‘কৃষি সাংবাদিকতা’ প্রথমবারের মতো অভিষিক্ত হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে। সম্মানিতও হলো সর্বোচ্চ সম্মানে। বাংলাদেশে কৃষি সাংবাদিকতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া মানুষটি পেলেন ২০১৮ সালের স্বাধীনতা পুরস্কার। সাধারণ মানুষের কাছে তার পরিচিতি ‘মাটি ও মানুষের শাইখ সিরাজ’ হিসেবে। মূলত টেলিভিশনের মানুষ হলেও তার এক স্থায়ী পরিচয় তিনি মাঠের মানুষ। কৃষকের ফসলী ক্ষেতের সঙ্গে তার জীবনের এক দুই তৃতীয়াংশ সময়ের সংযোগ। এই সংযোগের ভেতর দিয়ে তিনি যে কাজটি করেছেন, তা হলো আমাদের দেশে কৃষিকে সাংবাদিকতার মূলধারায় এনেছেন। অর্থাৎ ফসল উৎপাদনের খবর বা কৃষকের ভালোমন্দের খবরকে তিনি জাতীয় অগ্রহণ্য সংবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তার অব্যাহত সংগ্রাম সবারই চোখ খুলে দিয়েছে।
আজ থেকে মাত্র ১০/১২ বছর আগেও টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় কৃষি সাংবাদিকতার চলন ছিল না। অর্থনৈতিক সংবাদ ও এই বিভাগের সঙ্গেই কৃষি যুক্ত ছিল। কিন্তু এখন সব টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান যেমন আছে, আছে কৃষি সাংবাদিকতার পৃথক একটি ক্ষেত্রও। এর জন্য পৃথক বিশেষায়িত সাংবাদিকও কাজ করছেন। বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলোতে আজ কৃষির সাফল্য নিয়ে বৃহৎ কলেবরে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হয়। কৃষি বিষয়টিকে উপজীব্য করে অনেক গঠনমূলক শিল্প-পরিকল্পনা করা হয়। এর পেছনে শাইখ সিরাজের নিরন্তর কর্মোদ্যোগ যেমন রয়েছে রয়েছে ধারাবাহিক কিছু চিন্তা।
চিন্তাগুলো যথাক্রমে ১. কৃষককে শুধু ধান ও পাট চাষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বহুমুখী চাষ কৌশল ও বাজারের সঙ্গে পরিচয় ঘটানো, ২. ‘চাষা’ পরিচয়ে কৃষককে গৌণ করার সংস্কৃতির অবসান ঘটানো ও কৃষকের মর্যাদা বৃদ্ধি করা, ৩. কৃষকে অধিকার সচেতন করা, ৪. কৃষকের মানসিক হতাশা দূর করে বিনোদনের পথ দেখানো ও তাদেরকে মূলধারার বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত করা ও ৫. দেশের সাংবাদিকতার গতিমুখ শেকড়ের দিকে ধাবিত করা। এই কাজগুলো একটি দীর্ঘপ্রসারি ও কঠিন কাজ। যেটি এককভাবে তিনি চালিয়ে যেতে পেরেছেন। টেলিভিশনে তার কৃষি বিষয়ক একেকটি প্রতিবেদন ও অনুষ্ঠান যেমন বেকার যুবক-যুবতি, গৃহবধূ থেকে শুরু করে সমাজের তৃণমূল শ্রেণীকে উদ্বুদ্ধ করেছে, একইভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে টেলিভিশনের উপস্থাপক, সাংবাদিক, পত্রিকার সাংবাদিক ও লেখককে। উদ্বুদ্ধ করেছে কৃষি সম্প্রসারকদেরও।
গত শতকের আশির দশকের গোরা থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ উপস্থাপনার দিয়ে দর্শকের কাছে শাইখ সিরাজের এক অভূতপূর্ব উপস্থাপনাশৈলী ধরা পড়ে। বাচনভঙ্গি, ক্যামেরার সামনের চলাফেরা, পোশাক আর কৃষকের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অপূর্ব এক দক্ষতার ফলে অপরিসীম জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। ১৯৯৯ সালে চ্যানেল আই প্রতিষ্ঠার সময় থেকে কৃষিকে সংবাদ হিসেবে তুলে আনার সংগ্রামটি ছিল তার একক। ২০০৪ সালে তিনি চ্যানেল আইতে শুরু করেন হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান। প্রেক্ষাপটগুলো দেশের কৃষি অনুরাগী সব মানুষেরই জানা। ২০০৬ সাল থেকে তিনি যখন তার নিজের পরিচালিত এই গণমাধ্যমে প্রতিদিনের সংবাদে একটি করে কৃষি সংবাদ যুক্ত করেন তখন তা অনেকের কাছেই বৈপ্লবিক মনে হয়েছে। তার নিজস্ব সংবাদ বিভাগের কাছেও বিষয়টি ছিল ছন্দপতনের মতো। কিন্তু তিনি একাট্টা থেকে এই বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়েছেন। কৃষকের সবুজ মাঠের খবর, কৃষকের কষ্টক্লিষ্ট কিংবা হাস্যজ্জল চেহারা আর তার বক্তব্যের ভেতর যে যাদু লুকিয়ে আছে তা তিনি অনুভব করেছেন বহু আগে। এর জন্য নানা ভাংচুরও হয়েছে। এই সংবাদের যে শক্তি তা উপলব্ধি করা গেছে অল্পদিনেই। