টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার কৃষক আব্দুল মালেক সিকদার তার খেতের পাকা ধানে আগুন দিয়ে ধানের মূল্যহ্রাসের প্রতিবাদ করেছেন। টাঙ্গাইল সদরসহ ১২টি উপজেলায় এবার বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭০২ হেক্টর জমিতে। আগেরবারের তুলনায় এ বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
কিন্তু ৭০ শতাংশ পাকা ধান দিনমজুরের অভাবে কৃষকেরা ঘরে তুলতে পারছে না। দিন প্রতি একজন দিনমজুরকে দিতে হয় ৯শ থেকে ১ হাজার টাকা আর বর্তমান বাজারে ধানের মূল্য ৫০০ টাকা মণ। এতে প্রায় দুই মণ ধান বিক্রি করে কৃষক একজন দিনমজুরকে (কামলা) তার মজুরি দিতে পারে। এমন অধিক মজুরিতেও দিনমজুর পাচ্ছেন না কৃষকরা। ফলে জমির পাকা ধান জমিতে থেকেই নষ্ট হচ্ছে।
ধানে আগুন দেয়া প্রসঙ্গে কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা গ্রামের কৃষক আব্দুল মালেক সিকদার বলেন, সরকার মণ প্রতি ধান কিনতে ৫শ টাকা নির্ধারণ করেছে। ধান কাটতে দিনমজুরকে দিতে হচ্ছে প্রায় মণ প্রতি এক হাজার টাকা। এরপরও ধান ঘরে তুলতে আরো খরচ। অন্যদিকে বেশি মজুরি হলেও কামলা পাওয়া যায় না। খেতে ধান পাকলেও তা ঘরে তুলতে পারছি না। তাই এক দাগের ৫৬ শতাংশ ধানে আগুন দিয়ে তা পুড়িয়ে দিয়েছি।
কৃষকদের মধ্যে দেশ জুড়ে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা ও ক্ষোভ। পরিবার পরিজন নিয়ে এই ফসলটির অপেক্ষায় থাকে তারা। কেউ ধান বিক্রি করে সন্তানকে কাপড় কিনে দেবে। কেউ মহাজনোর ঋণ পরিশোধ করবে। অথচ টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন: এই সময়ে ধানের বাজার কিছুটা কম থাকলেও কৃষক যদি ধান সংরক্ষণ করে রাখে তবে ক’দিন পরেই অধিক মূল্য পাবে।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কদিন পরে মূল্য পেতে পারলে এখন কেন নয়? তাকে কেন ধান নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে? বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক দলের কৃষক সংগঠন রয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, পার্টি, জাসদ,কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য সকল দলেরই অঙ্গ সহযোগী সংগঠন হিসাবে কৃষক সংগঠন রয়েছে। কিন্তু কৃষকদের ইস্যু করে নেতা হওয়া ছাড়া কৃষকদের অধিকার আদায়ে কি দাঁড়িয়েছে কেউ? কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তারা রাস্তায় ধান ছিটিয়ে কৃষকদের জন্য ধানের ন্যায্য মূল্য দাবি করছে৷
কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য দিতে এবং ধানের দাম বৃদ্ধির দাবিতে মানববন্ধন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে তারা বলেন, উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে টাঙ্গাইলে ধানের ক্ষেতে আগুন লাগিয়েছে এক কৃষক যা কৃষি প্রধান বাংলাদেশের জন্য লজ্জার। এক মণ ধান উৎপাদনে কৃষক যে পরিমাণ খরচ করেন বিক্রি করে মূলধনও ফেরত পাননা তারা।
কৃষকরা এ ভর্তুকি কোথায় পাবে? পুঁজিবাদীরা ব্যাংক ঋণ মওকুফ পাচ্ছে কিন্তু কৃষকরা তাদের ভর্তুকি পাচ্ছে না। অথচ এই পুঁজিবাদী, শাসকগোষ্ঠী, সরকারের আমলাদের বাড়ি-গাড়ি সব হয়েছে কৃষকের ট্যাক্সের টাকায়। তারা আরও বলেন, আজকে ধানের যে দরপতন এর জন্য এক শ্রেণির সিন্ডিকেট দায়ী। সরকার এবছর ২৬ টাকা কেজি দরে ধানের দাম নির্ধারণ করেছে কিন্তু ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে কিনছে ও তারাই আবার সরকারের কাছে ২৬ টাকায় বিক্রি করছে।
সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের সম্পদের পাহাড় তৈরি হচ্ছে আর রাস্তায় বসছে কৃষকরা। এগুলো দেখার দায় কি কৃষি মন্ত্রনালয়ের ছিলো না? অথচ কৃষি মন্ত্রী বলল,রাজনৈতিক প্রভাবে কৃষক ধানের মূল্য পাচ্ছেনা। এ রাজনৈতিক প্রভাবটা কার? যদি তাই হয় এই প্রভাবটা নিরসন করতে না পারা কি তার মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা নয়?
