ছোট্ট একটি পরিবারের এ গল্প । মা-বাবা আর তিন ভাইবোন নিয়ে সেই পরিবার। ছোট্ট পরিবারের বড় ছেলেটির স্বপ্ন; সেও বড় হয়ে একদিন বাবার মতো কৃষক হবে। সোনার মাটি চাষ করে ফলাবে সোনালী ফসল। যে ফসল দেখে মায়ের মুখে ফুটবে হাসি। আনন্দ অশ্রুতে ভিজবে দুঃখী বাবার চোখ।
সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটি আজ অনেক বড়। মা-বাবার মুখে হাসি ফুটিয়েছে। সেই হাসি ছড়িয়ে গেছে সারা গ্রামের মানুষের মুখ থেকে মুখে। তবে সে হাসি কৃষক হয়ে নয়, বিসিএস ক্যাডার হয়ে। তার নাম সন্দীপ সরকার।
৩৪তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সন্দীপ যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশে। শুধু তাই নয়, প্রশিক্ষণে সবচেয়ে ভালো করায় পেয়েছেন ‘বেস্ট প্রবেশনার’ অ্যাওয়ার্ড। তার এই সফলতার পেছেনে রয়েছে নিরলস অধ্যবসায়। একবেলা খেয়ে আর পরের বেলা না খেয়ে থাকতে হয়েছে বহুদিন। এমনকি অর্থাভাবে বন্ধ হতে বসেছিলো তার পড়ালেখা। তবুও থেমে থাকেননি সন্দীপ। নিজের প্রতি প্রচণ্ড আস্থা আর বড় হবার অদম্য আকাঙ্ক্ষাই আজ তাকে এনে দিয়েছে সাফল্য।
মেধাবী পুলিশ কর্মকর্তা সন্দীপের জীবনের প্রতি পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে শ্বাসরুদ্ধকর গল্পের একেকটি অধ্যায়। যেখানে আছে আশা, আছে হতাশা আর কান্না ভুলে ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য সাফল্যগাথা।
সাতক্ষীরার তালা থানার প্রত্যন্ত মাদরা গ্রামে বেড়ে ওঠেন সন্দীপের। ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতেন। বয়স যখন পাঁচ ছুঁই ছুঁই, তখন গ্রামের অন্য ছেলেদের সঙ্গে যাওয়া শুরু স্কুলে। মাদরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেন সন্দীপ। তবে কেউ তখনো আঁচ করতে পারেনি কী অদম্য মেধা নিয়ে বেড়ে উঠছেন তিনি।
২০০৫ সালে মাদরা অগ্রণী হাই স্কুল থেকে জিপিএ ৪. ৪৪ নিয়ে এসএসসি পাশ করেন। স্কুলজীবন শেষ করে সন্দীপের ইচ্ছা ছিলো শহরের ভাল কলেজে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু টাকার অভাবে তা সম্ভব হয়নি। পরে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাবার ইচ্ছায় ভর্তি হন শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজে। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সেসময় কলেজ শেষে বাবার সাথে জমি চাষ করতে হতো সন্দীপকে। এরই মধ্যে ২০০৭ সালে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৪. ৯০ পেয়ে কলেজ শ্রেষ্ঠ হয়ে উত্তীর্ণ হন এইচএসসিতে।
স্কুলজীবন থেকেই সন্দীপ স্বপ্ন দেখতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তার ভেতরে এ স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিলেন এলাকার বড় ভাইরা। তাদের কাছে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোমাঞ্চকর গল্পগুলো শুনতেন, তখন সেই স্বপ্নকে ছোঁয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করতো তার মধ্যে।
তবে বিপত্তি বাঁধে এইচএসসি পাশের পর। কৃষক বাবার পক্ষে ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয় কোচিংয়ে ভর্তি করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। সেসময় বাবা অনিল কৃষ্ণ সরকার মা পূর্ণিমা সরকারের পরামর্শে ২ বিঘা জমি বন্ধক রাখেন। পরবর্তীতে সন্দীপের পড়ালেখার জন্য বিক্রি করে দিতে হয় সেই দুই বিঘা জমি।
যদিও সন্দীপের পেছনে খরচ করা তার বাবার রোদে-ঘামে অর্জিত কষ্টের টাকা বিফলে যায়নি। সন্দীপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। ভর্তি হন সমাজকল্যাণ বিভাগে। তার সামনে উন্মোচিত হয় এক নতুন দিগন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কিছুদিন পরই দেখতে পান হলের বড় ভাইরা খুব মন দিয়ে মোটা মোটা বই পড়ে। ক্লাস শেষে রাত-দিন পড়াশোনা নিয়ে থাকেন তারা। তাদের কাছ থেকেই সন্দীপ প্রথম জানতে পারেন বিসিএসের কথা।
