ফ্রান্সের তখন এসেছি কয়েক মাস হয়েছে। তেমন কাউকে চিনি না। হাতে গোনা দু’চার জনের সাথে পরিচয় হয়েছে মাত্র। তাঁদের মধ্যে দু’একজন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। তাদের কাছেই জানতে পারলাম জননেত্রী প্যারিসে আসবেন ইউনেস্কোর শান্তি পুরস্কার নিতে। ভালো লাগলো শুনে যে, সেই পুরস্কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেবেন যিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’, সেই সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।
বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে কার্ড ইস্যু হলেই কেবল যাওয়া যাবে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরের সেই অনুষ্ঠানে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে একটি কার্ড সংগ্রহ করলাম। সেই থেকে শুরু হলো কখন আসবে সেই মুহূর্ত। নিজ কানে শুনবো জাতির জনকের কন্যার হাতে শান্তি পুরস্কারটি তুলে দিয়ে কিসিঞ্জার সাহেব কি বলেন। ইউনেস্কোর হলে উপস্থিত দর্শকের মুর্হুমুহু করতালির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেয়া হলো ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার। তারপর কিসিঞ্জার সাহেব শুরু করলেন বাংলাদেশের উপরে তাঁর প্রশংসাসূচক বক্তৃতা। শুনতে শুনতে মনটা ভরে উঠেছিল সেদিন। বলা যায়, সেখান থেকেই জননেত্রীর শেখ হাসিনার শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার মিশন শুরু হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৫ বছর ধরে পাহাড়ি-বাঙ্গালী সংঘাতের তৃতীয় পক্ষের কোন মধ্যস্থতার ছাড়াই শান্তিপূর্ণ সমাধানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই পুরস্কার প্রদান করেছিল। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান নেওয়া তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার জননেত্রীকে এই পুরস্কার তুলে দেন, যা নিঃসন্দেহে বিশেষ অর্থ বহন করেছিলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই কিসিঞ্জার সাহেবই বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে তলাবিহীন ঝুড়ি। এখানে যত অর্থই ঢালা হোক না কেন, তলা না থাকায় কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না!’
হেনরি কিসিঞ্জারের সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি আজ সোনার বাংলা গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবউন্নয়ন, গড় আয়ুর বৃদ্ধি, খাদ্যে উন্নয়ন, মাতৃ মৃত্যুহার, সবকিছুতেই পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। স্বাধীনতার পর যখন জনগণের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার লড়াইয়ে নেমেছিল বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশই বর্তমানে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে (বিশ্ব ক্ষুধাসূচক) পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে। ২০১৭ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮ নাম্বারে এবং পাকিস্তানের ১০৬। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি, দেশের ভিতরের অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন, ইন্টারনেট বিপ্লব, এমনকি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালুর প্রক্রিয়া শুরুর মত উন্নয়নের এক মহোৎসব চলছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশে।
জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন দূর্বার গতিতে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছে, যখন হেনরি কিসিঞ্জারের উত্তরসূরিরা এসে বাংলাদেশের সাথে এক হয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার ঘোষণা দিচ্ছে, ঠিক তখনই দেশ বিরোধী একটি গোষ্ঠী দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। একাত্তরে যেসব দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তারাও যখন হাসিনা সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তখন দেশের ভিতরের শক্ররা ক্ষমতায় যাওয়া নেশায় সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
