চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

কাঁটাতার ও দেয়ালের গল্প

রাজনীতির অনেক গরম বিষয়ের বাইরে এ মুহূর্তে দুটি খবরের দিকে নজর দেয়া যাক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেছেন, মিয়ানমার সীমান্তে শাহপরীর দ্বীপ থেকে ২৭১ কিলোমিটার রোডসহ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ, মাদকদ্রব্যসহ অন্যান্য চোরাচালান প্রতিরোধ, বিভিন্ন প্রকার সীমান্ত অপরাধ দমন এবং দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় শাহপরীর দ্বীপ থেকে ২৭১ কিলোমিটার রোডসহ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের এই পরিকল্পনা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।

দ্বিতীয় আরেকটি খবর দিয়েছে একটি অনলাইন সংবাদপত্র। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বরাতে তারা লিখেছে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া ও মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নাফ নদীর পশ্চিম পাড় বরাবর ৪৭ দশমিক ৬০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রশস্ত ও উঁচু করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার পুব দিকে মিয়ানমার অবস্থিত। টেকনাফ-উখিয়া ও মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে নাফ নদী। এর পশ্চিম পাড় (ডান তীর) বরাবর বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণ করা ৪৭ দশমিক ৬০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং ৪৬টি পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো রয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য প্রকল্প এলাকায় নাফ নদীর লোনা পানির প্রবেশ ঠেকানোসহ বন্যা ও উচ্চ জোয়ারের হাত থেকে প্রকল্প এলাকায় শস্য ও জানমাল রক্ষা করা।

 স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন

রোহিঙ্গাদের নিয়ে যখন আমরা নানাবিধ উদ্বেগের কথা বলি এবং শুনি, তখন এই খবর দুটি কতটা আশার সঞ্চার করবে তা এখনই বলা মুশকিল। কেননা, গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে নতুন করে আসা এবং পুরনো মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা এখন বাংলাদেশের কাঁধে। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিলেও এরইমধ্যে উখিয়া-টেকনাফ এলাকার স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, বন ও পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে। লাখ লাখ মানুষের পয়ঃবর্জ্যে দুষিত হয়েছে পর্যটনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকা। বন্য হাতির আবাসস্থল ও চলাচলের পথ নষ্ট করা হয়েছে। পাহাড় কেটে এবং গাছপালা সাফ করে গড়ে তোলা হয়েছে বসতি। ফলে আগামী বর্ষায় কিংবা তার আগে ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা আকস্মিক বন্যা আঘাত হানলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে মানবিক বিপর্যয় তৈরি হবে, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

এই যখন অবস্থা, তখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার স্রোত ঠেকাতে সীমান্তে কাঁটাতার কিংবা উঁচু দেয়াল নির্মাণের খবর হয়তো দূর ভবিষ্যতর জন্য আশার খবর, কিন্তু বর্তমানের জন্য মোটেও নয়। কেননা, যে সাড়ে ১০ লাখ রোহিঙ্গা এ মুহূর্তে বাংলাদেশে আছে, তাদের প্রত্যাবাসনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেটি বস্তুত থমকে গেছে। বরং নতুন করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া এবং গণকবরের সন্ধান মিলছে। হাবেভাবে মনে হচ্ছে, এই রোহিঙ্গারা শেষমেষ বাংলাদেশের বোঝা হয়েই থাকবে। তাদের জন্য ভাসানচরে আবাসনের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। ফলে কক্সবাজার থেকে তাদের সরিয়ে নিতে নিতে ওই এলাকার অর্থনীতি, পরিবেশ, প্রকৃতি এবং স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার বারোটা বাজবে (এখনই বেজেছে) এবং ভাসানচরে তাদের স্থানান্তর করতে করতে আরও কী ক্ষতি হবে, তা ভেবে আতঙ্কিত হতে হয়। যে প্রায় অর্ধ লাখ রোহিঙ্গা শিশু শরণার্থী ক্যাম্পে জন্ম নিয়েছে, তারা জন্মগতভাবে বাংলাদেশে নাগরিক কি না বা ভবিষ্যতে তারা নাগরিকত্ব দাবি করবে কি না, সে প্রশ্নও রয়েছে।

রোহিঙ্গাফলে দূর ভবিষ্যতে কাঁটাতার কিংবা উঁচু দেয়াল দিয়ে আমরা যে রোহিঙ্গাদের ঠেকানোর কথা বলছি, ওই কাঁটাতারের বেড়া কিংবা দেয়াল হতে হতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বলে কোনো জনগোষ্ঠী থাকবে না। কারণ রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা মিয়ানমার সরকারের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। সুতরাং একজন রোহিঙ্গার পক্ষেও সেখানে থাকা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ থেকে যেসব রোহিঙ্গাকে তারা ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলছে, তাদের থাকার জন্য বানানো হচ্ছে ক্যাম্প। অর্থাৎ নিজ ভূমিতে তারা ফিরতে পারবে না। বাংলাদেশেই তারা ক্যাম্পে আছে। এখানে অন্তত নির্যাতন, ধর্ষণ বা খুন হবার ভয় নেই। দু বেলা খেতে পারছে। সুতরাং মিয়ানমারে গিয়ে তারা কেন সেই ক্যাম্পেই থাকবে যেখানে প্রতিনিয়তই তাদের তাড়িয়ে বেড়াবে মৃত্যুর বিভীষিকা? আর এই প্রত্যাবাসনের শর্তে বলা হয়েছে, স্বেচ্ছায় যাওয়ার জন্য যারা ফর্ম পূরণ করবে এবং বিভিন্ন শর্ত মেনে স্বাক্ষর করবে, কেবল তাদেরই ফেরত নেয়া হবে। সুতরাং কেন তারা স্বেচ্ছায় এমন মৃত্যুপুরিতে ফিরতে চাইবে?

চাইবে না। বরং তারা বাংলাদেশের মূল স্রোতধারায় মিশে যেতে চাইবে। সেটি ঠেকাতে সরকার কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকা অমূলক নয়। কারণ অতীতে যখনই এরকম নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা এসেছে, তাদের একটা বড় অংশই মূল জনগোষ্ঠীর ভিড়ে মিশে গেছে। সুতরাং যে দেয়াল কিংবা কাঁটাতারের কথা বলা হচ্ছে, সেটি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আপাতত কোনো ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয় না। বরং তাদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে ফেরত পাঠানো এবং মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পরে সেখানে নিজভূমিতে যাতে তারা নাগরিক অধিকার নিয়ে থাকতে পারে, তার নিশ্চয়তা দিতে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করাই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান। যদিও সেটি এখন প্রায় অসম্ভব।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)