তরতাজা প্রাণগুলো যখন লাশ হয়ে ফেরে, আর দুঃসংবাদগুলো যখন সংবাদ হয়ে ওঠে তখন মনে হয় এমন একটি দিন না এলেই ভাল হতো। কিন্তু তা হয়নি। ১২ মার্চ বাংলাদেশ এবং নেপালের জন্য এমন এক ভারী বার্তা ছড়িয়েছে আকাশে-বাতাসে যেখানে শুধুই নিঃশব্দ আর্তনাদগুলো মিলেছে করুণ সুরে। শোক-স্তব্ধ বাংলাদেশে সবারই প্রার্থনা আহতরা সুস্থ হয়ে ফিরুক।
ফ্লাইটের যাত্রীদের কথা মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে সকলের। কী বাঁচার আকুতিই না ছিল সবার। আপ্রাণ চেষ্টাগুলো এভাবে শেষ হয়ে যাবে এমনটা কখনোই ভাবেনি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে ইউএস বাংলা’র বিএস-টুওয়ানওয়ান ফ্লাইটটির এই দুর্ঘটনা কেন ঘটলো? কী সেই কারণগুলো যার জন্য এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল? এই কারণগুলো আসলে এক ধরণের প্রশ্ন হিসেবেই চলে আসে সামনে।
দুর্যোগপ্রবণ আবহাওয়াকে মূলত দোষ দেওয়া হয়ে থাকে। পাহাড়ঘেরা ত্রিভূবন বিমানবন্দরের রানওয়ে অ্যাপ্রোচ নিঃসন্দেহে কঠিন এবং বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাইলট ছাড়া এখানে অবতরণের সাহস করা দুঃসহ কাজ। ক্যাপ্টেন নিশ্চিতভাবেই দক্ষ ছিলেন, কারণ এরকম মৃত্যুপুরীখ্যাত বিমানবন্দরে তিনি এর আগেও অবতরণ করেছেন। প্রশ্ন আছে এয়ারক্রাফট নিয়ে। কতদিনের পুরোনো ছিল বিমানটি?
আর দিনে এই বিমান কয়টা ফ্লাইট অপারেট করতো সেটিও একটি প্রশ্ন। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই পোস্ট দেন ল্যান্ডিং খারাপ, ঝাঁকুনি, দুর্যোগপ্রবণ আবহাওয়ায় বিমানচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়াসহ নানান আশঙ্কার কথা প্রসঙ্গে। কিন্তু দিনশেষে ওই ফ্লাইটগুলো তড়িঘড়ি করে ল্যান্ড করে আবার ফিরতি ফ্লাইটে যাত্রা করে।
আন্তর্জাতিক রুটে এতদিনের পুরনো একটি বিমান কীভাবে উড্ডয়ন উপযোগী হিসেবে বিবেচিত হল, সেটি একটি প্রশ্ন। এর ফিটনেস ঠিক ছিলো কি না তা নিশ্চিতভাবেই একটি বড় প্রশ্ন। ত্রিভূবনে যেমন কুয়াশা থাকে তেমন কুয়াশা’ও ছিল না দুর্ঘটনার দিনে। এছাড়া ফ্লাইটের দিনে উইন্ড শিয়ার’ও (বাতাসে গতিপথ ও গতিবেগে পরিবর্তন) ছিল না। প্রোপেলর না কি জেট প্লেন ত্রিভূবনে অবতরণে জন্য উপযোগী?
সর্বশেষ পাইলটের সঙ্গে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের (এটিসি) কথোপকথনের পুরো বিষয়টি ঘোলাটে। কোন রানওয়েতে অবতরণ করবেন, জিরো টু না টু জিরো এটা নিশ্চিত হতে পারেননি পাইলট বা তাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এটিসি। এটিসি’র দুর্বল ইংরেজি ভাষা অনুবাদ করতে সংবাদমাধ্যমের বেগ পেতে হয়েছে। কেনই বা এমনটা হলো?
অবতরণের বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই এই যোগাযোগ হয়ে থাকে। যান্ত্রিক ত্রুটিই কি তাহলে প্রধান কারণ? ইউএস বাংলা এবং ত্রিভূবন সিভিল এভিয়েশন থেকে কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি। আশা ভরসা এখন ব্ল্যাকবক্স এবং নেপালের মন্ত্রী পরিষদ গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিশন।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের প্রতীক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ এবং নেপাল। সেই উত্তর মিললেও ৫০টি প্রাণ কখনো ফিরবে না। যারা আহত তারাও স্বাভাবিকভাবে জীবন পার করবেন কিনা সন্দেহ আছে। এই ভয়ঙ্কর স্মৃতি ভোলা মোটেও সহজ হবে না।