কলকাতায় কালীপূজার একটা অনুষ্ঠানে যাওয়া নিয়ে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। পূজায় আমন্ত্রণ রক্ষা এটা খুব সাধারণ এক ঘটনা। আমাদের আবহমান সংস্কৃতি হিন্দু-মুসলিমসহ সকল ধর্মের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সংস্কৃতি। আমরা ছোটবেলা থেকেই এমনটা দেখে আসছি, এমনটা অনুশীলন করে আসছি। এখানে সৌহার্দ্যের ছোঁয়া আছে, ভালোবাসার পরশ আছে, আছে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শন। ধর্মের নামে এভাবে বিভক্ত হতে দেখিনি আগে আমাদের সমাজকে। কে হিন্দু, কে মুসলিম— এসব আলোচনা নিয়ে আমাদের সমাজের বিভক্তি এতদিন এত প্রকটভাবে আমরা দেখিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলাদেশ পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে, বলা যায় অনেকটাই বদলে গেছে। এখন ধর্মের বিভক্তি নানা ক্ষেত্রে প্রকট হয়ে উঠতে দেখছি আমরা।
বেশ কবছর ধরে আমরা দেখছি পূজা-অর্চনার মৌসুমে বিভিন্ন জায়গায় মূর্তি ভাঙচুর হয়। কারা করে ওসব পরিস্কার। ধর্মের নামে এদেশের মুসলমানদের একাংশ এই ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত থাকে। এই একাংশের সঙ্গে আবার বহুলাংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকে। এই সমর্থন বাড়ছে ক্রমশ। সঙ্গে হুমকি-ধামকি সে ত আছেই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার জিগির তুলে বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটতরাজ হয়। এসবের খুব কমই বিচার হয়। উল্টো আমরা দেখে আসছি যার বিরুদ্ধে কথিত অবমাননার অভিযোগ ওঠে বিনা বাক্য ব্যয়ে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। থানায় হয়ত নির্যাতনও করে। কারণ যে পুলিশ সদস্যরা এই ধরপাকড়ে জড়িত তারা যতটা পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজগুলো করে তার চেয়ে বেশি ধর্ম-কার্য হিসেবেই করে থাকে। বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা দেখছি, সময়ে-সময়ে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দেখেছি দায়িত্ব পালনের চাইতে অনুভূতি রক্ষার রক্ষক হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে। এই অনুভূতি রক্ষায় সংখ্যাগুরুর চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দায়িত্ব পালনের ব্যত্যয় ঘটে। ওটা তারা সচেতনভাবেই করে থাকে। একপেশে এই অবস্থানে তারা মোটেও অনুশোচিত হয় না।
আমাদের শৈশব-কৈশোর একভাবে গেছে, যৌবনকাল যাচ্ছে অন্যভাবে। আগেকার সেই ধর্মীয় সহাবস্থানের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে। ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের ব্যক্তিগত দাবিটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করাতে সমাজের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর কুফল এখন ভোগ করতে শুরু করেছি আমরা। ধর্মীয় অনুশাসন, আচার-বিধান পালন না করা ব্যক্তিরও ধর্মীয় অনুভূতি এতখানি প্রখর যে এই অনুভূতির কারণে যেকোনো সময় যে কেউই হিংস্র রূপ ধারণ করতে পারে। সাকিব আল হাসানকে হত্যার হুমকি দিতে প্রকাশ্যে রামদা প্রদর্শন, প্রয়োজনে হেঁটে ঢাকায় গিয়ে তাকে কুপিয়ে হত্যা করার যে হুমকি সেটা এর ধারাবাহিকতা। এখানে মহসিন তালুকদার নামের যে যুবক এই হুমকি দিয়েছে সে হয়ত একা একাই নিজের অনুভূতি, স্বব্যাখ্যাত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে ঠিক, কিন্তু এই মানসিকতা এই দেশের লক্ষ মানুষের। মহসিন তালুকদারের যে বক্তব্য সেই বক্তব্যের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো লোকের অভাব নাই দেশে। কেউ প্রকাশ্য, কেউবা অপ্রকাশ্য; পার্থক্য স্রেফ এখানেই। এমন কেন হলো, এমন কেন হচ্ছে? হঠাত করে কেন মানুষ অন্য ধর্মের প্রতি এমন আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠছে? এটা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ করার দরকার আছে। এই প্রবণতা এখনই রুখে না দিতে পারলে আসছে দিনগুলোতে ভয়াবহ হয়ে ওঠবে পরিস্থিতি। তখন চাইলেও সামাল দেওয়া যাবে না।
ধর্মীয় সহাবস্থানের আমাদের চিরায়ত যে সংস্কৃতি তার মূলে আঘাত হেনেছে মূলত ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও এর প্রচার। দীর্ঘদিন ধরে এই দেশে অনেক ইসলামি বক্তা ওয়াজের নামে বিভক্তিরেখা এঁকে দেওয়ার দুরভিসন্ধিতে। যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী ওয়াজের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ভেদরেখা আঁকার যে কাজটা এতদিন ধরে করে এসেছিলেন এই সময়ে সেটা সফলভাবে সম্পন্ন করার পথে রয়েছেন আরও কিছু বক্তা। সাঈদীর শুরুর সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। তবু স্রেফ ধর্মের নামে তিনি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা মাধ্যম এই সময়ে শক্তিশালী এবং সর্বশ্রেণির মানুষের হাতে কাছে যাওয়ার এই সময়ের মাওলানারা খুব সহজেই তাদের ওয়াজগুলো মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন।
