রাস্তায় গণপরিবহন না চললে সাধারণ মানুষের জীবনে কী দুর্বিষহ অবস্থা নেমে আসে, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন। এই লেখায় সেরকম একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে সাম্প্রতিক পরিবহন ধর্মঘট এবং এর পূর্বাপর নিয়ে আলোকপাত করা হবে।
জাতীয় সংসদে সম্প্রতি পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনসহ ৮ দফা দাবিতে গত রবি ও সোমবার সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করেন পরিবহন শ্রমিকরা। ফলে বন্ধ থাকে সব ধরনের গণপরিবহন। এমনকি পণ্যবাহী যাববাহনও। রাস্তায় চার চাকার ব্যক্তিগত বাহনও তারা আটকে দেন। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়ায় মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে দুটি শিশুর মৃত্যু হয়। কোথাও কোথাও চালকদের নাজেহাল করা, মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে দেয়ার মতো অসম্মানজনক ঘটনাও সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তুলেছে।
প্রশ্ন হলো, যারা এই কাজগুলো করলেন তারা কারা এবং কোন এখতিয়ারে তারা এটি করলেন? আর যাদের সাথে তারা এসব আচরণ করলেন তারাই বা কারা? সংবিধান কাকে কী ক্ষমতা দিয়েছে এবং কার ক্ষমতা আসলে কে প্রয়োগ করছেন-সেই প্রশ্নটি এখন আমাদের অত্যন্ত জোর গলায় উত্থাপন করা প্রয়োজন। কারণ শুধু এই পরিবহন ধর্মঘটই নয়, বরং রাষ্ট্রে প্রতিনিয়িত যেসব ঘটনা ঘটে, তারও অনেক ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটি শেয়ার করি। সড়কে ধর্মঘটের কারণে স্বভাবতই ট্রেনের উপরে ভয়াবহ চাপ পড়ে। সেই অবস্থায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ট্রেনের দুটি টিকিট সংগ্রহ করি। উদ্দেশ্য চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় ফেরা। রোববার রাত সাড়ে ৮টায় খুলনা থেকে ছেড়ে আসা সুন্দরবন এক্সপ্রেস চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে এসে পৌঁছায় রাত পৌনে ১২টার দিকে। প্লাটফর্মে ট্রেন থামতেই মনে হলো এক ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ট্রেনে ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি। শত শত মানুষ কে কার আগে উঠবেন তার জন্য পারাপারি। কেবিনের টিকিট কাটা যাত্রীরাও উঠতে পারেন না। আমার সঙ্গে স্ত্রী ও শিশুসন্তান। সঙ্গে দুটি ভারী ব্যাগ। স্থানীয় দুজন সাংবাদিক আমাদের এগিয়ে দেয়ার জন্য এসেছিলেন ট্রেন স্টেশনে। তাদের এবং ট্রেনের গার্ডদের সহায়তায় কোনোমতে নিজেরা উঠে সিটে বসতে পারলেও ব্যাগ দুটি ওঠানো যাচ্ছিলো না। ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে ব্যাগ দুটি তোলা সম্ভব হয়। এসময় জানালা দিয়ে দেখছিলাম ট্রেনে ওঠার জন্য মানুষের কী প্রাণপন চেষ্টা।
একজন বয়স্ক মানুষকে নামিয়ে দেয়ার জন্য প্লাটফর্মে নেমেছিলেন রেলের একজন কর্মী। কিন্তু মানুষের হুড়োহুড়িতে তিনি আর উঠতে পারছিলেন না। এরমধ্যে ট্রেন ছেড়ে দেয়। তিনি কোনোমতে ট্রেনের দরজার হাতল ধরে উঠে পড়েন এবং অনেকটা পথ এভাবে ঝুলতে ঝুলতে যান। অবশেষে কয়েকজন যাত্রীর সহায়তায় তিনি যখন ট্রেনে উঠতে পারেন তার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। বস্তুত তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন। এর পরদিনই খবর আসে, অতিরিক্ত ভিড়ে পাবনায় ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