পাকিস্তানের আইএসআইয়ের প্রেসক্রিপশনে চলা তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশের অভ্যন্তরে ড. কামাল হোসেন ও তার জামাতা ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, ড. ইউনুছ, শফিক রেহমান, অণু মোহাম্মদ, ডাঃ জাফর উল্লাহ গংরা সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ভিতরে ও বাহিরে একের পর এক ষড়যন্ত্র করেই চলেছে। পদ্মাসেতু থেকে দুর্নীতির অজুহাতে বিশ্বব্যাংকের টাকা প্রত্যাহার থেকে শুরু করে সর্বশেষ দুর্নীতির দায়ে সাজা হওয়া বেগম খালেদার জিয়ার মামলার আইনি পরামর্শক হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে আইনি পরামর্শককে নিয়োগ দেওয়া , সবই স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্রে অংশ। লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের নির্দেশে আইএসআইয়ের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক ব্লুপ্রিন্ট নির্বিঘ্নে দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে দেওয়া এবং বহির্বিশ্বে খালেদা জিয়ার পক্ষে তদবির করার জন্য আইনি পরামর্শকের আড়ালে মূলত লবিস্ট হিসেবে ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে নিয়োগ দিয়েছে বিএনপি।
ব্রিটেনে পোলিশ অভিবাসী পরিবারে জন্ম নেয়া লর্ড কারলাইল ২০১২ সালে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের শুনানিতে যুদ্ধাপরাধের বিচারে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিপক্ষে বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়েছিলেন এই আইনজীবী। যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং মীর কাশেম আলীর আইনি পরামর্শক ও লবিস্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন লন্ডনের শীর্ষস্থানীয় ব্যারিস্টারদের চেম্বার ‘ফাউন্ড্রি চেম্বারসের সাবেক প্রধান লর্ড কার্লাইলক।
তারও কিছুদিন আগে ড. কামাল হোসেন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি খালেদা জিয়ার মামলায় আইনি পরামর্শ দেবেন। তার কয়েকদিন পরেই কারলাইলের আবির্ভাব এবং একই ঘোষণা জাতিকে বিস্মিত করেছে। কামাল সাহেবের সাথে লর্ড কারলাইলের সখ্যতা ও যোগাযোগ বেশ পুরনো বলে শোনা যায়। ব্রিটিশ সাংবাদিক ও ড. ইউনূসের পক্ষে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে লবিস্ট হিসেবে সুনাম অর্জন করা ডেভিড বার্গম্যানও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় আদালত কর্তৃক সাজা ভোগ করেছিলেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে আইএসআইয়ের প্রেসক্রিপশনে তারেক জিয়ার নেতৃত্বে শেখ হাসিনা ও স্বাধীনতাবিরোধীরা আবার এক হচ্ছে কি-না সেটাই এখন ভাববার বিষয়। বিভিন্ন ধরণের বার্তাবাহক হিসেবে কি থাকছেন ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড এলেক্স কার্লাইল যিনি খালেদার মামলার আইনি পরামর্শক হিসেবে অবাধে যাওয়া আসা করবেন বাংলাদেশে! তানা হলে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মীর কাসেম আলীর পক্ষের লবিস্ট হয়েও কিভাবে একই ব্যক্তিকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময় খালেদা জিয়ার মামলার আইনি পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়!
খুব অল্পদিনের মধ্যেই প্রথমবারের মত বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে বাংলাদেশ। দেশের নিজস্ব উপগ্রহ না থাকায় টিভি চ্যানেলগুলো ছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪০ লাখ ডলার ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। বাংলাদেশের নিজস্ব উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করতে পারলে ভাড়া বাবদ অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে প্রতিবছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের মত। পদ্মাসেতুর কাজ শেষ হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আরেকধাপ এগিয়ে যাবে যা অর্থনীতির চাকাকে করবে আরও চলমান।
এমন সম্ভাবনাময় একটি দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের দেশ বিরোধী চক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল শক্তিকে এক হয়ে লড়তে হবে। সংঘবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে তাঁদের যারা দেশের উন্নয়নের চাকা পেছন দিকে ঘোরাতে চায়। জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক জামায়াতিদের এজেন্ট বিএনপি ও ব্রিটিশ লর্ড এলেক্স কার্লাইলের উদ্দেশ্যকে উন্মোচন ও প্রতিহত করে আগামী নির্বাচনে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে আবারো ক্ষমতায় আনতে হবে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে চলমান রাখতে। তা না হলে আবারো বিপন্ন হবে দেশের স্বাধীনতা ও শান্তির ধারা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।