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশের টেলিভিশন ইতিহাসে প্রথম চ্যানেল আইতে প্রতিদিন ১০ মিনিটের কৃষি বুলেটিন শুরু করেন শাইখ সিরাজ। প্রতিদিন বিকেল সোয়া পাঁচটায় চ্যানেল আই কৃষি সংবাদ নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে। চ্যানেল আই কৃষি সংবাদের সুবাদেই স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকদের মধ্যে মাঠের চিত্র ও খবর সংগ্রহের একটি তাগিদ তৈরি হয়েছে। চ্যানেল আইয়ের জেলা প্রতিনিধিরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি সংবাদ সংগ্রহ করার কারণে অন্যান্য সাংবাদিকদের মধ্যেও এর প্রভাব পড়েছে। সকল টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় এর সফল প্রতিফলন ঘটেছে। বিশ্বব্যাপীই উন্নয়ন আর উৎপাদনঘনিষ্ঠ সাংবাদিতাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এখন। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি উন্নয়ন ভাবনায় বরাবরই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতা বিকাশের মুখে নাগরিক জীবনের চাকচিক্য আর আভিজাত্য বেশি আকর্ষণ করার কারণে তৃণমূলের উৎপাদনঘনিষ্ঠ বিষয় বড় দাগে সাংবাদিকতার উপজীব্য হতে পারেনি। কিন্তু আজ থেকে দেড়’শ বছর আগে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬) যখন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর এম এন প্রেস থেকে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা বের করেছেন তখন তার সাংবাদিকতা ও লেখনীর মূলে ছিল গ্রামীণ তৃণমূল শ্রেণী ও মেহনতি মানুষের মুক্তি। তিনি ঠিকই তার লেখনী ও কর্মসাধন দিয়ে চিনিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও চেতনার মূলধারা কোনটি। খেটে খাওয়া কৃষক ও মেহনতি মানুষের মুক্তিই সমাজ বিনির্মাণের পথে সবচেয়ে বড় মন্ত্র, একথা তার চেতনা ও কাজের ভেতর দিয়ে আমরা পাই। তার ধারাবাহিকতায় গ্রামীণ সাংবাদিকতার বাতি ভেতরে ভেতরে জ্বলেছে। বাংলায় অজস্র পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে যেখানে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে গ্রামীণ জীবন জীবিকা। সাহেবি জমিদারী জীবন, উচ্চাকাঙ্ক্ষাময় শহুরে জীবন, চেতনা আর সৃজনশীলতার নানা বিষয় এসেছে, কিন্তু তা জীবন জীবিকাকে উপেক্ষা করে নয়, বরং গ্রামীণ জীবনকে সঙ্গী করে। এই কয়েক দশক আগেও গ্রামীণ জীবন জীবিকাই ছিল আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির প্রধান পটভূমি। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সাংবাদিকতা মোড় নিয়েছে মানুষের দাবি, আকাঙ্ক্ষা আর নাগরিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে। কিন্তু এর ভেতরেও মানুষের চোখ খুলে দিতে বাংলার কৃষি ও কৃষকের জীবন যন্ত্রণা থেকে শুরু করে তৃণমূলের সংগ্রামের কথকতা তুলে ধরতে হাজির হয়েছেন মোনাতাজ উদ্দিন। তিনি গ্রামীণ জীবনের গভীর কিছু সত্য তুলে ধরেছিলেন। দেশব্যাপী সাড়া জাগায় তার কাজ। তিনি পেয়ে যান চারণ সাংবাদিকের উপাধি। কিন্তু বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘকাল ব্যাপী গ্রামীণ জীবন-জীবিকার খুব নিগুঢ় দৃশ্যপট তুলে ধরছেন একজনই, তিনি শাইখ সিরাজ। বাঙালির জীবন সংস্কৃতির মূলধারা কৃষি নিয়েই তার কাজ। শুরুটা তার বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে আশির দশকের একেবারে গোড়ায়। তারপর পেরিয়েছে প্রায় চারদশক। বিরামহীনভাবে তিনি কাজ করে চলেছেন কৃষি ও কৃষকের জন্য। কৃষকের মাঠে, সুখে দুখে তিনি সবসময় উপস্থিত। কৃষকের সাফল্য ব্যর্থতায় তিনি সবচেয়ে নিটকতম এক স্বজন হয়ে আছেন। তিনি শুধু কৃষকের বক্তব্য তুলে এনে, তার সাফল্যের বা ব্যর্থতার খবরটিই টেলিভিশনে তুলে ধরেননি। তিনি দৃঢ়ভাবে কৃষকের পক্ষ নিয়েছেন এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। তার এই সাবলীল, স্বার্থহীন ও কিছুটা ক্ষ্যাপাটে কর্মকাণ্ড অনেকের কাছেই বিস্ময়কর। মেহনতি কৃষক থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে গেছে তার এই নিরলস কর্মসাধনার ইতিবাচক দিক।
শাইখ সিরাজ তার কাজের ক্ষেত্রটিকে নিজের মতো করে তৈরি করেছেন। তিনি কারো তৈরি করা পথে হাঁটেননি বরং নিজের পথটিকে এভাবে প্রশস্ত করেছেন যেখানে বহু মানুষের কর্মপ্রয়াস, চিন্তা ও স্বপ্ন দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে যখন যুক্ত হন বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, খেলাধুলার সংবাদ উপস্থাপনার কাজে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘মাটি ও মানুষ‘ উপস্থাপনা করেছেন টানা ১৪ বছর। তারুণ্যে উদ্দীপ্ত সময়টিতে তিনি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার শৈলী নিয়েই শুধু ব্যস্ত থাকেননি, কৃষি সম্প্রসারণে রাষ্ট্রের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছেন। গ্রামে গ্রামে দুগ্ধ খামারের সঙ্গে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন, স্কুলপ্রাঙ্গণে বাগান গড়া, ছাদে কাজী পেয়ারার বাগান গড়া, বারান্দায় মুরগী খামার স্থাপন সর্বোপরি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে মাছ চাষ সম্প্রসারণে তার অভূতপূর্ব ক্যাম্পেইন হাকীম আলীর মৎস্য খামার। এই কার্যক্রমগুলো অনেক বেশি জনপ্রিয় ও চিত্তাকর্ষক হওয়ার পেছনে ছিল অনুষ্ঠান নির্মাণের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার প্রয়োগ। চিত্তাকর্ষক পাণ্ডুলিপি, সুনিপুণ সম্পাদনা, সাবলীল ধারাবর্ণনা, দর্শকনন্দিত মিউজিক সন্নিবেশের মতো কাজগুলোতে তিনি মগ্ন থেকেছেন। টেলিভিশনের নানা সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েই কারিগরি দলের সঙ্গে মিশে প্রতিটি কাজের সেরাটি বের করে আনতে চেয়েছেন। তার উপস্থাপিত অনুষ্ঠানগুলো তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় তার কাজগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। মাটি ও মানুষ উপস্থাপনা কালীন সময়ে যারা বাংলাদেশ টেলিভিশনের কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন তাদের ‘মাটি ও মানুষ’ এবং শাইখ সিরাজকে নিয়ে ছিল সুগভীর পর্যবেক্ষণ। নাট্য ব্যক্তিত্ব ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের সূচনালগ্ন থেকে দীর্ঘকালের এক কর্মাধ্যক্ষ প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামু তার এক লেখায় সেসময়ের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘মেধাবী তরুণ শাইখ সিরাজ কোনও দিকে না তাকিয়ে, কারো কোনও কথায় কান না পেতে ‘মাটি ও মানুষ’কে সন্তর্পনে আগলে রেখেছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সন্তর্পনে আগলে রাখার অর্থ হচ্ছে শাইখ সিরাজ তার অনুষ্ঠান নিয়ে কারো সাথে তর্ক বিতর্ক করেননি, অনুষ্ঠান নির্মাণে ন্যুনতম সুবিধার জন্যও দেনদরবার করেননি’।