১৯ মে, ১৯৩৫ সাল। এই দিনে থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স নামে’ ধূর্ত ব্রিটিশ সেনা-গোয়েন্দা অফিসার ৪৭ বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। মোটর সাইকেলের প্রতি খুব বেশি আকর্ষণ ছিলো তার। অবসর পেলেই ছুটে বেড়াতেন মোটর সাইকেলে চেপে। আর সেটাই হলো তার কাল। ইংল্যান্ডের শান্ত এক অঞ্চলের রাস্তায় তার প্রিয় এই বাহনে চড়ার সময় তিনি এই দুর্ঘটনার শিকার হন, আর মারা যান ছয়দিন পরে ডরসেটের উল সামরিক হাসপাতালে। যবনিকা ঘটে বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক গুপ্তচরের বর্ণাঢ্য জীবনের।
এই অফিসারই ছিলেন আজকের মধ্যপ্রাচ্যের গড়ে ওঠার পেছনের মাষ্টারমাইন্ড ‘লরেন্স অফ এরাবিয়া’। শ্বেত চর্মের এই অফিসারটি যখন মাথায় আরবি শিরস্ত্রাণ জড়িয়ে, সাদা আলখাল্লা পড়ে, আরবি ঘোড়ায় টগবগিয়ে খোলা তলোয়ার হাতে রণক্ষেত্রে ছুটে বেড়াতেন, তখন তাকে আরব বেদুইনের চেয়ে আলাদা করা যেতো না কিছুতেই।
তরুণ এই ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোম্যান শাসনের বিরুদ্ধে যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তা-ই আজকের মধ্যপ্রাচ্যে গড়তে সাহায্য করেছে। তিনি ছিলেন আধুনিক যুগের একজন সেলিব্রেটি, যিনি নিজের প্রজন্মের এবং পরে বই ও সিনেমার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কল্পনার নায়কে পরিণত হন। তিনি ছিলেন একাধারে সামরিক কর্মকর্তা, প্রত্নতত্ত্ববিদ, লেখক ও কূটনীতিবিদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মান মিত্র তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে আরব বেদুইনেরা। আর তাদের সাহায্যার্থে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী প্রেরণ করে লরেন্সকে। তার অসাধারণ ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় তাকে অমর করে রেখেছে ‘lawrence of Arabia’ নামে।
থমাস এডওয়ার্ড লরেন্সের জন্ম ১৮৮৮ সালে ওয়েলসের ট্রেমাডগ নামক স্থানে। তার বাবা স্যার থমাস চ্যাপম্যান ছিলেন একজন প্রতাপশালী জমিদার। আর মা সারাহ জুনার ছিলেন তাদের গভর্নেস। তার পিতা আয়ারল্যাণ্ডে তার প্রথম স্ত্রী ও পরিবারকে ত্যাগ করে ওয়েলসে এসে সারাহর সাথে নতুন জীবন শুরু করেন। তারা প্রকাশ্যে নিজেদের মিস্টার এবং মিসেস লরেন্স বলে পরিচয় দিলেও বাস্তবে কখনোই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। তার পিতা তথাপি তাকে নিজ সন্তান বলেই পরিচয় দিতে কখনো কুণ্ঠিত হননি।
লরেন্স ১৯০৭ থেকে ১৯১০ পর্যন্ত অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে সম্মানসহ গ্র্যাজুয়েশান করেন। পরবর্তীতে বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ডেভিড জর্জ হোগার্থ আর লিওনার্ড উলির সাথে পেশাদার প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৯০৮ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার ট্রেনিং কোর’ (অনেকটা আমাদের বিএনসিসির মতো) থেকে দু’বছরের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও সেখান থেকে কমিশন লাভ করেন। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে তাকে সামরিক বাহিনী থেকে তলব করা হয়। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় লরেন্স আনন্দের সাথেই যোগ দেন সমরে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্য যোগ দেয় জার্মান পক্ষে। ব্রিটিশ মদদে আরব বেদুইনরা তুরস্কের খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে লরেন্সের ছিলো অটোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন পরিব্রাজনের অভিজ্ঞতা। এখানকার ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারেও ছিলেন অন্য যে কোনো ব্রিটিশ অফিসারের চেয়ে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। এই কারণে তাকেই বেছে নেয় সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ।
সেই সময় আরব বেদুইনরা ছিলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রে বিভক্ত। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আর হানাহানিতে লিপ্ত থাকলেও তারা সবাই ছিলো অটোম্যান সাম্রাজ্যের ঘোর বিরোধী। যুদ্ধে তুরস্ক জার্মান পক্ষে যোগ দেয়ার পরে ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তর এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রগুলোকে একীভূত করে এক মহাবিদ্রোহের জন্ম দেয়ার কৌশল গ্রহণ করে। যাতে তুরস্ককে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করে ফেলা সম্ভব হয়। আর এই কাজের জন্য লরেন্সকে নিযুক্ত করে তারা।
