সেদিন সকালে ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার পরই সবার একই প্রশ্ন, এতোক্ষণ পর..? সহপাঠীদের উৎসাহ আর আন্দোলনের তীব্রতা দেখে অবচেতন মনেই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। রুমি ভাইয়ের সঙ্গে রাস্তা, দেয়াল লিখন আর অবদমিত স্লোগানে গলা মেলালাম।
ততোক্ষণে ২৭ নম্বরের চারপাশ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ভারী আর গম্ভীর হয়ে উঠেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। বলা হচ্ছে, ‘রাস্তা ছেড়ো না, আন্দোলন চালিয়ে যাও। আমাদের অধিকার আমরাই আদায় করবো’। ব্যাস, বিপ্লবী চেতনা জেগে উঠলো। সারাক্ষণই মধ্যবিত্ত পরিবাবেরর সর্বস্ব সঙ্গে নিয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের কথাই ভাবছিলাম। কী হবে, কতোটুকু হবে, কতোদূর যাবে, আমরা কী পারবো…
আন্দোলনের আবহ
কড়া দুপুর। আমরা কাজ করছি। হঠাৎই রুমি ভাইয়ের গভীর তেষ্টা পেল। উনি পাশেই বসে পড়লেন। পানি বলে চিৎকার করলেন। সেই চিৎকার শুনে অপরিচিত একটি ছেলে তার অর্ধেক খাওয়া পেপসির বোতল বাড়িয়ে দিল। এতটা সৌহার্দপূর্ণ কার্যক্রম ছিল আমাদের। কারো মধ্যেই কোনো ক্লেশ ছিল না। এটা ছিল খুবই ভালোলাগার দৃশ্য। আমি ছাত্রটির ব্যবহারে মুগ্ধ হই। পানি আর স্যালাইন খেয়ে আঁকাআঁকির কাজ যখন শেষ, তখন বিকেল চারটা। পেটে ক্ষুধা, ওদিকে পকেটও ফাঁকা। এবার রানা ভাইয়ের উপস্থিত বুদ্ধিতেই কাজ হলো। স্যারদের থেকে খাওয়ার টাকা নিলাম। সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেলাম।
প্রিন্স প্লাজা (ড্যাফোডিল টাওয়ার-৫) ছেড়ে ধানমন্ডি-২৭ এ গেলাম। একপাশে পুলিশ, অন্যপাশে আমরা। এমনকি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী দলগুলোর ভেতরেও সাদা পোশাকধারী পুলিশ! দৃশ্যটা দেখেই ফলোআপের ভাবনা ফিরে এলো। নিজে উপস্থিত থেকে এমন পরিস্থিতি জীবনে প্রথম দেখছি।
মূল ঘটনা
সারাদিনের ঘটনা তো সবাই-ই জানেন। যথেষ্ঠ শান্তিপূর্ণ ভাবেই আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলন অন্যদিকে মোড় নিল সন্ধায়। বিস্ময়টা সেখানেই, কেন এমন হলো!
দেখলাম বহিরাগত একটি পক্ষ সাধারণ ছাত্রদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। বলছেন ‘আন্দোলন থামান’। তারা একবার ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলছেন, আরেকবার পুলিশের সঙ্গে। যদিও পক্ষটিকে সারাদিনের আন্দোলন কর্মসূচির কোথাও চোখে পড়েনি। সন্ধ্যায় তারা এখানে আসেন, ছাত্রদের মধ্যে ঢুকে পড়েন। নানা রকম গুটি চালাচালি করেন। এরইমধ্যে ইংরেজী বিভাগের মউ টেলিভিশন চ্যানেলের বুমের সামনে এসে হাজির। মউ বাইট দিচ্ছে। ততোক্ষণে পক্ষটির দু’-একজনের সঙ্গে কথা বললাম। তারা যা বললো, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখন আর আন্দোলন চালানোর কী দরকার?’ শিক্ষার্থীরা অবশ্য তাদের কথা শোনেনি। অতর্কিত আক্রমণটা কী এ জন্যই হলো? বুঝে ওঠার আগেই হতবিহব্বল হয়ে গেলাম!