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রাক্তন মহাপরিচালক প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব প্রয়াত আতিকুল হক চৌধুরী তার ‘শাইখ সিরাজ: মাটি ও মানুষের মুকুটহীন নবাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে শাইখ সিরাজের টেলিভিশন জীবন তথা তার কৃষিপ্রেমের নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যাবিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষকতার সময়কালীন এক ক্লাসের চিত্র তুলে ধরে তিনি উল্লেখ করেন, ‘শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠানে উইট নেই, হিউমার নেই, গান নেই, নাচ নেই, নেই ক্যাটওয়াক তারপরেও কেন তোমরা শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠান পছন্দ করো? ছাত্ররা বললো, উনি নায়কেরও নায়ক, উনার চেহারার মধ্যে এক ধরনের মায়া আছে যা অনেক নায়কদের মধ্যেও নেই। উনি খুব সহজভাবে সবকিছু জেনেশুনে কথা বলেন। তার এই কাজের ভেতর দিয়ে আমাদের দেশের কৃষি দারুণভাবে উপকৃত হচ্ছে।’ বাংলাদেশের বিখ্যাত ফোকলোর গবেষক প্রফেসর ড. আনোয়ারুল করীম তার ‘মাটি ও মানুষের কবি’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ও শাইখ সিরাজের গ্রামীণ উন্নয়ন নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। ‘রবীন্দ্রনাথের সমবায় শুধু গরীবদের নিয়ে ছিল না বিত্তবানরাই সেখানে প্রধান ছিল। কিন্তু শাইখ সিরাজ বিত্তবানদের কাছে যাননি- গিয়েছেন অসহায় বিত্তহীন কৃষকের কাছে। আর তাদেরকে সংগঠিত করে এক নতুন বাংলাদেশ গড়বার প্রত্যয় নিয়ে তিনি পদযাত্রা শুরু করেছেন। তার চলার সথে অনেকেই এসে জুটেছেন, আরো অনেকে আসবেন। আসতে তাদের হবেই।’
একটি বহুজাতিক কোম্পানির সাবেক কর্ণধার, লেখক ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষি আর গণমাধ্যমকে একত্রিত করে এদেশের দুটি শক্তিশালী বিষয়কে একটি ধারায় প্রবাহিত করেছেন শাইখ সিরাজ। অসামান্য উদ্ভাবণক্ষমতা আর প্রয়োগনৈপুণ্য ছাড়া এরকম নতুন দিগন্ত ছোঁয়া যায় না।’ কৃতি বিজ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাক্তন লিয়াঁজো বিজ্ঞানী ড. আব্দুল হামিদ মিয়া বলেন, শাইখ সিরাজ একটি দুঃসাধ্য সাধন করেছেন। তা হচ্ছে গবেষণাগারের বিজ্ঞানী ও মাঠের কৃষকের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়েছেন। তার এই কাজ এদেশের কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ যন্ত্রের সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়েছে।
২০০৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও শাইখ সিরাজকে খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য এএইচ বুর্মা অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। তখন এফএও’র মহাপরিচালক ছিলেন জ্যাক দিউফ। তিনি শাইখ সিরাজের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে তিনি একজন নির্ভরযোগ্য প্রচারক। তার কাজের ধরণটি পৃথিবীর সব দেশের গণমাধ্যম কর্মীর জন্যই অনুকরণীয়।’