কৃষকদের ধানের ন্যায্য মূল্য নির্ধারনের দাবিতে রাজপথে নামছে কৃষকের সন্তানরা। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটায় তারা কেন বঞ্চিত হবে? রাস্তায় নামছে শিক্ষার্থীরা। তারা ব্যানার ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ডে লিখছে, শিক্ষার্থীদের হাতে ‘জিডিপি নয় ধানের দাম চাই, শিল্পপতি যদি তার পণ্যের দাম ঠিক করে তবে কৃষক কেন তার ফসলের দাম ঠিক করতে পারবে না? ধানের দাম কমে, চালের দাম বাড়ে কেন? কৃষি মেরে কৃষক মেরে উন্নয়ন মানি না, কৃষক যদি না করে ধান চাষ দেখব শাসকগোষ্ঠী কি খায়, আমরা চাষা ধানের ন্যায্য মূল্য চাই।
এসব প্ল্যাকার্ড দেখে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘সরকারকে বিপর্যস্ত ও বিব্রত করতে একটি অশুভ চক্র কৃষকদের উসকানি দিয়ে ধানের জমিতে আগুন দিয়েছে। চক্রটি গণমাধ্যমকর্মীদের সেখানে বিশেষ উদ্দেশে নিয়ে গিয়ে তা ফলাও করে প্রচার করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যেমন কৃষকদের নিয়ে ভাবতেন, তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারও কৃষকবান্ধব। তাই এসব অশুভ চক্রান্ত ও পাঁয়তারা কোনোদিনই সফল হবে না।
ধানের দাম না পাওয়া কৃষকের এই প্রতিবাদে সমব্যাথী না হয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলছেন চক্রান্ত। বাংলার কৃষক কি চক্রান্ত বুঝে? কোন সরকার কৃষক বান্ধব ও কোন সরকার কৃষক বান্ধব নয় এটা প্রমানের দায়িত্ব কি খাদ্যমন্ত্রীর না কৃষকদের? এই কথাটা মন্ত্রীদের বলতে হবে না কৃষকদের? কাঁদছে কৃষক। এ কান্না জাগিয়ে দিচ্ছে নগরবাসী শিক্ষার্থীদেরকে ও সাধারণ মানুষের বিবেককে। তারা রাস্তায় নামছে। সরকার কর্তৃক সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য দামে ধান কেনার দাবিতে রাস্তায় নামছে কৃষকের সন্তানেরা৷ খাদ্যমন্ত্রী কি এ ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢাললেন না?
সহজ সরল কৃষকদেরকে চক্রান্তকারী বলে কী উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছেন তিনি ? সরকারকে বিপর্যস্ত ও বিব্রত করতে একটি অশুভ চক্র কৃষকদের উস্কে দিচ্ছে৷ মন্ত্রীর অভিযোগ সত্যি হলে কারা এই অশুভ চক্র? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিয়ে আর কত? সব যদি প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হয় তাহলে কৃষিমন্ত্রী,খাদ্যমন্ত্রী ও কৃষক লীগের কী প্রয়োজন? জাগছে সাধারণ মানুষের বিবেক৷
কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর কৃষক সংগঠনগুলো কি আদৌ কৃষক বান্ধব হতে পেরেছে? ক্ষমতার জন্য কত জ্বালাও পোড়াও করল বিএনপি৷ এ দলটির কৃষক সংগঠনের কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর কি কোন দায় ছিলনা? পল্লীবন্ধু দাবীদার এরশাদের দল জাতীয় পার্টির কৃষক সংগঠনটিও আজ কোথায়? কেন কৃষকদের পক্ষে একাট্টা হচ্ছেনা সব?
কৃষি নির্ভর দেশটিতে কেন কৃষকরা ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত হবে? আর এই বঞ্চনার প্রতিবাদকে বলা হবে চক্রান্ত? এরকম শত্রু জুজুর ভয় দেখিয়ে আর কতদিন? ডাকসু ভিপি নূরকেও বলা হল ছাত্র শিবির। ছাত্রলীগ চেঁচিয়ে বলল শিবির ভিপি মানিনা। অথচ পরে জানা গেল নূর একসময় ছাত্রলীগ করতো সে কখনও শিবির করেনি। ধানপোড়ানো কৃষক তথা কৃষকের ক্ষোভকেও কি এই পুরনো শত্রু জুজু দেখিয়েই তবে দমানোর চেষ্টা হচ্ছে? মন্ত্রী মহোদয় স্পষ্ট করে বলবেন কি এই অশুভ চক্রান্তটা কার?
ছাত্ররা উত্তাল হয়ে উঠেছে। কোন মন্ত্রীর পক্ষে কি সম্ভব হয়েছে তাদের দমাতে? ছাত্ররাও কি নির্ভর করতে পেরেছে কোন মন্ত্রীর প্রতি? দেশে কৃষক বিদ্রোহ হলে কোন মন্ত্রীর কথায় কৃষকরা পিছু হটবে? কোন কৃষক সংগঠনের কথায় তারা পিছু হটবে? কৃষকরা নির্ভর করতে পারে এমন কৃষক বান্ধব কোন সংগঠন আছে কি দেশে?
এমন কোন মন্ত্রী আছে কি দেশে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষকবান্ধব তবে অন্য মন্ত্রীরা কেন হতে পারছেন না? হওয়াটা কি উচিত নয়? তারা কেন কৃষকদের ক্ষুব্ধতায় আরও ঘি ঢেলে দেশটাকে ঠেলে দিচ্ছে কৃষক বিদ্রোহের দিকে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)