আজকের বাংলাদেশ ও তার রাষ্ট্রযন্ত্র কতটুকু দুর্নীতি পরায়ন, এই রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় সিনিয়র কর্মকর্তা থেকে জুনিয়র কর্মকর্তা কীভাবে অপরাধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে আসছে-এটি পরিস্কার করেছে সাহসী কন্যা নুসরাত।
ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের বুঝিয়েছে, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের নামে রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় মানুষের কাছে এই বাংলাদেশ কেমন করে ধীরে ধীরে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় খুন করার মধ্য দিয়ে এদেশে রাজনীতি ও ক্ষমতার নামে যে অপসংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারিনি।
বরং দিনের পর দিন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে বড় কর্তা থেকে ছোট কর্মকর্তা জড়িয়ে যাচ্ছে দুর্নীতিতে, যা রক্ষা করতে গিয়ে অনেক সময় নিজেরাই অপরাধ করার পাশাপাশি অন্য অপরাধীদেরও আশ্রয় প্রশ্রয় দিতে হচ্ছে, দিয়ে আসছে।
২০১৫ সালের ৭ আগস্ট শুক্রবার সন্ধ্যায় ছুটে যাই ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপধ্যায় নিলয়ের খিলগাঁওয়ের বাসায়। কারণ, কতিপয় সন্ত্রাসীরা পিস্তল ও রামদা দিয়ে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করে। আর এই হত্যার জন্য সরাসরি দায়ি রাষ্ট্রযন্ত্র পুলিশ বাহিনীর কতিপয় কর্তাব্যক্তির।
নিলয়ের ফেসবুক ও মুঠোফোনে হত্যার হুমকির কথাটি জানিয়ে থানায় জিডি করতে গেলে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে বরং হুমকিদাতাদের পক্ষ অবলম্বন করেছে পুলিশ। তখন খিলগাঁও এবং শাহজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নিলয়ের জিডি গ্রহণ না করে, নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে বরং তাকে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল।
তারা বলেছিল, এই বাংলাদেশ নিলয়ের জন্য নিরাপদ নয় এবং অবশেষে তাই হলো। নিলয়ের জন্য এই বাংলাদেশ নিরাপদ ছিলো না। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। কুমিল্লার তনু হত্যা নিয়ে সারা বাংলায় আন্দোলন সংগ্রাম হলো, আমিও জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ বোয়াফ বিভিন্ন জেলায় জেলায় আন্দোলন সংগ্রাম করেছি।
সারা দেশের মানুষ তনু হত্যার বিচার চেয়েছে। মিতু হত্যার ঘটনা নিয়ে সৃষ্ট নানা ধরনের নাটক, সত্যিই এই জাতিকে হতাশ করেছে। অন্যদিকে সাগর-রুনির হত্যার বিচারের দাবিতে আজও মিডিয়া ও স্যোশাল মিডিয়ায় বছর ঘুরলেই প্রতিবাদের লেখা পড়ি, আন্দোলনও মাঠে দেখি।
কিন্তু রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোর নিরবতা আমাদের আতঙ্কিত করে তুলে। আমরা কতটুকু নিরাপদ অবস্থায় আছি-এই প্রশ্ন মনের অজান্তেই নিজের ভেতর উঁকি দিয়ে বসে। আজ সমাজ ও রাষ্ট্রের চারপাশে শিশু থেকে নারী কেউ নরপশুদের নোংরা থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
মসজিদ থেকে মন্দির, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, আবার সরকারি অফিস থেকে গণমাধ্যম অফিসগুলোতেও আমাদের মেয়ে সন্তান, মা-বোনেরা নিরাপদ নয়। তারা আজ নিরাপদে বাসে কিংবা অন্য কোনও যাতায়াত সাভির্সে নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারছে না। যৌন নির্যাতন, নিপীড়ন করছে। ধর্ষণের শিকার করে তাদের হত্যা করছে।
কারণ, অপরাধ করে অপরাধীরা পার হওয়ার এক ধরনের মনোবল পেয়ে বসেছে। যেমন ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা জড়িত, তাদের ভিতর অপরাধ করেও পার পাওয়া সংস্কৃতি বিরাজ করছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার তদন্তে এটি উঠে এসেছে।
আর বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধান প্রতিবেদনেও এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, অতীতে এই ধরনের অপরাধ করে এক ধরনের পার পাওয়ার মনোবল তাদের অভিজ্ঞতার অংশ। যার কিছুটা প্রমাণ, ফেনীর পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও সোনাগাজী থানার বহিষ্কৃত ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে উল্টো অপরাধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি ৩০ এপ্রিল জমা দেওয়া তাদের তদন্ত প্রতিবেদনেও এই দুইজনসহ মোট চার পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতি পাওয়া গেছে বলেও উল্লেখ করেন। আর সর্বশেষ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর পঞ্চগড়ে আইনজীবী পলাশ কুমারকে কারাগারে পুড়িয়ে হত্যা করার অভিযোগটি আমাদের নতুন করে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
কারাগারেও মানুষ নিরাপদ নয়?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে এটাই প্রতীয়মান, আইনজীবী পলাশ কুমার পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার। ষড়যন্ত্রের সুদীর্ঘ পথের কাঁটা সরানোর জন্যেই মামলার নাটক এবং কারাগারেই পুড়িয়ে হত্যা, যা পলাশ কুমার তাঁর মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে অডিও রেকর্ডে স্পষ্ট করেছেন।