লরেন্স আমীর ফয়সালের সাথে যোগাযোগ করেন এবং সেখান থেকে অন্যান্য গোত্রপ্রধানদের আশ্বস্ত করে এক বিশাল আরব জোট গঠন করেন। তার প্রচণ্ড সাহস আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা আরবদের মুগ্ধ করে ফেলে। বিশেষ করে গোত্রপ্রধান ফয়সাল আর আব্দুল্লাহর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তিতে পরিণত হন তিনি। তাদের সম্মিলিত বাহিনীর সাহায্যে তিনি তুর্কি নিয়ন্ত্রিত রেল স্থাপনা ও মরুভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোতে একের পর এক গেরিলা হামলা চালিয়ে তুর্কি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে তোলেন। সাদা ঘোড়ায় চেপে সাদা আলখাল্লা পরিহিত লরেন্স নিজেই সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দিয়ে অসামান্য রণনৈপূণ্য প্রদর্শন করেন। অন্যান্য আরব যোদ্ধাদের থেকে তাকে পৃথক করে চেনার কোন উপায় ছিলো না।
৩রা জানুয়ারি, ১৯১৭ সালে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। নিজের প্রথম মরু অপারেশনে লরেন্স ৩৫ জন আরব যোদ্ধাকে নিয়ে একটি তুর্কি সেনা ছাউনিতে অতর্কিতে গেরিলা আক্রমণ চালান। দুঃসাহসী বেদুইনদের রাইফেলের বুলেট বৃষ্টিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় ক্যাম্পটি। ছাউনিটি দখল করা না গেলেও ব্যাপক মনোবল আসে যোদ্ধাদের মাঝে। দু’জন তুর্কি সৈনিককে বন্দীও করেন তারা।
ফিরতি পথে ঘটে দুর্ঘটনা। আনন্দের আতিশয্যে অনেক যোদ্ধাই হয়ে পড়েন মদমত্ত। নেশার ঘোরে ফয়সালের গোত্রের এক যোদ্ধা গুলি করে হত্যা করে আব্দুল্লাহর গোত্রের একজনকে। ফলে দুই গ্রুপে দেখা দেয় তীব্র বিরোধ। আব্দুল্লাহর গোত্র বদলা নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ফয়সালের গোত্র ঘোষণা দেয় আব্দুল্লাহর গোত্রের কারো হাতে তাদের গোত্রের রক্তপাত তারা হতে দেবে না। ফলে রক্তক্ষয়ী সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।
মাঝখানে এসে দাঁড়ান লরেন্স। নিজের হাতে গুলি করে হত্যা করেন সেই দোষী যোদ্ধাটিকে। তিনি যেহেতু আব্দুল্লাহর গোত্রভুক্ত নন, ফয়সালের গোত্র এই বিচার মেনে নেয়। লরেন্স কিন্তু বাকি জীবন এই ঘটনার জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি।
পুরো ১৯১৭ সাল জুড়ে তিনি একের পর এক তুর্কি ছাউনি, বিশেষত রেল লাইন ও ট্রেনের উপর হামলা চালিয়ে যান। তথাপি প্রতিটি লড়াইয়ে বেদুইনদের নিষ্ঠুরতা তাকে বিচলিত করে তোলে। বেদুইনরা ছিলো ভয়াবহ ধরণের রক্তপিপাসু আর সেই সাথে লুটেরাও। আত্মসমর্পণকৃত তুর্কি সৈন্যদের প্রতিও তারা বিন্দুমাত্র অনুকম্পা দেখাতে রাজি ছিলো না। রক্তের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠতো তারা।
একটি সভ্য দেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ হিসেবে লরেন্সের পক্ষে এসব মেনে নেয়া কষ্টকর ছিলো। কিন্তু নিজের ডিউটির কথা স্মরণে থাকায় ইচ্ছে থাকলেও এসব অকারণ খুন খারাপিতে বাধা দিতে পারতেন না। এক বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন,
‘We had a Lewis [machine gun],’ he wrote in a letter to a friend, ‘and flung bullets through the sides. So they hopped out and took cover behind the embankment, and shot at us between the wheels at 50 yards.’ The Arabs brought up a Stokes mortar, and the Turks fled across open ground. ‘Unfortunately for them,’ Lawrence continued, ‘the Lewis covered the open stretch. The whole job took ten minutes, and they lost 70 killed, 30 wounded and 80 prisoners,’ for the loss of only one Arab. While the Arabs looted the train, another Turkish force arrived, nearly cutting off the Bedouins. ‘I lost some baggage, and nearly myself,’ Lawrence added nonchalantly. In another letter about that same ‘show,’ Lawrence confided, ‘I’m not going to last out this game much longer: nerves going and temper wearing thin….This killing and killing of Turks is horrible.’
১৯১৭ সালে এক সাহসী আক্রমণের মাধ্যমে লরেন্সের বেদুইন বাহিনী সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ শহর ‘একাবা’ দখল করে নেয়। তার এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নতুন ব্রিটিশ সেনাপ্রধান জেনারেল স্যার এডমন্ড অ্যালেনবি, তাকে মেজর পদে পদোন্নতি দেন। লরেন্সের বিস্ময়কর সাফল্যের গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন তিনি। তিনি তার স্মৃতিকথায় লেখেন,
‘I gave him a free hand. His cooperation was marked by the utmost loyalty, and I never had anything but praise for his work, which, indeed, was invaluable throughout the campaign. He was the mainspring of the Arab movement and knew their language, their manners and their mentality.’
