প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দেশের বিশিষ্ট লেখক সাহিত্যিকরা বলেছেন: কল্পনা শক্তির দৃঢ়তায় রাবেয়া খাতুন একজন মহান লেখক।
তারা বলছেন: রাবেয়া খাতুন তার লেখনির মধ্যদিয়ে বাংলা সাহিত্যে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। ৫০’র দশকের ওই সময়টাতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে যেভাবে তিনি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন, নারী জাগরণের কথা বলেছিলেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সোমবার তেঁজগাস্থ চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে রাবেয়া খাতুন স্মৃতি পরিষদ আয়োজিত আলোচনাসভায় উপস্থিত হয়ে তারা এসব কথা বলেন। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একুশে ও স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক সেলিনা হোসেন।
রাবেয়া খাতুনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সেলিনা হোসেন বলেন: ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাংলা সাহিত্যের যে স্রোতটা তৈরি হয়েছিল, সেটার অন্যতম ধারক ছিলেন আমাদের রাবেয়া আপা। আমরা এখন পর্যন্ত সে স্রোতেই এগিয়ে যাচ্ছি। এটি একটা অসাধারণ দিক যে, আমরা সব সময় বলি- ৪৭’র পরে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দীন, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমানেরা সকলে মিলে সাহিত্যের যে ধারাটি তৈরি করেছিলেন; আমরা সকলে মিলে সেখানে নিমজ্জিত হয়েছি। আমাদের নবীন লেখকরাও সেই ধারাটিতে বহমান রয়েছেন।
সেলিনা হোসেন তার লেখায় রাবেয়া খাতুনের প্রভাব তুলে ধরে বলেন: আমি ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার ‘মধুমতি’ উপন্যাসটি পড়েছি। উপন্যাসটি পড়ে খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তাঁতী সম্প্রদায়েরকে নিয়ে কিভাবে একটি উপন্যাস তৈরি করা যায়, এটি ছিল সেই উপন্যাসের বিশাল দিক। তার লেখনির গণমানুষের জীবনধারাকে সাহিত্যে নিয়ে আসার যে বিষয়টা ছিলো সেটি আমাকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
রাবেয়া খাতুনের ‘মধুমতি’ উপন্যাসে অনুপ্রাণিত হয়ে সেলিনা হোসেন পরবর্তীকালে জেলে পাড়া ঘুরে এসে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসটি রচনা করেন বলে জানান তিনি। এসময় স্মরণের বরণ ডালায় স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত রাবেয়া খাতুনকে স্মরণ করেন সেলিনা হোসেন।
স্মরণসভায় আহসানউল্লাহ তমাল রাবেয়া খাতুন রচিত ‘ভুলনা মোরে চলে যদি যাই, পৃথিবীর পরপারে’ শিরোনামে কবিতা আবৃত্তি করেন। ১৯৫০ সালের ২৯ মার্চ রাবেয়া খাতৃুন এটি রচনা করেন।
আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট কবি মাকিদ হায়দার। রাবেয়া খাতুন তার লেখনির মধ্যদিয়ে বাংলা সাহিত্যে চিরদিন বেঁচে থাকবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন: একজন শিল্পী, একজন সাহিত্যিক কখনোই মরে না; কবি-গল্পকার-ছড়াকার যে যেখানেই থাকুক না কেনো তার কাজের মধ্যদিয়ে বেঁচে থাকেন। অতুলপ্রসাদ আজ থেকে ৩০০-৪০০ বছর আগে বলে গিয়েছিলেন- ‘আ মরি বাংলা ভাষা’, অতুলপ্রসাদ কিন্তু বেঁচে আছেন। অনুরূপভাবে রাবেয়া আপাও বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে, তার শিল্পকর্মের মধ্যদিয়ে।
সাহিত্যকর্মের সকল প্লাটফর্মে রাবেয়া খাতুনের অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বলে এসময় মন্তব্য করেন মাকিদ হায়দার।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সময়ে আরেক অন্যতম কবি নাসির আহমেদ বলেন: একজন লেখক কতটা আধুনিক, তার দৃষ্টিভঙ্গি কতটা প্রগতিশীল, মন কতটা উদার এবং তরুণ মন কতটা উপলব্ধি করার সক্ষমতা কতটা তা রাবেয়া খাতুনের লেখনির মধ্যদিয়ে ফুটে উঠেছে। শুধুমাত্র তার লেখা পড়লেই বোঝা যাবে তার সময়ে যে সীমাবদ্ধতা ছিলো, সেটা কাটিয়ে উঠে- যে পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে তিনি লিখেছেন, অনেক বড় মাপের লেখক না হলে সেটি সম্ভব হতো না। তিনি বলেন: রাবেয়া খাতুনের সাহিত্য নিয়ে এই স্বল্প পরিসরের আয়োজনে দাঁড়িয়ে কথা বলা যেমন শোভনীয় নয় তেমন সমীচীন নয়, তাকে নিয়ে আরও বড় পরিসরে আলোচনা হতে পারে।
