জীবন তো চলছে না। আর কত? একটু বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নেয়া হয়ে ওঠে না আজ বছর অব্দি। চাইলেই ভিড় জমানো যায় না, আড্ডা জমানো হয় না বন্ধুদের। সবাইকে আজ এক বছর অদৃশ্য এক ভাইরাস টুটি চেপে ধরে আছে। নিঃশ্বাসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ারও কোন উপায় নাই। ব্যাগ কাঁধে সেই যে ক্যাম্পাস থেকে ফেরা হলো, আর ক্যাম্পাসে ফেরা হলো না। ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাস, তেপান্তরের মাঠের সাথে যে একটা মায়া জমে আছে, তা হয়তো লিখে বোঝানোও সম্ভব নয়। খেলার মাঠগুলো বন্ধ, কিশোর-তরুণরা ঝুঁকছে মোবাইল আসক্তিতে।
ওদিকে এক বছরের পাঠ পেছনে পড়ে গেছে। বইয়ের সাথে শিক্ষার্থীদের যে একটা বন্ধন, সেটাও নীমপাতার মতো তেঁতো হয়ে গেছে। চাইলেই কেউ বই নিয়ে পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারে না। কারণ, আবদ্ধ জগতে কেবলই বই পড়ে শেখা যায়। দীর্ঘদিনের যে একটা প্রচলন, সেখান থেকে বেরিয়ে নতুন কোন পরিবেশ সৃষ্টি সম্ভব নয় মোটেও। তাই শিক্ষার্থীরা পড়ছে, পড়তে পড়তে একটা পর্যায়ে এতটাই অবসাদগ্রস্থ হচ্ছে, এরপর বইয়ের প্রতি ঝোঁকটার ধস নামে। কোন কিছু শিখতে গেলে সেটার মধ্যে যদি আনন্দ না থাকে, তাহলে সেটা শেখা হয়ে ওঠে না। ক্লাশরুমের বাইরে শিক্ষার্থীদের আলাদা একটা জগত থাকে, সেখানে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা-গল্প হয়। এখান থেকেই হয়তো কেউ কেউ সুপার ট্যালেন্ট হয়ে ওঠে। একজনের ছায়া অন্যজনের গায়ে লাগে। নিজেরা নিজেরাই শেয়ার করে পড়ার মাধ্যমে, গ্রুপ স্টাডি করার মাধ্যমে পাঠ্যভাসে দারুণ একটা প্রভাব বিদ্যমান।
শিক্ষার্থীদের পাঠ্যভাস ধরে রাখতে বেশ কিছু উদ্যোগও নিয়েছে রাষ্ট্র। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটা সফল হলেও পুরোপুরি আলোর মুখ দেখেনি। অন্তরায় হিসেবে দেখা যায়, ইন্টারনেটের ধীরগতি, ইন্টারনেটের গরম দর এবং প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের হাতে প্রযুক্তির ছোঁয়া পুরোপুরি না পৌঁছানো। অনেক শিক্ষার্থীকে দেখা গেছে, পরিবারের বড়দের ফোন নিয়ে অনলাইন ক্লাশে অংশ নিয়েছে। এরই মাঝে অটোপ্রমোশন, ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে হৈচৈ দেখতে দেখতে অনলাইন ক্লাশের কার্যক্রম ভেস্তে গেছে৷ সেশনজটে পড়ে হতাশায় ভুগছেন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। অনেকেই ভাবছেন, বয়স, অভিজ্ঞতা, ক্যারিয়ারের চেয়ে পড়াশোনায় পিছিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিকল্প কিছু ভাবা উচিত।
এই এক বছরে কম অভিজ্ঞতা হয়নি। খুব কাছ থেকেই দেখা হয়েছে মানুষের কায়দা করে বেঁচে থাকার চিত্র। তরুণ লেখক ইমরান মাহফুজ কোভিড-১৯ আসার আগেই বইমেলায় নিয়ে এসেছেন ‘কায়দা করে বেঁচে থাকো’ বইটি। পরপরই করোনার থাবা, বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ। কেউ ভালো নেই কোথাও। সময় এখন কায়দা করে বেঁচে থাকার। এ এক বছর মানুষের জীবন দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতে কতটা লড়াইয়ে নামতে হয়, তা মানুষ টের পেয়েছে হাড়ে হাড়ে।
সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া বাকি সবাইকেই বাঁচতে হয়েছে কায়দা করে। অনেক বড় বড় মানুষকেও দেখেছি, থমকে যেতে। আর পারছেন না, ব্যবসায় লাল নিশানা। দেনা করে পথে বসে চলেছেন। এও দেখা গেছে, করোনায় ঢাকা ছেড়েছেন বহু মানুষ। এরই মাঝে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। মারা গেছেন হাজারো মানুষ। দেশের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সবখানে লাশের মিছিল, এক অসহায় চিত্র দেখেছে দেশ।
আবারও একই অবস্থা শুরু হয়েছে। মাঝখানে করোনার সংক্রমণ আবহাওয়া বলি, সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত রহমতের কারণে নিয়ন্ত্রণে ছিল অদৃশ্য শক্তিটি৷ শুরু থেকেই আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি বলে চলেছি যত্রতত্র। মানিনি স্বাস্থ্যবিধির বালাই। হঠাৎ করে করোনা সংক্রশণের হার হাজার থেকে কয়েক হাজার দৈনিক। মৃত্যুর মিছিলে দৈনিক যোগ হচ্ছে দীর্ঘ সারি। ১৫-২০জনের মৃত্যুর সর্বনিম্ন রেকর্ড থেকে সে সংখ্যাটা এখন শতের সংখ্যা ছুঁইছুঁই।
করোনায় মানুষের আয় রোজগারে মন্দাভাব শুরু থেকেই। যাদের মাসিক আয় লাখ টাকা ছাড়াতো, তাদের আয় শূন্যের কোটায় এসেছে৷ এমনটাও আমরা দেখেছি৷ মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে নেমেছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। কাজ করতে অভিজ্ঞতাও হয়েছে। সামান্য খাবারের আশায় অনেক স্বচ্ছল পরিবারের মানুষ হাত পেতেছেন। অনেকে লোকলজ্জায় না খেয়ে উপোস থেকেছেন। গোপনে এসব মানুষের পাশে থেকেছেন বিত্তবানদের অনেকেই। আবার দেখা গেছে, সরকারি বরাদ্দের চাল, খাবার সামগ্রী ঘটা করে লুট করতে। সারা বাংলাদেশেই এমন চিত্র গণমাধ্যমের সুবাদে আমরা দেখেছি। আবির্ভাব হয়েছে সাহেদ, সাবরিনাদের মতো রাষ্ট্রদোহীদের।
তবুও কায়দা করে চলছে মানুষ, মানুষের জীবন। করোনাকালে ব্যবসায়িক মন্দায় বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন চরম সংকটকাল পার করেছে। যাদের দিন এনে দিন খাওয়া, তাদের চুলোই ঠিকমতো আগুন জ্বলেনি। রিকশা চালক, সিএনজি বা অন্য যান চালকদেরও কান্না দেখেছে বাংলাদেশ। এবারের লকডাউন ঘোষণার পরপরই আমরা দেখেছি, মানুষজনকে রাস্তায় নেমে পড়তে। আন্দোলন করেছে, তারা লকডাউন মানে না। লকডাউনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে জীবন চলবে কীভাবে? অধিকাংশ মানুষেরই মুখ থেকে শুনেছি, পেটে ভাত না দিতে পারলেতো এমনিই মারা যাব। করোনা হলেও যে মারা যাবে, এমনওতো না।
কিন্তু সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেনি কেউ। হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বাড়ানো, অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার যে কথা, সেটাও হয়নি। কারণ, আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নিতে পারি না। তাই বলেই, বার বার আমরা বিপদের মুখে পড়ি। আজ করোনা পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, লাশের সারিতে স্বজনদের আহাজারি থামছে না। সব কিছু থমকে আছে, তবুও মাস্ক ব্যবহার করে না অনেকে। প্রয়োজন ছাড়াই বাইরে ঘোরাফেরা, মানুষের সাথে মেশা। এভাবে চললে মানব অস্তিত্ব বড়ই সংকটে পড়বে। সুতরাং, নিজে বাঁচতে, পরিবারের লোকজনকে বাঁচাতে প্রয়োজন কায়দা করে বেঁচে থাকা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)