আমেরিকান নির্বাচনে কী হবে, কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, এবং নির্বাচনের পরে কী হবে তা নিয়ে কিছু বুলেট পয়েন্ট দিচ্ছি পাঠকদের জন্যে।
১। স্মরণকালের মধ্যে সব চাইতে অ-জনপ্রিয় দুই জন প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে আমেরিকায়। দুই জন ভুল-ত্রুটিতে ভরপুর প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছেন। জনগণের চোখের সামনে এদের একজনের লুঙ্গি খুলে যাবার সাথে সাথে অন্য আর একজনের পেটিকোট গায়েব হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে প্রতিযোগিতাটা এসে দাঁড়িয়েছে কে প্রমাণ করতে পারবে কার প্রতিপক্ষ কত খারাপ। নিজে কেমন সেটা মূখ্য বিষয় না।
২। গত ২০ বছরে সারা পৃথিবীতে সম্পদের একটা বণ্টন হয়েছে। উন্নত বিশ্ব থেকে প্রচুর সম্পদ হাতবদল হয়ে এসে পৌঁছেছে মূলত এশিয়ায়। সম্পদের খেলায় কাউকে জিততে হলে, অন্য জনকে হারতে হবে। উন্নত বিশ্ব থেকে সম্পদের যে ট্রান্সফার হয়েছে, এতে করে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য উইনার এবং লুজার।
আমেরিকা কিংবা ইউরোপের অল্প শিক্ষিত শ্রমিক শ্রেণী হলো এই বৈশ্বিক সম্পদ বণ্টনের লুজার বা হেরে যাওয়া পার্টি। অন্য দিকে আমেরিকার শহুরে শিক্ষিত, প্রযুক্তি জানা মানুষরা হয়েছে উইনার।
সারা পৃথিবী থেকে আমেরিকা যে মেধাগুলোকে তাদের দেশে নিয়ে আসে, তারাও প্লেন থেকে নেমেই আমেরিকার উইনারদের কাতারে উঠে পড়ছে তড়তড় করে। আমেরিকায় জন্ম হওয়া, অল্পশিক্ষিত মানুষ হা-হয়ে ভারতীয়, এশিয়ান, চাইনিজদের উন্নতি দেখছে।
ট্রাম্প হচ্ছে এই গ্লোবালাইজেশনে হেরে যাওয়া অসংখ্য মানুষের প্রথম প্রার্থী। এ কারণে ব্যক্তি হিসেবে ট্রাম্প যত খারাপ-ই হোক, সে যেই শ্রেণীটাকে প্রতিনিধিত্ব করছে, সেটা যথেষ্ট বড়। এটাই হচ্ছে ট্রাম্পের এই নির্বাচনে এত ভালো করার মূল শক্তি।
৩। ২০১৬ সালের আমেরিকান নির্বাচন নিয়ে কোন জরিপ স্থিতিশীল না। অনেক বিশেষজ্ঞ অস্থিতিশীল জরিপের প্রাত্যহিক উঠানামা দেখে একেক সময় একেক রকম বিশ্লেষণ দাঁড় করাচ্ছেন।
৪। এবারের জরিপ স্থিতিশীল না হবার মূল কারণগুলো নিচে দিচ্ছি:
ক) গত ৪০ বছরের আমেরিকান নির্বাচনে অল্প শিক্ষিত, শ্রমিক শ্রেণীর আমেরিকানরা ডেমোক্রেটিক পার্টিকে, আর উচ্চ শিক্ষিত এবং ধনী আমেরিকানরা রিপাবলিকানদের ভোট দিয়েছে। এবারের নির্বাচনে এসে এই পুরো বিষয়টা উলটে গেছে। এবার উচ্চ শিক্ষিত এবং ধনীরা, যাদের অনেকেই হচ্ছে রেজিস্টার্ড রিপাবলিকান, তারা হিলারিকে ভোট দেবে বলে জরিপকারীদের জানাচ্ছে।
অন্যদিকে গরীব এবং অল্প শিক্ষিত অনেক ভোটার, যাদের অনেকে রেজিস্টার্ড ডেমোক্র্যাট, তারা রিপাবলিকান ট্রাম্পকে ভোট দেবে বলে জরিপকারীদের জানাচ্ছে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একদলের রেজিস্টার্ড সদস্য অন্য দলকে ভোট দেবে বলে জানাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভোটের বুথে ঢুকে গেলে পুরনো অভ্যাসের বসে এদের অনেকেই হয়তো নিজ দলকেই শেষমেশ ভোট দেবে। এদের কেউ কেউ সপ্তাহে সপ্তাহে মতও পাল্টাবে, একেক সপ্তাহে একেক কথা জরিপকারীকে জানাবে।
খ) খেয়াল করলে দেখবেন এই জরিপগুলো সপ্তাহ ঘুরতেই ঘুরে যাচ্ছে। চিরাচরিত বেশ কিছু রিপাবলিকান এলাকায় হিলারি ভালো করছেন, আবার চিরাচরিত বেশ কিছু ডেমোক্রেটিক এলাকায় ট্রাম্প জরিপে ভালো করছেন। এর মূল কারণ অনেক মানুষ তাদের দীর্ঘদিনের মতাদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে, যুক্তি খাটিয়ে ভোট দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মানসিক সংঘাতে পড়ছে। এই সংঘাত সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করার মত কোনো তথ্য-উপাত্ত কারও কাছে নেই।