১৯১৮ সালে তালিফের লড়াইয়ে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করায় লরেন্সকে সম্মানসূচক Distinguished Service Order পদকে ভূষিত করা হয় আর পদোন্নতি দিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল করা হয়। তালিফের যুদ্ধে ৪০০ তুর্কি সৈন্য নিহত হন আর ২০০ হন বন্দী। তালিফের এই লড়াই তুরস্ককে কোণঠাসা করে ফেলে অনেকটা। লরেন্সকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দেয়ার জন্য মোটা অংকের পুরস্কার ঘোষণা করে তুরস্ক। এক সেনা কর্মকর্তা লেখেন,
‘Though a price of £15,000 has been put on his head by the Turks, no Arab has, as yet, attempted to betray him. The Sharif of Mecca [King of the Hedjaz] has given him the status of one of his sons, and he is just the finely tempered steel that supports the whole structure of our influence in Arabia. He is a very inspiring gentleman adventurer.’
যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে দামেস্ক নগরের পতন হয় আর সেখানকার আমীর একটি অস্ট্রেলীয় সেনাদলের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সেদিন ছিল ১ অক্টোবর, ১৯১৮। এই ঘটনাতে লরেন্স মনক্ষুণ্ণ হন, কেননা দামেস্ক আক্রমণের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। স্বভাবতই আত্মসমর্পণ তার কাছেই করা হবে সেটিই তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন। দামেস্কে ফয়সালকে প্রধান এক স্বতন্ত্র আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার কাজ করেন লরেন্স। কিন্তু তার এই স্বপ্ন বেশিদিন টেকেনি। ১৯২০ সালে মায়শালুনের যুদ্ধে জেনারেল গোয়ার্ডের ফরাসি বাহিনী দামেস্কে প্রবেশ করলে ফয়সালের রাজত্বের অবসান ঘটে আর সেই সাথে লরেন্সের স্বাধীন আরব প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও ভেঙ্গে যায়।
আমেরিকান সাংবাদিক লোয়েল টমাস যুদ্ধকালীন সময়ে লরেন্সের মরু অভিযানের সাথী হন। তার তোলা ছবি ও ফিল্ম থেকে বিশ্বের মানুষ এই ব্যতিক্রমী ব্রিটিশ অফিসারের লড়াই সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন।
যুদ্ধের পর লরেন্স ব্রিটেনে ফিরে গেলেও অভিযানের নেশা তাকে স্থির থাকতে দেয়নি। তিনি ছদ্মনামে বিমানবাহিনীতে যোগ দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু মিথ্যা নামটি ধরা পড়ে যায়। যদিও পরে তাকে অনুমতি দেয়া হয়। কিছুদিন পর আবার তিনি ট্যাংক বাহিনীতে নাম লেখান। নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন টি ই শো।
কিন্তু সেখানেও খাপ খাওয়াতে না পারলে আবার বিমানবাহিনীতে ফেরত আসেন। তবে পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় তাকে ভারতবর্ষে বদলি করা হয়, যেখানে তিনি ১৯২৮ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ওঠায় তাকে আবার ফেরত পাঠানো হয় ব্রিটেনে। ১৯৩৫ সালে তিনি বিমানবাহিনী ত্যাগ করেন।
লরেন্স লেখালেখি করতেন প্রচুর। অনেক নামিদামি ব্যক্তিদের সাথে তার পত্রালাপ হতো নিয়মিত। তার সেরা দু’টি কাজ হচ্ছে ‘সেভেন পিলারস অফ উইসডম’ আর ‘রিভোল্ট ইন দ্যা ডেজার্ট’। দু’টি কাজই তার আরব যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা। ‘সেভেন পিলারস অফ উইসডম’ গ্রন্থটি জনৈক ‘এস এ’কে উৎসর্গ করা হয়। যার পরিচয় কোনোদিন পাওয়া যায়নি। উৎসর্গ পাতায় লেখা ছিলো এই কবিতাটি:
I loved you, so I drew these tides of men into my hands
and wrote my will across the sky in stars
To earn you Freedom, the seven-pillared worthy house,
that your eyes might be shining for me
When we came.
যুদ্ধ অনেক বীরের জন্ম দেয়। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায় অনেকের নাম। কিন্তু লরেন্সের সৌভাগ্য তার নাম হারায়নি। ১৯৬২ সালে তার জীবনী নিয়ে নির্মিত হয় ‘লরেন্স অফ এরাবিয়া’ ছবিটি। ছবিটিকে সর্বকালের সেরা ১০টি হলিউড ছবির একটি বলে বিবেচনা করা হয়। আর এই ছবির কল্যাণে সারা বিশ্বে এক রহস্যময় মহানায়ক হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে ‘লরেন্স অফ এরাবিয়া’র নাম।