নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় সরকার দলীয় আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি হামলা ও মামলা চলছে। সংঘাতময় হয়ে উঠছে পুরো এলাকা। এ পর্যন্ত তিনটি মামলা হয়েছে এলাকায় বিরাজ করছে চরম উত্তেজনা। এর মধ্যে একটি মামলায় এমন কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে, যারা সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থলেই ছিলেন না বলে দাবি করেছেন। এ নিয়ে সংবাদ পত্রে রিপোর্ট হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে লিখেছে, ১৮ সেপ্টেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের দুটি পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে চারজন আহত হয়। এ ঘটনায় মোহনগঞ্জ থানায় তিনটি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ মোহনগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি মিজানুর রহমান রিজনের করা মামলায় ৫৮ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে একই পরিবারের আট ভাই রয়েছেন (আসামি নম্বর ২, ৫১, ৫২, ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭)। ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির সদস্য প্রিয় ডট কমের স্টাফ রিপোর্টার মুক্তাদির হোসেন প্রান্তিক সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেন সাবেক সচিবের পক্ষের দেওয়া মামলায় আমি মোক্তাদির ৫৩তম আসামি এবং আমরা ৯ ভাইয়ের মধ্যে ৮ ভাই আসামি। ঢাকায় কর্মস্থলে আছি-আমি মোক্তাদির (সাংবাদিকতা), বড় ভাই জামাল (বেসরকারি চাকরি), বড় ভাই মামুন (বেসরকারি চাকরি), আরেক বড় ভাই স্বপন (বেসরকারি চাকরি) তার কর্মস্থল ধোবাওড়া। এই হলো মামলার এজহারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সত্যতা ও হালচাল, ও রাজনীতি-মজার বিষয় হচ্ছে সংঘটিত ঘটনার সময় আমরা যারা এলাকার বাইরে কর্মস্থলে আছি তারা ছাড়াও বাড়িতে যারা থাকেন তারাও কেউ উক্ত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নই।
উল্লেখ্য এ পর্যন্ত পাল্টাপাল্টি তিনটি মামলায় ১২৪ জন আওয়ামী লীগ, যুব লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা কর্মীর নামে থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর চ্যানেল আই অনলাইনে আওয়ামী লীগ বনাম এমপির আওয়ামী লীগ শিরোনামে একটা কলাম লিখেছিলাম তার একজায়গায় লেখা ছিল:
ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ে ওখানে দুটো আওয়ামী লীগ, একটি এমপির অপরটা উপজেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের। জাতীয় দিবসগুলোতে শহীদ মিনার অথবা স্মৃতিসৌধে ফুলের তোড়াও বিভক্ত হয় ওখানে। দুই আওয়ামী লীগ দুই মিছিল নিয়ে ফুলের তোড়া দিতে যায়। আভ্যন্তরীণ গ্রুপিং দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত ছিল এলাকা। কিছুদিন পরপর সংঘটিত হতো হামলা মামলা। অতঃপর শুভ বুদ্ধির উদয় হয় দুই গ্রুপের। সংসদ সদস্য রেবেকা মমিনের মধ্যস্থতায় অবসান ঘটে এই দ্বন্দ্বের৷ সমঝোতায় সিদ্ধান্ত হয় লতিফুর রহমান রতন দলের সভাপতি ও পৌর মেয়রের দলীয় মনোনয়ন পাবেন ও শহীদ ইকবাল হবেন সাধারণ সম্পাদক ও দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। গ্রুপিংয়ের অবসানে এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছিল তখন। সেসময় সংসদ সদস্য রেবেকা মমিনের আশীর্বাদ পুষ্ট ছিলেন লতিফুর রহমান রতন। কিন্তু তার দলীয় কোন পদ ছিলোনা। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন মজিবুর রহমান কাঁচা মিয়া। গ্রুপিং দ্বন্দ্ব অবসানের প্রেক্ষিতে লতিফুর রহমান রতন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও দলের মনোনয়ন পেয়ে পৌর মেয়র নির্বাচিত হন৷ শহীদ ইকবাল মেয়র নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়ে রতনের পক্ষে কাজ করেন। কিন্তু সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। শহীদ ইকবালের অনুসারীরা নির্বাচনে রতনের ভূমিকায় সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকে যে তিনি গোপনে গোপনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। আবার প্রকাশ্য নির্বাচনী জনসভায় শহীদ ইকবালের পক্ষে নৌকায় ভোট চেয়েছেন৷