এভাবেই শাইখ সিরাজের কাজকে সমাজের প্রতিটি শ্রেণী স্ব স্ব অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করেছেন। দেশের কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি সম্প্রসারক তো বটেই আন্তর্জাতিক মহলেও সমাদৃত হয়েছে। শাইখ সিরাজের কৃষি সাংবাদিকতা তথা উন্নয়ন সাংবাদিকতা নিয়ে কানাডার প্রখ্যাত উন্নয়ন সাংবাদিক ফ্রেড ফস্টার বলেন, যে ধারা ও নৈপুণ্য ব্যবহার করে শাইখ সিরাজ কৃষিকে সাংবাদিকতার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন তা এক অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত। তিনি যে সুদীর্ঘ সময় ধরে একনাগাড়ে কৃষি সাংবাদিকতা করছেনে বিশ্বে এমন নজির বিরল। যুক্তরাষ্ট্রের গে লর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজ এর গণযোগাযোগ বিভাগের ডীন প্রফেসর জো ফুট মার্কিন প্রশাসনের গণমাধ্যমের ধারণা বিনিময় কর্মসূচির আওতায় এক সফরে বাংলাদেশে এসে বলেন, শাইখ সিরাজের সাংবাদিকতা নিয়ে বিস্তর গবেষণার সুযোগ রয়েছে। উৎপাদন খাতের উন্নয়নে শাইখ সিরাজের সাংবাদিকতার কৌশল গণমাধ্যম শিক্ষার জন্য এক মাইলফলক। ওয়াশিংটন টাইমস এর সাবেক সম্পাদক এড কেলিও শাইখ সিরাজের উন্নয়ন সাংবাদিকতাকে দৃষ্টান্তমূলক একটি কাজ হিসেবে অভিহিত করেন।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে ‘কৃষি সাংবাদিকতা’ কোর্স শুরু হয়েছে। কোর্স চালুর পেছনে দেশি বিদেশি শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, উন্নয়ন সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি শাইখ সিরাজ যুক্ত রয়েছেন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠন ক্যাটালিস্টের তত্ত্বাবধানে ‘কৃষি সাংবাদিকতা’ নামে একটি প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়েছে। দেশের বিশিষ্ট গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞের ধারণার সঙ্গে শাইখ সিরাজের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ চিন্তা ও ধারণা সমন্বয়েই ওই গ্রন্থ রচিত হয়। এছাড়া শাইখ সিরাজের কৃষি সাংবাদিকতা ও তার অনুষ্ঠান হৃদয়ে মাটি ও মানুষ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে সুদীর্ঘ গবেষণার আলোকে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ সম্পন্ন করেছেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক এম শফিউল ইসলাম। যেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরে শাইখ সিরাজের কৃষি সাংবাদিকতার ইতিবাচক প্রভাব বিশ্লেষিত হয়েছে।
শাইখ সিরাজ চ্যানেল আইতে ২০০৪ সালে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ শুরু করার পর দিনে দিনে তার উন্নয়নমুখি গণমাধ্যম তৎপরতায় বহুমুখী মাত্রা যুক্ত করেন। যার মূলে থেকেছে কৃষি ও কৃষক। সরকারের নীতি পরিকল্পনার সঙ্গে কৃষকের সরাসরি সম্পর্ক ও সংযোগ সৃষ্টির জন্য তিনি শুরু করেন ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’। এই কার্যক্রম ১৩ বছর পেরিয়ে পৌঁছেছে ১৪ বছরে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, শাইখ সিরাজের কাজের এই মাধ্যমে কৃষকের সঙ্গে সরকারের একটি সেতুবন্ধন গড়ে উঠেছে। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রেও এই কার্যক্রম অনন্য সহায়ক। তিনি বলেন, কৃষক ও সরকারের মধ্যবর্তী সূত্রধর হিসেবে কাজ করছেন শাইখ সিরাজ। এটি আমাদের তৃণমূল জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কার্যকর এক মাইলফলক।
সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কৃষি ও কৃষককে নিয়ে শাইখ সিরাজের কর্মসাধন এক অনন্য দৃষ্টান্ত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর আর যদি কেউ কৃষি ও কৃষককে নিয়ে নিবিড়ভাবে ভেবে থাকেন, তাহলে তিনি শাইখ সিরাজ।’ শাইখ সিরাজ এর কাজের প্রভাবে শুধু গ্রামীণ জীবনে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে তা-ই নয়। শহরের সব শ্রেনীপেশার মানুষের কৃষির প্রতি নতুন এক মনোযোগ এসেছে। এই একই প্রভাব লক্ষ্য করা যায় পৃথিবীর দেশে দেশেও। প্রবাসী বাংলা ভাষাভাষীরা শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠান ও সাংবাদিকতার কল্যাণেই কৃষির পালাবদল ও পরিস্থিতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ধরে রাখতে পারছেন। প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মুসা বলেন, ‘শাইখ সিরাজ তার অসাধারণ সাংবাদিকতার ভেতর দিয়ে গ্রামের মানুষকে যেমন নাগরিক অধিকারে সক্রিয় করেছেন, একইভাবে শহরের মানুষকে করেছে গ্রামমুখি ও কৃষিমুখি।’
পৃথিবীর দেশে দেশে কৃষির অভিনব ও ব্যতিক্রম অনুশীলনগুলো বছরের পর বছর ধরে শাইখ সিরাজ তার টেলিভিশন কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে তুলে ধরছেন। এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তের কৃষি প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার ও অনুশীলন বাংলাদেশে পৌঁছে যায়। অন্যদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাত দিয়ে কৃষি উৎপাদনের যে সাফল্যের তথ্যগুলোও উঠে আসে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশিদের ‘কৃষি দক্ষতা’ আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে। এক্ষেত্রে শাইখ সিরাজের দুটি তৎপরতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে ‘ফিরে চল মাটির টানে’ও অন্যটি ‘ছাদকৃষি’। ফিরে চল মাটির টানে নামে নাগরিক শিক্ষার্থীদের কৃষি সম্পর্কিত ব্যবহারিক ধারণার কার্যক্রম শুরু হয় ২০১১ সালে। নগরের অভিজাত পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী যার গ্রাম ও কৃষি সম্পর্কে মোটেই ধারনা নেই তাদের কৃষির সংস্পর্শে আসার সুযোগ তৈরি হয়। মাটির স্পর্শ করে তারা মাটির সন্তান হিসেবে নিজেদের বিশ্বাসকে শাণিত করার সুযোগ পায়। শাইখ সিরাজ ফিরে চল মাটির টানে কার্যক্রমে একেবারে নতুন প্রজন্মকেও যুক্ত করেন। যারা পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। জীবনের একেবারে শৈশবেই মাটির সঙ্গে তাদের সংস্পর্শ ও কৃষিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ তাদের মনোযোগ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এদিকে নাগরিক জীবনে কৃষির এক নতুন প্রবাহ শুরু হয়েছে ‘শাইখ সিরাজ’ এর ছাদকৃষি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রেক্ষাপটে নগরে সবুজায়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন নগরবাসী। তারা বিপুল উৎসাহে ছাদকৃষি শুরু করে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা যেমন পূরণ করছেন, অন্যদিকে নগর পরিবেশ উন্নয়নেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
শাইখ সিরাজের কর্মপদ্ধতি ও সাংবাদিকতার প্রতি অন্যরকম এক বিশ্বাস গড়ে উঠেছে কৃষি সম্প্রসারকদেরও। দেশের কৃষিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের বড় অংশটিই বিশ্বাস করেন, শাইখ সিরাজ গণমাধ্যম পরিচালনা ও সক্রিয় সাংবাদিকতার ভেতর দিয়ে শক্তিশালী কৃষি সম্প্রসারকের ভূমিকাই পালন করে চলেছেন। আজকের দিনে সরকারি কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার ভেতরেও শাইখ সিরাজের টেলিভিশন কার্যক্রমের অনুসৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কৃষিকর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে মাঠের বিভিন্ন চিত্র ও সম্ভাবনা