ে দিতে পারে। সে সঙ্গে অনলাইন প্লাটফরমের নামে যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সেজে বসছেন তাদেরকে সবসময় মনিটরিং এর মধ্যে রাখাটিও সরকারের দায়িত্ব।

আরেকটি কথা বলতে চাই, বহুদিন ধরেই মানুষ আশা করে আছে, সবকিছু কম্পিউটারাইজড ও স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠলে মানুষঘটিত অনৈতিকতা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারতাম। সেদিকে আমাদের জোর দেয়া দরকার। আমরা যতই তদন্ত কমিটি করি আর কমিশন করি না কেন, আমাদের মানবিক ব্যবস্থার মধ্যে বাণিজ্য, পুঁজি  ও আর্থিক লাভের বিষয়টি গভীরভাবে ঢুকে গেছে। আমরা এখান থেকে বেরুতে পারবো না। যন্ত্র ও প্রযুক্তিকে দায়িত্ব বুঝে দিলে সে ঠিকই ন্যায়নিষ্ঠভাবে একটি সিস্টেম চালাতে পারবে। উন্নতবিশ্বে সেভাবেই তো চলছে সবকিছু।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)