আইনজীবী পলাশ কুমার তাঁর মৃত্যুর আগে রেকর্ড করা ৫ মিনিট ৭ সেকেন্ডের অডিওতে বলেন, ‘আমি ২০১৩ সালে কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানিতে আইন কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেই। এরপর ২০১৬ সালে কোহিনূর কোম্পানির মালিক আমাকে দিয়ে ভুয়া দলিল, অন্যায় এবং অবৈধ কাজ করার জন্য নির্দেশনা দিলে আমি সেটা করিনি বলে আমি চাকরি থেকে ইস্তফা দেই।
পরবর্তী সময়ে অনেক ঘটনাই ঘটে। ২০১৬ সালে আমি সে কোম্পানি থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর আমার নামে ৩১ লাখ টাকা আত্মসাতের মিথ্যা মামলা করে। কোহিনূর কোম্পানির অবৈধ কাজগুলোতে সহায়তা করে সরকারের প্রভাবশালী অনেক কর্মকর্তা’।
ওই অডিওতে আরও বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ২৫ মার্চ পঞ্চগড়ে মানববন্ধন করি। উল্টো আমার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তির অপরাধে মানহানির মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। এরপর আমাকে পঞ্চগড় জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি আমাকে হয়রানি করে, হুমকি দেয়, ছবি তোলে। আমি জেলার সাহেবকে বলি। কিন্তু পঞ্চগড়ের জেলার সেটি গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো ক্ষমতাশালীদের পক্ষ নেয়। ২৬ এপ্রিল, শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে দুজন লোক টাইগার বোতল থেকে কী যেন ছুড়ে আমার শরীরে আগুন লাগিয়ে আমার জীবনকে মৃত্যুর মুখোমুখি ঠেলে দেয়। এই অপরাধীদের বিচার চাই’।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের এই অডিও বার্তাটি তার হত্যার বিচারিক কাজে ‘Dying declaration’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, যা ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য।
যদিও ইতোমধ্যেই আইনজীবী পলাশ কুমার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের দগ্ধ হওয়ার স্থানে দাহ্য পদার্থের কোনও অস্তিত্ব পায়নি বলে জেলা প্রশাসনের তদন্ত দল জানিয়েছে।
কিন্তু, রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় বিতর্কিত ব্যক্তিদ্বয়ের কারণে অবিশ্বাস জন্ম নেওয়া এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, এটিও ফেনীর সোনাগাজী নুসরাত হত্যার অনুরূপ আত্মহত্যা বলার একটি চেষ্টা হতে পারে। বিতর্কিত এবং দায়িত্ব অবহেলা ঢাকার জন্য কতিপয় ব্যক্তি আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের হত্যাকাণ্ডটিও আত্মহত্যার রূপ দিতে সকল ধরনের চেষ্টা-সন্দেহের মাঝেই নিহিত।
কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় কর্মকর্তা এবং সর্বপরি এই তদন্ত কমিটি, সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কী হতে পারে, এটি এখন দেশের একজন সাধারণ লোকও বলে দিতে পারে। প্রথমত, রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় বিতর্কিত ব্যক্তিদের রক্ষা করতে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেরাই জনগণের আস্থাহীনতার জায়গা তৈরি করেছে।
অন্যদিকে, প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক তথ্য জানার পরে। ফেনীর পুলিশ সুপার নিজে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো চিঠিতে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বাঁচানোর জন্য নুসরাতের পরিবারকে দায়ি করেন। অন্যদিকে নুসরাতের শরীরে আগুন লাগিয়ে হত্যাচেষ্টাকে আত্মহত্যা বলেও প্রচার করতে থাকেন।
শুধু সাহসী কন্যা নুসরাত তার জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, এটি আত্মহত্যা নয়, হত্যা। যার সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
আমরা দেখেছি, ৭৫-এর খুনীরা বুক ফুলিয়ে বলেছে, তাদের কেউ বিচার করতে পারবে না। আর যেদিন বিচার হবে বা করবে, তখন কারো কারো হাতের তালুতে নাকি চুলও গজাবে। খুনীদের অনেকেই দেশি, বিদেশি গণমাধ্যমে খুনের কথা স্বীকার করেছে। কারণ, তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে, এই বিচার আর কখনো হবে না।
কারণ, সরকার যখন নিজেই খুনীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, ক্ষমতার অধিকারী করে তুলে, তখন অপরাধ প্রবণতা রোধ নয় বরং এটি সমাজ রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে আজ শুধু সমাজ রাষ্ট্রে ছড়িয়েই পড়েনি বরং রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থান করছে।
আর সাংবিধানিক রাষ্ট্রযন্ত্র যেখানে অপরাধরোধ করতে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনাসহ অপরাধমুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র গঠনে সামাজিক, সাংস্কৃতি চর্চায় অপরাধীদের সুস্থ-সুন্দর জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করবে, সেখানে কতিপয় বিতর্কিত ব্যক্তি তাদের দায়িত্ব অবহেলা আর অপরাধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে, আজ পুরো সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। জনগণের মাঝে আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। এটি জাতির জন্য অশনি সংকেত।
তবে আশা ও ভরসা রাখতে চাই হাইকোর্টের ওপর। পঞ্চগড়ে কারাগারে অগ্নিদগ্ধ আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে, যেমনি করে পিবিআই ফেনী সোনাগাজী মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকাণ্ডের তদন্তে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)