কামাল লোহানী আমাকে চিনতেন না। আমি তাকে চিনতাম। তরুণ সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত প্রয়োজনে তার অনুষ্ঠানে যেতাম। মনোযোগ দিয়ে ভরাট কন্ঠের শ্রুতিমধুর শব্দে গড়া কথায় মুগ্ধ হতাম। তিনি মঞ্চ আলো করে কখনো প্রধান অতিথি, কখনো প্রধান বক্তা কখনো সভাপতির আসনে উজ্জ্বল হয়ে থাকতেন। আমি রিপোর্টার্স বেঞ্চে বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় থাকতাম। সুঠামদেহি কান্তিমান সুপুরুষ লোহানীকে অপরিচিত জনেরও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। ভিড়ের মাঝে বটবৃক্ষের ছায়ায় আমাদের অবস্থান হতো। এশিয়াটিক সোসাইটির সাংস্কৃতিক সমীক্ষায় ‘নৃত্যশিল্পের বিস্তার’ বিষয়ক তার প্রবন্ধ পাঠ আমাকে তার চিন্তার গভীরতা অনুধাবনে সহায়তা করে। আমাদের দূরত্বের পরিচয় এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারতো!
লোহানীর পাঞ্জাবি বাংলাদেশের ইতিহাস
কামাল লোহানীর সাথে একবারই আমার এক টেবিলে রাতের খাবার গ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরের ঐ স্মৃতি আমার হৃদয়ে ‘লোহানীর সাথে লাস্ট সাপার’ হিসেবে সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বহুজাতিক ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই প্রতিবছর ‘কৃষি পদক প্রদান করে থাকে। কৃষক, কৃষি ভিত্তিক উদ্যোগ, বাণিজ্য, ধারণা ও ব্যক্তিত্বকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতে এই আয়োজন করা হয়। নির্ধারিত আয়োজনে বরেণ্য কয়েকজন ব্যক্তিত্বের সাথে আমারও উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিলো। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী ছাড়াও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছড়াশিল্পী আমীরুল ইসলাম, আড়ংয়ের ডিজাইনার খাদিজা রহমান ও অর্বাচিন তরুণ আমি সেই সন্ধ্যায় স্যারের সঙ্গী ছিলাম। মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো সেদিন প্রথম এবং শেষ বারের মতো কামাল লোহানীকে নিকট থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিলো। আয়োজনের আলো ঝলমল মঞ্চের চেয়ে আমি আমার আশেপাশের এইসব বর্ষীয়ান নায়কদের নিয়ে স্বভাবতই অধিক আগ্রহী ছিলাম।
আয়োজন শেষে ডিনারের ব্যবস্থা ছিলো। বাংলাদেশের বর্ষীয়ান তারুণ্যের উজ্জ্বল প্রতীক কামাল লোহানী, প্রাজ্ঞ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ পাশাপাশি বসেছিলেন। সব সময়ের মতো সেদিনও কামাল লোহানীর পরিধানে ছিলো ঢোলা পাজামার উপরে দু’দিকে চৌকো আজানুলম্বিত ঢোলা সফেদ পাঞ্জাবি। আমাদের দেশে প্রবাদ আছে, ‘আপনা পছন্দে খানা, পরকা পছন্দে পরনা।’
লোহানীর মতো ব্যক্তিত্বরা পরের পছন্দে অনুরোধের ঢেকি গিলতে গিয়ে খানা পিনায় ছাড় দিতে রাজি হলেও পরিধানে সবসময় ধ্রুপদীকে ধারণ করতেন। পূর্ব পাকিস্তান পর্বে নিজেদের পরিচয়, ভাষা, মানচিত্র, দেশ নিয়ে অস্তিত্বের সংকটকালে জেনে শুনে বিষ পানের লড়াইয়ে নামা তরুণরা নিজ পরিচ্ছদেও ছিলেন দারুণ স্বাতন্ত্র্য। লক্ষ্য পানে অবিচল থেকে কর্মে রত থাকা প্রজন্মের সূর্য সন্তানরা পরের জুতোয় পা ঢুকাতেও নারাজ ছিলেন। আপন পায়ের মাপে পদক্ষেপ তৈরী করে উদ্দেশ্যের পরিপূর্ণতায় এগিয়ে গেছেন নিরন্তর। লাভ-লোভের বৈষয়িক হিসাব, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির যোগবিয়োগ, জীবনের মোহকে উপেক্ষা করে জীবনকে যাপনের নয়, উদযাপনের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। কামাল লোহানীর দুপাশে নেমে যাওয়া হেম ওভাল পাঞ্জাবি যেনো ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। যার শুরু এবং শেষের হিসাব মেলাতে পাড়ি দিতে হয় সেন্টমার্টিন থেকে বাংলাবান্ধার জিরো পয়েন্ট। নিজ সৌষ্ঠবের চেয়ে বিস্তৃত পরিধানে তিনি ধারণ করতেন তার প্রিয় দেশ মাতৃকা, দেশের সকল মানুষ, দেশের সকল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের শোনিত ধারা।