এরপর আলমডাঙ্গা, ভেড়ামারা, ঈশ্বরদীসহ যতগুলো স্টেশনে ট্রেন থেমেছে, প্রত্যেকটি জায়গায় এরকম শত শত মানুষের হুড়োহুড়ি ট্রেনে ওঠার জন্য। সবগুলো দরজা না খোলায় অনেকে দরজায় সজোরে লাথি মেরেছেন। ধাক্কা দিয়েছেন। জানালায় আঘাত করেছেন। ভয়াবহ সেই দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ট্রেনের ভেতরে থাকা যাত্রীরা। শিশুরা তো বটেই। ট্রেনের প্রত্যেকটি বগি মানুষে ঠাসা। এসি কক্ষ এবং কেবিনগুলোয় যাতে অতিরিক্ত যাত্রী ঢুকতে না পারেন, সেজন্য ট্রেনের কর্মীরা প্রাণপন চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই প্রতিরোধ ভেঙে অনেকেই ঢুকে পড়েন। একটি বগি থেকে আরেকটি বগিতে যাওয়ার পথ এমনকি টয়লেটের সামনেও মানুষ বসে পড়েন। কোনোমতে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলেই যেন হয়। পুরো পথে এই দৃশ্যের চিত্রায়ন থাকে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় তিন ঘণ্টা পরে পরদিন অর্থাৎ সোমবার সকালে ট্রেন এসে থামে কমলাপুর রেলস্টেশনে। স্বভাবতবই সেখানেও একইরকম মানুষের ভিড়। যেন ঈদের ছুটিতে মানুষ বাড়ি যাচ্ছে।
ঢাকায় নেমেই কি খালাস? অগণিত মানুষের অপেক্ষা। কোনো বাহন নেই। যাদের ব্যক্তিগত বাহন ছিল তারা বাড়িতে পৌঁছাতে পেরেছেন। কিন্তু যাদের বাহন নেই, এরকম অসংখ্য মানুষ ভারী ব্যাগ কাঁধে এবং কোলে শিশুসন্তান নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। দুয়েকটি সিএনজি অটোরিকশা দেখা গেলেও চাহিদার তুলনায় তা নিতান্তই কম। কমলাপুরের আশেপাশে বা কম দূরত্বে যারা যাবেন, তারা কেউ কেউ রিকশা পেয়েছেন বটে। যথারীতি কয়েকগুণ বেশি ভাড়ায়। কিন্তু যে দুর্বিষহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ২০ টাকার ভাড়া ২০০ টাকা দিয়ে যেতেও মানুষের আপত্তি ছিল না। কিন্তু সেই পরিমাণ রিকশাও ছিল না।
সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে এই যে রাস্তায় যানবাহন বন্ধ করে দেয়া হলো, সেই এখতিয়ার পরিবহন শ্রমিকদের আছে কি না? সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদ বলছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’যদি তাই হয়, তাহলে রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে জিম্মি করে পরিবহন শ্রমিকদের এই ধর্মঘট অসাংবিধানিক হবে কি না? দ্বিতীয়ত, তারা কোন ক্ষমতার বলে প্রজাতন্ত্রের মালিকদের জিম্মি করলেন?
জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সেই ক্ষমতার আলোকেই সড়ক পরিবহন আইন করা হয়েছে এবং যারা এখন পরিবহন শ্রমিকদের এই আন্দোলনের নেপথ্যে ভূমিকা রাখছেন, তাদেরও কেউ কেউ এই আইনের পক্ষে সংসদে ভোট দিয়েছেন। সুতরাং আইনের পক্ষে ভোট দিয়ে সেই আইনের বিরুদ্ধে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ানোর যে স্ববিরোধিতা-তার প্রতিকার কে করবে? রাষ্ট্র বা সরকার কি সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারবে?