গ) অনেক ট্রাম্প ভোটার, যারা শিক্ষিত, তারা লজ্জায় ট্রাম্পের কথা মুখে বলছেন না জরিপকারীদের। আবার অনেক কট্টর রিপাবলিকান হিলারিকে ভোট দেবেন, কিন্তু মুখে বলছেন না। দুই দলের দুই প্রার্থী দুই দলের কাছে এত বেশি বিষাক্ত যে, অনেকেই এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। এর প্রতিফলন জরিপে পড়ছে।
ঘ) বিভিন্ন স্টেটে কালোদের ভোটার হিসেবে হার কমছে, হিস্প্যানিকদের বাড়ছে। কিন্তু এই হিস্পানিকদের অনেকেই নতুন ভোটার। জরিপে এদের ভোট হিলারি ঠিকই পাচ্ছেন, কিন্তু আসল ভোটের মাঠে হিস্প্যানিকরা যদি হাজির না হন, তাহলে জরিপের সঙ্গে ভোটের তারতম্য হবে। অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের যারা সমর্থক, তারা পুরনো ভোটার, এবং প্রচণ্ড অনুপ্রাণিত।
৫। উপরের ৩ এবং ৪ নম্বর পয়েন্টে বোঝানোর চেষ্টা করলাম জরিপগুলো দ্রুত পরিবর্তনশীল, সুতরাং প্রাত্যহিক জরিপের লাইভ কমেন্ট্রি পড়তে গেলে যে কোনো বিশ্লেষকের বড় প্রবণতাটি ধরারসুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।
৬। তাহলে প্রশ্ন হলো বড় প্রবণতাগুলো কী? নিচে বড় প্রবণতাগুলো বলে লেখা শেষ করছি:
ক) আমেরিকান নির্বাচনের সব চাইতে বড় যে কথা সেটা হলো যে, নিজের দেশের ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। আমেরিকা চালায় কংগ্রেস এবং সিনেট, এর পাশাপাশি আমেরিকান জুডিশিয়ারি এবং আমলাতন্ত্র। এ কারণে হিলারি যদি একা ইলেকশন জেতেন, কিন্তু সিনেট ও কংগ্রেস রিপাবলিকানদের হাতেই থেকে যায়, তাহলে তিনি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তেমন কিছু করতে পারবেন না।
অন্যদিকে, ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন, আগামী ২ বছর পর সিনেট ও কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটরা জিতে যাবে, এবং দুই হাউজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নেবে। সেক্ষেত্রে হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে যা করতে পারতেন না, ডেমোক্র্যাটরা তা করতে পারবে। এ বিষয়টা মিস করা যাবে না।
খ) আমেরিকার বর্তমান যে জন-বিন্যাস (ডেমোগ্রাফি) তাতে করে ট্রাম্প কেন, যে কোনো রিপাবলিকানের পক্ষেই জেতা খুব কঠিন। শুধুমাত্র এ কারণে হিলারির জেতার সম্ভাবনা ট্রাম্পের চাইতে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। আর ব্যক্তি ট্রাম্পের নানাবিধ সমস্যার কারণে সহজ হিসেবে বলতে গেলে হিলারির আর ট্রাম্পের জেতার সম্ভবনা ৭৫% এবং ২৫%।
কিন্তু ওপরের সংখ্যা দু’টো বিভ্রান্তিকর।
বাংলাদেশ বনাম ইন্ডিয়ার যখন খেলা হয়, তখনকার বাংলাদেশের জেতার সম্ভাবনাও কিন্তু এমনই থাকে। তারপরেও মাঝে সাঝে বাংলাদেশ জেতে। সম্ভাব্যতার এই বিষয়টি সাধারণ মানুষ অনেক সময় বুঝতে পারে না। তারা ভাবে, ৭৫% সম্ভাবনা মানেই নিশ্চিত বিজয়। ব্যাপারটা আসলে তা নয়।
গ) মোদ্দা কথা হলো, শুধু অতীতের হার্ড ডাটা এবং সাম্প্রতিক জরিপের ডাটা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গেলে, এবারের নির্বাচনের ফলাফল অনুমান করার কাজটা হবে প্রচণ্ড অনিশ্চয়তামূলক। এখানে হিলারির ৫-১০ শতাংশ বড় ব্যবধানে জেতা থেকে শুরু করে, কষ্টেসৃষ্টে কোনোমতে জেতাসহ, ট্রাম্পেরও কষ্টেসৃষ্টে কোনোমতে জেতার সম্ভাবনা আছে। এর মাঝে আরও দু’টো সম্ভাবনা আছে, সেটা হলো ফলাফল ড্র হওয়া, কিংবা হিলারির সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পেয়েও জিতে যাওয়া। এই শেষের দু’টোর একটা ঘটলে নাটক জমে একেবারে থ্রিলার সিনেমায় পরিণত হতে পারে, সঙ্গে কিছু অ্যাকশন!
যদি আমার মাথায় বন্দুক ধরে কেউ বলে, বলতেই হবে কে জিতবে, তাহলে আমি শুধু এইটুকুই বলব, আমার হাতে যদি ১০০ টাকা বাজি ধরার জন্য থাকে, আমি ৭৫ টাকা হিলারি, এবং ২৫ টাকা ট্রাম্পের বাক্সে দেবো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)