নিয়ে ভিডিও ধারণ করে তা ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করছে। এটিও দারুণ কার্যকর এক তৎপরতা। কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার ভেতরেই এখন এমন বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে, গণমাধ্যম কৃষি সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। কখনো কখনো কৃষিবিদদের ভেতর থেকে কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, শাইখ সিরাজ কৃষিবিদ না হয়েও কৃষি বিষয় নিয়ে কেন কথা বলেন? কিন্তু তার কাজের গভীরতা, কৃষির সংকট তুলে আনার আন্তরিক প্রয়াস দেখে কৃতি কৃষিবিদরাই আবিষ্কার করেন, তিনি কৃষককে সচেতন করে না তুললে, কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কৃষকের অন্ত:সম্পর্ক উন্নয়নের আহ্বান বারবার না জানালে সম্প্রসারণ ক্ষেত্রেও এমন সাফল্য হয়তো আসতো না। কর্মনিষ্ঠ কৃষি কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করার ক্ষেত্রেও তার কাজ যথেষ্টই ভূমিকা রেখেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৪৬টি বছর পেরিয়েছে নানা চরাই উৎরাইয়ের ভেতর দিয়ে। পরিবেশটি সবসময় মসৃণ ছিল না। রাজনৈতিক পালাবদল, সংঘাত, সহিংসতা, বিদ্বেষ নানামুখী শোষণ আর নৈরাজ্য মানুষের এক অনিবার্য নিয়তি হয়েই ছিল। এর ভেতর দিয়েই কৃষককে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। দারিদ্র, অপ্রাপ্তি আর কষ্টই থেকেছে তার নিত্যসঙ্গী হয়ে। কৃষকের কথার মূল্য ছিল না। অভিযোগ অনুযোগ তুলে ধরার কোনও পথও ছিল না। এই জায়গাটিতেই উন্নয়নের এক অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন শাইখ সিরাজ। তার পথ পরিক্রমা সবসময় থেকেছে দেশের পক্ষে, তৃণমূল মানুষের পক্ষে, কৃষকের পক্ষে। যাদের জীবন-জীবিকা ও স্বপ্নের মধ্যেই আছে দেশের আপামর জনসাধারণ।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কিংবা গণমাধ্যম তৎপরতায় শতভাগ পেশাদারিত্বের যেমন অভাব রয়েছে একইভাবে সাংবাদিকতার মহত্ব ধরে রাখার মতো মানসিকতা ধরে রাখার নজিরও কম। সুদীর্ঘকাল ধরে সাংবাদিকতা কিংবা গণমাধ্যম পেশায় থেকে নীতির প্রশ্নে আপোষ না করার মানসিকতা এখানে বিরল। সরাসরি রাজনৈতিক সংস্পর্শ, বাণিজ্যিক গড্ডালিকা প্রবাহে নৈতিকতা জলাঞ্জলি দেয়ার মতো বহু ঘটনাই ঘটে, কিন্তু শাইখ সিরাজ সুদীর্ঘকাল একই গতিতে তার নিজের কাজে মনোযোগী। গণমাধ্যম ব্যবসায় তিনি এবং তাদের ব্যবসায়ী অংশীদারদের সাফল্য ও সুনাম দুইই রয়েছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছে তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, শ্রম ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। শাইখ সিরাজ প্রতিটি গণমাধ্যম তৎপরতায় যথেষ্টই পরিমিতিবোধ ও সংযমের নজির গড়েছেন। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকার প্রমাণ মেলে চ্যানেল আই-এর পরিচালনার মধ্য দিয়ে। আজ দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে চ্যানেল আই প্রিয় এক গণমাধ্যম, যেখানে গণমানুষের চিন্তা ও ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটছে সবসময়।
শাইখ সিরাজকে কৃষি সাংবাদিকতায় স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কার্যত এদেশের উন্নয়ন সাংবাদিকতাকেই উৎসাহিত করেছেন। গত এক যুগে তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়নমুখী সাংবাদিকতার গতি ত্বরান্বিত হচ্ছে। আগামীতে এই গতি আরো বেগবান হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।