অতঃপর আবারও শুরু হলো গ্রুপিং দ্বন্দ্ব। লতিফুর রহমান রতনকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ হতে বহিষ্কার করলো দলের কার্যনির্বাহী কমিটির একটি বৃহৎ অংশ। ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হল দলের সিনিয়র সহসভাপতি শামছুর রহমান মাষ্টারকে। আবার লতিফুর রহমান রতন তার অনুসারীদের নিয়ে নিজেকে সভাপতি হিসেবে সভা করে যেতে থাকল। এক আওয়ামী লীগ ও একই শাখার দুজন সভাপতি! কেন্দ্র কেন দলীয় গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে এই বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটাতে পারলো না? এদিকে বিভাগীয় কমিশনার হতে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ও সচিব হওয়ার সুবাদে ক্ষমতাকেন্দ্রিক আলোচনায় এলেন সাজ্জাদুল হাসান৷ সচিব হতে অবসর নেয়ার পর তাকে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হল৷ বিমানের চেয়ারম্যান হওয়ার পর তাকে দেয়া সংবর্ধনা নিয়ে গ্রুপিং আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। নেত্রকোনা ও মোহনগঞ্জে আওয়ামী লীগ দলীয় ভাবে তাকে সংবর্ধনার আয়োজন করল। এই সংবর্ধনাকে ঘিরেও জেলা জুড়ে দেখা দিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া৷ কেউ বলল যিনি দলের কোন সদস্যই নন তাকে কেন দল সংবর্ধনা দিতে গেল? কেউ বলল, বিমানের চেয়ারম্যান হিসাবে ও এলাকার উন্নয়ন কাজে সহায়তার জন্য। কেউ বলল, উন্নয়ন কাজের জন্য সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধিরা রয়েছেন। কেউ বলল, তাদের মাধ্যমে উন্নয়ন কাজে সহায়তা করলেও এত হৈচৈ কেন?
এভাবেই জেলাজুড়ে সাজ্জাদুল হাসানকে ঘিরে শুরু হল দলীয় দ্বিধাবিভক্তি। মোহনগঞ্জে তা তীব্র আকার ধারণ করল। সাজ্জাদুল হাসানের পক্ষে চলে গেলেন দলের একাংশ কর্তৃক অব্যাহতি প্রাপ্ত সভাপতি লতিফুর রহমান রতন। সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান শহীদ ইকবাল চলে গেলেন সংসদ সদস্য রেবেকা মমিনের পক্ষে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব হওয়ার সুবাদে সাজ্জাদুল হাসান এলাকার বেশ কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা করতে পেরেছেন। এজন্য তার একটা জনমতও সৃষ্টি হয়েছিল। দল চাইলে তিনি রাজনীতিতে আসতেও পারেন। কিন্তু তাকে ঘিরেই দল আবার বিভক্তিতে ফিরে গেল। তাকে ঘিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে সামাজিক সংগঠনগুলোও। শিক্ষক সমিতির একাংশ তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিলো আরেক অংশ বিরোধ করল। মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝেও কেউ তার পক্ষে কেউ তার বিপক্ষে। বিমানের চেয়ারম্যান পারিবারিক সফরে রেলে মোহনগঞ্জ নিজ বাড়িতে এলেন। এটাকে নিয়ে এত হৈচৈ, মিছিল,সংবর্ধনাকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছেনা। কেউ বলছেন বিমানের এত সমস্যার প্রতিকার ভূমিকায় না থেকে তিনি রেলে কেন? অনেকেই বলছেন যিনি দলেরই সদস্য নন তাকে দলীয়ভাবে অভ্যর্থনা কিভাবে দেয়া যায়? আওয়ামী লীগের দলীয় গঠনতন্ত্রে এর ব্যাখ্যা কি? কেন শান্ত শহর আবার উত্তপ্ত হয়ে গেল। এক আওয়ামী লীগের দুজন সভাপতি। কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরাও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল৷ কেন কেন্দ্র গঠনতন্ত্রের আলোকে এই বিভক্তির সমাধান করলো না?