সেপ্টেম্বরের সেই সন্ধ্যায় ডিজাইনার খাদিজার আগ্রহ ছিলো তার ‘হেম ওভাল’ স্টাইলের পাঞ্জাবিতে। শুভ্রতার সাথে দারুণ মানিয়ে যাওয়া পাঞ্জাবি সম্পর্কে জানতে চাইলে মুচকি হেসে জানিয়েছিলেন,পঞ্চাশ-ষাট দশকের বিপ্লবী রাজনীতিবিদদের জীবন যাপনের অনাড়ম্বরতা, চলাফেরায় সহজতা, উদ্দেশ্যে সততা ও কর্মে পরিশুদ্ধতার কথা। তারই প্রতীকরূপে নিজ পাঞ্জাবিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় পাঠ আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম কর্মবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের সবচেয়ে মধুর মুহূর্ত কোনটি! এতটুকু স্মৃতি না হাতড়িয়ে গমগম কন্ঠে বলেছিলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর বিকেলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে লাল সবুজ বাংলাদেশের বিজয়ের সংবাদ পাঠ।’
বাহান্নের ভাষা আন্দোলন, ষাট দশকের সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান,মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পর্বে নিজ কর্মে তিনি সমুজ্জ্বল। স্বাধীন বাংলার জন্মের সুতীব্র চিৎকারের ধ্বনি যুগ যুগ ধরে সবাই জানবে তারই ঐতিহাসিক কন্ঠে। সেই উত্তেজনাময় পাঠে, উজ্জ্বল স্মৃতিতে, আনন্দ-বেদনার সংক্ষিপ্ত কাব্যের একক অধিকারি তিনি। ইতিহাসের পথ-পরিক্রমায় কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন ব্যক্তি ও ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। লোহানী ইতিহাসের তৈরী, ইতিহাস লোহানীর কর্মে ভাস্বর।
বরেণ্য মানুষের পদযুগলে এক স্পর্ধীত ‘সারমেয়’র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
স্রোতের বিপরীতে চলায় বিপদ আছে, বর্তমানকে বিপন্ন করার সংশয় থাকে। তারপরও কোন এক অনির্বচনীয় সুখে সেই পথেই জীবন খোঁজে ফেরে উদ্দিপ্ত তারুণ্য। কারো কারো এক আজন্ম স্বাদ জাগে পথ চলার। ইতিহাসের বরেণ্য মানুষের জীবন-কর্ম সেই স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। তরুণ পথিকের চলার পথে নিরন্তর শক্তি যোগায়, সাহস সঞ্চার করে, অনুপ্রেরণা দেয়। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের বর্ষীয়ান ওয়ারেন্ট বাফেটের একটি উপদেশ বেশ প্রণিধানযোগ্য, ‘বড় মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করো। প্রয়োজনে তাদের পদযুগলে সারমেয় হয়ে বসে থেকো। জীবন অনেক ছোট। যদি বড় হতে চাও তবে বরেণ্য মানুষের কাছে প্রতিদিন জীবনের পাঠ নাও।’
আমার কৌতুহলী জীবনে বিড়বিড় করে জন্ম নিতে থাকা অসংখ্য ‘কেন’র উত্তর খুঁজতে আমি বরেণ্য ব্যক্তিত্বের পদযুগলে সারমেয় হয়ে থাকি। তাদের একনিষ্ঠ কর্ম আমাকে সাহসী করে,তাদের উদ্দেশ্যের সততা আমাকে দূর্বিনীত করে, তাদের গভীর চিন্তা আমার দৃষ্টিকে স্বচ্ছ করে, তাদের জীবনবোধ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। উদযাপনের এমন জীবনই তারুণ্যের স্পর্ধার পালে হাওয়ান দিয়ে যায়।
‘অদ্ভূত আঁধার ছেয়ে যাওয়া’ কালে আজ যারা অন্ধ তারাই সবচেয়ে বেশি চক্ষুষ্মান, যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই তাদের সুপরামর্শ ছাড়া দেশ জাতি অচল। তখন কামাল লোহানীর বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম আমাদের আগামির পথ চলায় প্রেরণার বাতিঘর।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)