সন্ধ্যা নামলেই ঘরের নারী সদস্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন টিভির রিমোট নিয়ে। এই সময়টাতে টিভি থাকে তাদের দখলে। এ সময় পরিবারের কেউ রিমোট চাইলেও তাকে চোখ রাঙানি দেওয়া হয়। কারণ হলো, ভারতীয় টিভি সিরিয়াল। গৃহবধূ কিংবা ঘরের পরিচারিকা, ছোট-বড় সবাই এই ভয়াবহ নেশায় আসক্ত। সিরিয়ালের নেশায় সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি বুঁদ হয়ে থাকেন তারা। যেন সিরিয়ালের সেই পরিবারের একজন হয়ে ওঠেন দর্শক।
দেশে ভারতীয় সিরিয়ালের কুপ্রভাব
টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়া এলাকায় গত বছর ভারতীয় সিরিয়াল দেখাকে কেন্দ্র করে ২২ বছরের সুমি আক্তারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে একই বাসার ভাড়াটিয়া রিনা বেগম।
এর আগে, ভারতীয় সিরিয়াল ‘বোঝে না সে বোঝে না’র নায়িকা পাখির নামকরণে, পাখি থ্রি-পিস কিনে না দেওয়াতে আত্মহত্যা করে বাংলাদেশের এক কিশোরী। পাখি থ্রি-পিস কিনে না দেওয়ায় স্বামীকে তালাক দেওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছিল বাংলাদেশে।
শুধু যে মেয়েদের মাঝে এই প্রভাব পড়ছে তা নয়, প্রভাব পড়ছে ছেলেদের ওপরেও। ৭ বছরের একটি ছেলেকে সিরিয়াল দেখার সুযোগ না দেওয়ায় বাবা-মায়ের ওপর অভিমান করে আত্মহত্যা করে সে। শুনতে অবাস্তব মনে হলেও ঘটনাগুলো সব বাংলাদেশেরই।
আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি নিছক বিনোদন মনে হলেও, ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর বিষাক্ত প্রভাব ফেলছে বাংলাদেশী দর্শকদের মনে। সামাজিক সম্পর্কগুলোকে নষ্ট করছে সিরিয়ালগুলো। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, একাধিক প্রেম, পরকীয়া, বউ-শাশুড়ির ঝগড়া, কূট চালে ভরপুর এই সিরিয়ালগুলোর প্রভাব পড়ছে দর্শকদের মনে। নিজেদের জীবনের সাথে নাটকের কাল্পনিক কাহিনী মেলাতে শুরু করেছেন দর্শকদের অনেকেই।
ভারতীয়রা কী ভাবছেন সিরিয়াল নিয়ে?
ভারতের এই সিরিয়ালগুলো নিয়ে ভারতীয়রাও শান্তিতে নেই। পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর কেশরী নাথ ত্রিপাঠি এসব সিরিয়াল নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। সম্প্রতি এক সভায় তিনি বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যের বিষয় কিছু চ্যানেলে এমন কিছু সিরিয়াল প্রচার হচ্ছে, যেখানে সংসারের নানান অশান্তি, ভয়ংকর ষড়যন্ত্র, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঝগড়াসহ নানান বিষয় তুলে ধরা হয়।’
পশ্চিমবঙ্গ মহিলা পরিষদে ভারতীয় এসব সিরিয়ালের কুপ্রভাবের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ জমা পড়ছে নিয়মিত। বিশেষ করে ‘এই ছেলেটা বেলবেলেটা’, ‘পুণ্যি পুকুর’, ‘মেম বৌ’, ‘রাঁধা’ সিরিয়ালে নারীদেরকে খুবই অসম্মানজনকভাবে তুলে ধরা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতীয় কয়েকজন নারী সাংবাদিক।
ভারতীয় সাংবাদিক মঞ্জিরা মজুমদার বলেছেন, ‘সিরিয়ালগুলোতে মহিলাদের অগ্রগতির আসল দিকটি তুলে ধরার পরিবর্তে তাদেরকে হীন করে তুলে ধরা হচ্ছে। হিংসা, ঝগড়া, বহুগামিতা, পরস্পরকে আক্রমণ, সর্বোপরি পুরুষ-তন্ত্রকেই ভয়ংকর ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।’
রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপারসন অনন্যা চ্যাটার্জির মতে, মহিলাদের অগ্রগতি নিয়ে যেখানে আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মত লেখিকারা একাধিক গল্প লিখেছেন, সেখানে এসব অর্থহীন এবং অবাস্তব সিরিয়াল দেখলে তার দুঃখ হয়। তিনি এগুলো বন্ধের দাবী জানান।
তবে সবাই যে বিপক্ষে কথা বলেছেন তা নয়। ভারতীয় সিরিয়ালের প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতাব বলেছেন, ‘আমরা সিরিয়ালে যা তুলে ধরছি তা সত্যি ঘটনা। যারা প্রতিবাদ করছেন, তারা কি জোর দিয়ে বলতে পারবেন সমাজে বহুগামিতা নেই?’
চাই সচেতনতা
ভারতীয় সিরিয়ালের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনটি চ্যানেল হলো স্টার জলসা, স্টার প্লাস এবং জি বাংলা। ২০১৪ সালে পাখি জামা না পেয়ে কিশোরীর আত্মহত্যার পরে সামাজিক এবং গণমাধ্যমে প্রচুর সমালোচনা হয় ভারতীয় সিরিয়াল নিয়ে। তার সূত্র ধরে, ওই বছর ১৯ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল জারি করা হয়। রুলে বাংলাদেশে ভারতীয় তিনটি টিভি চ্যানেলের (স্টার জলসা, স্টার প্লাস ও জি বাংলা) সম্প্রচার বন্ধে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। তবে এ বছর ২৯ জানুয়ারি রিটটি খারিজ করে দেওয়া হয়।
ভারতীয় সিরিয়ালের আগ্রাসন রুখতে চাই সচেতনতা। দর্শকদেরকে দেশীয় চ্যানেল এবং শিল্পীদের প্রতি আকৃষ্ট করতে চাইলে প্রথমে ভারতীয় সিরিয়ালের কুপ্রভাব সম্পর্কে জানাতে হবে। তা না হলে, ভারতীয় সিরিয়ালের বিষাক্ত ছোবলে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাবে সমাজ।