যে পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট করলেন, তারা যেমন জনগণ, তেমনি তারা যাদেরকে জিম্মি করলেন তারাও জনগণ। আবার যারা সংবিধানের আলোকে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগ করে আইন করলেন তারাও জনগণ। তাহলে পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে কেন? হচ্ছে এ কারণে যে, কোথাও একটা সমন্বয়ের অভাব আছে। কোথাও কোথাও স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে যাচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইনে শ্রমিকদের যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, শ্রমিকদের দাবি সেটি তাদের অনুকূল নয়। আবার যারা সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চান, তাদের মতে, এরকম একটি কঠিন আইন ছাড়া সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ হবে না। বলা হচ্ছে, এই আইনে মালিকের স্বার্থ যতটা রক্ষা করা হয়েছে, শ্রমিকের স্বার্থ সেভাবে রক্ষা করা হয়নি। বলা হয়েছে, কোনো চালকের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু কোনো চালক কি ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটান বা মানুষকে চাপা দেন? নিশ্চয়ই না। আবার তিনি যে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন, সেটি প্রমাণ হবে কীভাবে? তারা এর তদন্ত করবেন? সঠিক তদন্ত কি আদৌ হবে? একজন সাধারণ বাস মালিকের ড্রাইভারের বিরুদ্ধে যে তদন্ত হবে, একজন প্রভাবশালী মালিকের ড্রাইভার বা শ্রমিকের বিরুদ্ধে একইরকম তদন্ত হবে? ফলে এই প্রশ্নগুলোর সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।
সড়কে দুর্ঘটনার জন্য কেবল পরিবহন শ্রমিকরাই দায়ী নন। রাস্তা খারাপ, বৈরী আবহাওয়াসহ নানারকম কারণ থাকতে পারে। সেরকম পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনা ঘটলে তার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কি শাস্তির আওতায় আসবে? আইনে এরকম কোনো বিধান নেই। যে বিআরটিএ ঘুষ নিয়ে অদক্ষ চালককে লাইসেন্স দেয়, আনফিট গাড়ির নিবন্ধন এবং রাস্তায় চলার অনুমতি দেয়; যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টাকার বিনিময়ে এসব অন্যায় চেপে যায়, তাদের শাস্তির কোনো বিধান কি আইনে রয়েছে? যদি না থাকে, তাহলে মনে হতে পারে-আইন সংশোধনের দাবিতে শ্রমিকদের ধর্মঘট যৌক্তিক। যে শ্রমিকদের কোনো সম্মানজনক বেতন নেই, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালাতে হয়, দিনে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা মালিককে বুঝিয়ে দিতে হয়, রাস্তায় পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়, রাজনৈতিক মাস্তানির শিকার হতে হয়, প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবহনের সাথে টেক্কা দিতে হয়-সেই শ্রমিকরা যদি নিজেদের দাবি আদায়ে রাস্তায় নামেন, সেটি অযৌক্তি কি না?
প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। তা হলো-বছরের পর বছর ধরে আমাদের পুরো পরিবহন খাতে যে মাফিয়াতন্ত্র, যে নৈরাজ্য ফুলে ফেঁপে উঠেছে তা একটি আইন দিয়ে প্রতিরোধ করা অসম্ভব। এখানে একটি বিশাল দুষ্টচক্র রাজনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ মহলের পৃষ্ঠপোষকতা পায়। পরিবহন খাতের কোটি কোটি টাকা চাঁদার ভাগ সাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর কোর্ট টাই পরা অনেক ভদ্রলোকের পকেটে যায়। ভোটের সময় এই বিশাল শ্রমিক শ্রেণিকে পেশিশক্তি এবং ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং যতদিন না তাদের এরকম রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে এবং সড়কের মূল সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের জন্য মালিক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো একমত না হচ্ছে, ততদিন আইন দিয়ে সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ করা যাবে না। বরং শ্রমিকরা নিজেদের দাবির সপক্ষে ধর্মঘট ডাকবেন এবং প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ জিম্মি হতে থাকবে।
২৯ অক্টোবর সোমবার রাতে বর্তমান দশম সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপনী হয়ে গেছে। অর্থাৎ আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে যেহেতু আর কোনো সংসদ অধিবেশন বসার সম্ভাবনা নেই, ফলে আপাতত সড়ক পরিবহন আইনটি আগামী সংসদ গঠনের আগে আর সংশোধনেরও সুযোগ নেই। যদিও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু তিনি সেটি করবেন কি না বা করলে তখন সাধার মানুষের মধ্যে এর কী প্রতিক্রিয়া হবে-সেটিও প্রশ্ন। এরকম বাস্তবতায় পরিবহন শ্রমিকরা ২১ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে তাদের ৮ দফা দাবি পূরণ না হলে তারা ৯৬ ঘণ্টা ধর্মঘট পালনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এই ২১ দিনের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে যাবে। দেশে নির্বাচনের আমেজ শুরু হয়ে যাবে। ভোটের রাজনীতিতে অনেক ধরনের চমক হয়তো ঘটতে থাকবে-কিন্তু প্রজাতন্ত্রের মালিক যে জনগণ, তাদের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করবে কে?
স্মরণ করা যেতে পারে, গত ২৯ জুলাই রাজধানীতে বাস চাপায় দুই স্কুলশিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা যে অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে তোলেন, তখন সরকারের মন্ত্রী, আই্নশৃঙ্খলা বাহিনী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সবাই বলেছিলেন, এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু কারো চোখ আদৌ খুলেছে বলে মনে হয় না। শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের মেরামত চলছে’। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা আদৌ কোনো মেরামত চান কি না? কেননা, রাষ্ট্রের মেরামত হয়ে গেলে তাদের ক্ষমতা কতটুকু খর্ব হবে সেটিও নিশ্চয়ই তারা বিবেচনা করেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)