ব্যাপারটা অন্যখানে! যেটা বুঝলাম, শিক্ষার্থীরা আসলে নেতৃত্বের অভাবে পড়েছে। এত বড় একটা প্রতিরোধ, অথচ শক্তিশালী নেতৃত্ব নেই। আন্দোলনকারীরা আসলে কাঠামোবদ্ধ হতে পারেনি। সঠিক নির্দেশনা পায়নি। পুরোটা একসময় গোলমেলে হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন মঞ্চ ছাড়তে শুরু করে। হটকারীরাও সুযোগ পেয়ে যায়।
তখন সন্ধ্যা পেরিয়েছে। রাস্তায় মোম জ্বলছে। শিক্ষার্থীদের হাতে তখনো প্ল্যাকার্ড, গলায় স্লোগান। কিন্তু কেউই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। নেতৃত্বের অভাব ধীরেধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। ওদিকে সমঝোতা করতে আসা পক্ষটি হটাৎই উধাও।
রাত সাড়ে আটটা, প্রথম আক্রমণ। রাপা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরালাম। কী ব্যাপার? এর মধ্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান! ঘাড় ঘুরিয়ে বুঝতে বাকি রইলো না। পুলিশী মহড়া পাশ কাটিয়ে এক দল (১০-১৫) তরুণ শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো। লোকসংখ্যায় কম বুঝে দলটি মুহূর্তেই আবার কেটে পড়লো। কিন্তু না, লোক সংখ্যা কম বলেই নয়। মিডিয়ার ক্যামেরা আর আলোকচিত্রীদের দেখেই তারা সরে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। তাদের চোখে-মুখে নেতৃত্ব আর কার্যকরী নির্দেশনার অভাব। শিক্ষার্থীদের অনেকে আন্দোলন মঞ্চ ত্যাগ করল।
রাত ন’টা। মোহাম্মদীয়া সুপার মার্কেটের গলি দিয়ে সোবহানবাগ কলোনির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে লাঠি হাতে ২৫-৩০ জন তরুণ। দলটি রাস্তা পার হলো, ফুটপাত ধরে নীরবে চলে এলো রাপা প্লাজার সামনে। দলটি রাপার সামনে থেকে রাস্তা পার হয়ে ২৭ নম্বরের মূল চত্বরের সামনে চলে আসল। এবার তারা আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে আক্রমণ করল শিক্ষার্থীদের ওপর। শিক্ষার্থীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝপাঝপ পড়তে থাকল লাঠির বাড়ি। সবাই দিক-বিদিক ছুটে গেল। ফাঁকা হয়ে গেল আন্দালন মঞ্চ, ২৭ নম্বরের মূল চত্বর। আকস্মিক চারপাশে স্থবিরতা নেমে এলো। পুরো দৃশ্যটাই ঘটল দায়িত্বরত পুলিশের সামনে। এখানে প্রতিবাদী শিল্পী মাকসুদের দু’টো গানের লাইন রইলো- ‘গণতন্ত্র মানে সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে গুলি (লাঠি) চালায়/ আর পাশে দাঁড়ানো পুলিশ আনন্দে দেখি নাকে আঙুল চালায়’! শিক্ষার্থীরা পালালেও আক্রমণকারীর দলটা আরও প্রায় আধাঘন্টা ২৭ নম্বর ও এর আশপাশের এলাকায় টহল দেয়। এ ঘটনায় হতাহতের খবরতো মিডিয়ায় রাষ্ট্র হয়েছে, তাই এটা আর নাই বা লিখলাম…
একাত্তরের স্লোগান ‘জয় বাংলা’। সেই স্লোগানেই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা। ব্যাপারটা কেমন ঘোলাটে! আন্দোলনের ভেতরে ঢুকে কারা এই জাতীয় স্লোগান ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালালো?
লেখাটা আরেকটু দীর্ঘ করব একটা অনুরোধের কারণে। সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করুক বা না-ই করুক, প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিক বা না-ই দিক, অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী অর্থবছর থেকে শিক্ষার্থীরা ভ্যাট দিক বা না-ই দিক, দরকার পড়লে পড়ালেখা ছেড়ে দিক, ভ্যাটের পরিবর্তে ট্যাক্স হোক আর না-ই হোক… সরকারের যা খুশি, তাই-ই হোক, দুর্বৃত্তরা শিক্ষার্থীদেরকে মারুক, আমাদের পরিবার সর্বস্বান্ত হোক… কিছুতেই কিছু বলবো না। শুধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটার অপব্যবহার করবেন না। কেউ-ই না। না রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, না শিক্ষার্থী, না, কেউ না। প্লিজ…
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)