লেখালেখির পাশাপাশি ৫০’র দশকে রাবেয়া খাতুনের সাংবাদিতকায় কর্মজীবন শুরু, স্কুলে শিক্ষকতায় সুনাম ও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করা এবং নিজ সন্তানদের সমাজের মহীরুহ হিসেবে করে গড়ে তোলায় অসীম সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন নাসির আহমেদ।
এসময় উপস্থিত ছিলেন রাবেয়া খাতুনের জামাতা প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও চ্যানেল আইয়ের পরিচালক মুকিত মজুমদার বাবু। তিনি তার বক্তব্যে বলেন: আমাদের কর্ম কী সত্যি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে? রাখে, যদি সেই কর্মটি সত্যিকার অর্থেই একটি ‘কর্ম’ হয়ে থাকে। সেটি একজন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সারা বছরই আমরা কতো কাজই করি। কিন্তু ক’জনকে আমরা মনে রাখি! আর ক’জনকেইবা এমন আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করি। যখন কোন কাজ স্মরণীয় এবং বরণীয় হয়ে থাকে; তখন তিনি চলে যাওয়ার পরও- আমরা তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করি। রাবেয়া খাতুন তেমন কিছু করতে পেরেছিলেন, আপনাদের উপস্থিতি সেটা প্রমাণ করে।
রাবেয়া খাতুনকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মুকিত মজুমদার বাবু বলেন: কোথাও গেলে তিনি একটি নোটবুকে টুকটুক করে লিখে রাখতেন। আর ওই জায়গাটি সম্পর্কে তার অনেক কিউরিসিটি থাকতো। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, আমার অনেক জায়গায় তার সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। সে কারণেই খুব কাছ থেকে গভীরভাবে এই অভিজ্ঞতাগুলো আমার হয়েছে। তিনি সবার সাথে ফ্রি ভাবে মিশতে পারতেন। ভিন্ন ভিন্ন বয়সি মানুষের সঙ্গে খুব সহজ মিশে যাওয়াটা রাবেয়া খাতুনের অন্যমত গুণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এসময় স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে প্রগতিশীলতার মধ্যদিয়ে পরিবার পরিচালনায় রাবেয়া খাতুন অনন্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন বলে মন্তব্য করেন মুকিত মজুমদার বাবু।
রাবেয়া খাতুন স্মৃতি পরিষদের পক্ষে নিজের স্মৃতিকথা তুলে ধরেন শিশু সাহিত্যিক আমিরুল ইসলাম। তিনি তার বক্তব্যে বলেন: রাবেয়া খাতুন তার সমকালীন লেখক সেলিনা হোসেন, রিজিয়া খাতুন এর লেখা খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। তিনি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন, বলতেন ‘ও’- এই লেখাটি খুব ভালো লেখেছে। তিনি বিষয়ভিত্তিক লেখা একটু বেশি পছন্দ করতেন।
প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদ উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেন: হুমায়ূন আহমেদ অনেক জায়গায় রাবেয়া খাতুনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন,‘ তিনি হচ্ছেন লেখকদের লেখক, তিনি আমাদের জন্য লেখেন।’
‘খালাম্মার মৃত্যু যে হয়েছে, এটা যেমন সাগর ভাই বিশ্বাস করেন না। আমরা যারা তার কাছাকাছি ছিলাম তারা অবিশ্বাস করিনা।’-বলে শেষ করেন আমিরুল ইসলানম।
স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে রেজানুর রহমানের সঞ্চালনায় অন্যানের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন: আমিনুর রহমান সুলতান, গীতালি হাসান, মোজাফ্ফর আহমেদ, আনজীর লিটন, স্বকৃত নোমান, মনি হায়দার, মিলা মাহফুজ, মারুফ রায়হান, রেজা উদ্দিন স্ট্যালিন, আব্দুর রহমানসহ অনেকে।