বিসিএস ক্যাডার হয়ে বড় ভাইরা যখন হলে আসতো তখন তাদের দেখে আরও ভালো লাগতে থাকে তার। স্বপ্ন বুনতে থাকেন পুলিশ হবার। সারদার মাঠে দৌড়াবার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো খুব কষ্টের ছিলো সন্দীপের। সেসময় টাকার অভাবে একবেলা খেয়ে অারেক বেলা না খেয়ে থাকতে হতো তাকে। অচেনা শহরে কেউ টিউশনিতেও নিতে চাইতো না। তৃতীয় বর্ষে উঠে অনেক কষ্টে একটি টিউশনি শুরু করেন। কিন্তু চতুর্থ বর্ষে উঠে বিসিএসের প্রস্তুতির কারণে ছেড়ে দেন একমাত্র টিউশনিটিও। শুরু হয় আবারও কষ্টের দিন। ছেলের খরচের সম্পূর্ণ টাকা পাঠানোর সামর্থ ছিলো না কৃষক বাবার। প্রতিমাসে হলের বড় ভাইদের কাছ থেকে টাকা ধার করে চলতে হতো তাকে।
কিন্ত শত কষ্টের মাঝেও নিভে যাননি সন্দীপ। মনের ইচ্ছাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন সব সময়। ক্লাস আর পড়াশুনা নিয়েই থাকতেন তিনি। এত পড়াশুনার কারণে বন্ধুদের ঠাট্টার মুখোমুখি হতে হয়েছে অনেক।
অনার্স পরীক্ষা শেষ হবার পরপরই অ্যাপিয়র্ড দিয়ে অংশ নেন ৩৩তম বিসিএসে। স্বপ্ন ছিলো পুলিশ হবার কিন্তু এবারও আশাহত হতে হয় তাকে। ৩৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করেন। প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান ফরিদপুরের চরভদ্রাসন সরকারী কলেজে। কাজে যোগদানের আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে থাকার সময় ৩৪তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নেন। সেখানে সফল হয়ে অংশ নেন মৌখিক পরীক্ষায়।
৩৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশের রাতটি সন্দীপের জীবনের এক ভয়াবহ হতাশার রাত। সে রাতে কম্পিউটারে খুঁজে পাওয়া যায় না তার রোল নম্বর। প্রচণ্ড আশাহত হন। ভেঙ্গে পড়েন কান্নায়। নির্ঘুম কাটে সারারাত। তবে এই অন্ধকার রাতের পরই যে সন্দীপের জন্য আলোকিত সকাল অপেক্ষা করছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি।
ফলাফলের পরদিন সকাল ১০টার দিকে বন্ধু উৎপল চন্দ্র দাস সন্দীপের রোল নম্বরটি খুঁজে পান পিএসসি কর্তৃক হাতে তৈরি রেজাল্ট শিটে। সেখানে সন্দীপ দেখতে পান পুলিশ ক্যাডারে দ্বিতীয় রোলটিই তার। সে দিনটিকেই জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন হিসেবে উল্লেখ করেন সন্দীপ। সেজন্য বন্ধু উৎপলের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ এ কর্মকর্তা। উৎপল বর্তমানে সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
‘‘৩৪তম বিসিএসের গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পরে যোগদানের আগেই মনে প্রবল ইচ্ছা ছিল যে আমার প্রবেশনার নম্বর যেহেতু ০২, আমি যেন দুই এর নিচে না নামি। আরও ইচ্ছা ছিল প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণের।’’
চ্যানেল আই অনলাইনকে সন্দীপ বলেন, সারদার দিনগুলিও ছিল খুবই কষ্টের। কঠোর মাঠ প্রশিক্ষণের সাথে সাথে আইনের ক্লাসগুলি, মাসিক পরীক্ষা, লাংগুয়েজ ক্লাব, নাইট ক্লাসগুলোও ছিল খুবই ক্লান্তিকর। তবুও চেষ্টা করেছি ভালো করার।
মিডটার্ম পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ শেষে চূড়ান্ত পরীক্ষায়ও প্রথম হয়ে ‘বেস্ট প্রবেশনার’ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন সন্দীপ। গৌরব অর্জন করেন প্যারেড কমান্ডার হওয়ার।
একে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে উল্লেখ করেন তিনি বলেন, এ জন্য তাকে করতে হয়েছে কঠোর অনুশীলন আর পরিশ্রম।
বর্তমানে খুলনা পাইকগাছা সার্কেলে সহকারি পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত সন্দীপ জনগণের বন্ধু হয়ে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চান। বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চান বিশ্ব দরবারে। যেখানে মর্যাদার দিক থেকে বাংলাদেশ থাকবে সবার উপরে।
সন্দীপের বিশ্বাস, ভালো কাজই বদলে দিতে পারে দেশকে, দেশের মানুষকে।