এখন একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল সেটেই বিভিন্ন ইসলামি বক্তার ওয়াজের ক্লিপস মেলে। গত ওয়াজ বিশেষ করে শীতের মৌসুমে সেই বক্তাদের ছিল জয়জয়কার। ফেসবুক-ইউটিউবে প্রায় প্রতিযোগিতা করে সেসব ওয়াজের ক্লিপস ছাড়ছেন তারা এবং তাদের অনুসারীরা। রাস্তাঘাটে, গাড়িতে, মাহফিলে সেই সব বক্তার সেই ভিডিওগুলো বেজেছে একের পর এক। বক্তা, তাদের অনুসারী এবং দেশের কিছু মিডিয়াকেও সেই সব মাহফিলের পিছু ছুটতে দেখেছি আমরা। সরকার-প্রশাসন, সরকারের মন্ত্রী, জাতীয় সংসদের এমপি, পুলিশ কর্মকর্তাদের সরব উপস্থিতি ছিল সেই সব মাহফিলে। এনিয়ে নানা মাধ্যমে নানা আলোচনা হয়েছে। গত বছর এসব নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে এমন আলোচনা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। ওইসব মাহফিলের বক্তারা জনপ্রিয়তার মন্ত্রে বুঁদ হয়ে কে বেশি জনপ্রিয় এনিয়ে দাবি এবং অনুসারীদের মধ্যেও তর্ক-বিতর্কও ছিল। বক্তায়-বক্তায় বিষোদগার, পরস্পরের প্রতি আক্রমণ, অনুসারীদের মধ্যে বিভক্তির পাশাপাশি ছিল নারী ও হিন্দু ধর্মের প্রতি আক্রমণ। ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করেই ক্ষান্ত হননি তারা অন্য ধর্মকে হেয় করে বলা কথাগুলো আদতে সমাজের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। যে প্রভাবের বলি হচ্ছে ধর্মে-ধর্মে সৌহার্দ্য আর চিরায়ত সহাবস্থানের রীতি। মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষ ঢুকিয়েছেন তারা তার খেসারত আমরা এখন দিতে চলেছি।
হাক্কানি আলেম বলে যে ধারণা ছিল সেটা দেশে এখন আর নাই। আলেম সমাজ বিভক্ত। এই বিভক্তি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। তাদের এই বিভক্তি এবং ছড়ানো সাম্প্রদায়িকতার বিষে এখন জর্জর হচ্ছে দেশ। ফলে ধর্মীয় সহাবস্থানের জায়গা দখল করছে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাজাত হিংসা। ভারতের একটা পূজামণ্ডপে সাকিবের উপস্থিতি তাই মেনে নিতে পারছে না মহসিন তালুকদার মানসিকতার জনগোষ্ঠী। ফলে সাকিবকে প্রায় বাধ্য হয়েই ক্ষমা চাইতে হয়েছে। যদিও এই ক্ষমা চাওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, সাকিবের দেওয়া তথ্য নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি, সাকিবের উপস্থাপনা ঢঙ এবং শব্দ-বাক্য ব্যবহার নিয়েও আছে আমাদের ব্যক্তিগত আপত্তি।
পূজায় যাওয়ায় সাকিবকে কুপিয়ে হত্যার হুমকিকে স্রেফ একজন প্রতিক্রিয়াশীলের ব্যক্তিগত অনুভূতি ভাবার কারণ নাই। এই মহসিন তালুকদার সমাজের একটা বিশাল শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন। মহসিনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা কথাগুলো আদতে একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর মনের কথা। এই অভিব্যক্তি আমাদের আবহমান বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও এটাই বাস্তবতা। আর বাস্তবতার সিঁড়ি রচিত রয়েছে ধীরে ধীরে, এবং কিছু ইসলামি বক্তার ধারাবাহিক ভুল বার্তা প্রচারের মাধ্যমেই।
হুমকিদাতাকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেপ্তার করেছে শৃঙ্খলা বাহিনী। এটাকে সুখবর বলা যায়, তবে এই প্রবণতা বিরুদ্ধে প্রতিকারের এটাই একমাত্র পন্থা নয়। এই মানসিকতা কেন সমাজে বেড়ে ওঠছে এদিকে সংশ্লিষ্ট এবং দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি দিতে হবে। কেন মানুষ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠছে এর পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে প্রতিক্রিয়াশীলতার পথটা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে এইধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এখন না হয় ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ কেউ আগ্রাসী হয়ে ওঠছে, এটা রুখে দিতে না পারলে সামষ্টিক ভাবে অনেকেই আগ্রাসী হবে। সমষ্টির আগ্রাসন প্রতিরোধের ক্ষমতা তখন প্রগতিশীল সমাজের, এমনকি রাষ্ট্রেরও থাকবে না!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)