অতীতে আমরা আওয়ামীলীগ(হাসিনা), আওয়ামী লীগ(মালেক),আওয়ামী লীগ(মিজান) প্রভৃতি দেখেছি। তবে কি সেরকম ভাবেই উপজেলাতেও এমন ব্র্যাকেট সৃষ্টি হল? কেন এক দলের ফুলের তোড়া দুই ভাগে বিভক্ত? এমনটি কি এক উপজেলা হতে অন্য উপজেলাতেও ছড়িয়ে আরও বিস্তৃততর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করতে পারেনা? ২০১৫ সালে যে বিভাজনের শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি ঘটেছিল ২০২০ সালে তা কেন আবার জাগলো? এখানকার আওয়ামী লীগের সভাপতি কে লতিফুর রহমান রতন না শামছুর রহমান মাষ্টার?কেন্দ্রের দৃষ্টিতে কে? এই অস্পষ্টতা কি তারা দূর করবে? আওয়ামী লীগের দুটি করে সভা হয় একটি লতিফুর রহমান রতনের সভাপতিত্বে অন্যটি শামছুর রহমান মাষ্টারের সভাপতিত্বে। এই ব্যর্থতা কেন্দ্রীয় সংগঠন বিভাগ তথা সাংগঠনিক সম্পাদকের নয় কি? ২০১৫ সালে লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম আওয়ামী লীগ বনাম এমপির আওয়ামী লীগ৷ এবার আরেকটি লেখার শিরোনাম দেয়া যায় কি তবে আওয়ামী লীগ বনাম আমলার আওয়ামীলীগ। বাস্তবতা কি তাই বলছেনা? এই দ্বন্দ্বে অতর্কিত হামলায় বাসা বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর হলো। দলীয় ও আঞ্চলিকতার দ্বন্দ্ব প্রকট হলো। সামাজিক সংগঠনে বিভাজন শুরু হলো। কিন্তু কেন? এর দায় আওয়ামী লীগের সংগঠন বিভাগের নয় কি? সাজ্জাদুল হাসান একজন নাগরিক হিসেবে কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দিতেই পারেন। কেন তাকে তবে দলীয় মেম্বারসিপ দেয়া হলোনা? কেন মেম্বারসিপ না নিয়েই দলের সংসদ সদস্য মনোনয়নের টিকেট পেয়ে যাচ্ছেন এমন প্রচারণা? এই প্রচারণাকে ঘিরেই সৃষ্টি হল বিভাজিত অনুসারী মহলের। আগে মেম্বারসিপ পরে মনোনয়নের টিকেট এমনটা হওয়াই কি সংগত ছিলোনা? কী বলে আওয়ামীলীগের গঠনতন্ত্র?
আওয়ামী লীগের অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নামে তিনটি মামলা হলো। আসামী মোট ১২৪ জন। সব মামলাই চলে গেল দ্রুত বিচার আইনে। আসামীদের মধ্যে কেউ সত্য আসামী কেউ মিথ্যে আসামী। কেউ এলাকায় থাকেনা এসবের খবরও জানেনা। তারাও আসামী। কেন পুলিশ সত্যতা যাচাই করে মিথ্যা আসামীদের বাদ দিলোনা? নিরপরাধ ব্যক্তি কেন দ্রুতবিচার আইনের হয়রানি ভোগ করবে?কেন এই বিভাজন নিরসনের দায়িত্ব দলীয় কেন্দ্র ও জেলা না নিয়ে তাদেরকে সংঘাতে ঠেলে দিলো ও পুলিশের হাতে তুলে দিলো আসামী বানিয়ে। যদি তারা এমনটি করতে ব্যর্থ হয় তাদের উচিত আওয়ামী লীগ(হাসিনা)আওয়ামী লীগ(মালেক) ও আওয়ামী লীগ(মিজান)এর মত ব্র্যাকেটের স্বীকৃতি দিয়ে দেয়া। মানুষ সংঘাত চায়না। তারা চায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আশা করি দলীয় নীতি নির্ধারকরা বিষয়টা একটু ভেবে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নেবেন, দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে শান্তিতে বসবাসের পরিবেশ নিশ্চিত করবেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)