কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়ানো শিশুদের বিনোদনের পাশাপাশি তার আশপাশের সমাজকে বুঝতে এবং বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতে পশ্চিমা বিশ্বে কয়েক শতক আগেই শুরু হয়েছে গ্রাফিক নভেলের চর্চা। গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে আমাদের দেশেও এসে পৌঁছেছে সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যানদের নিয়ে তৈরি সে সকল গ্রাফিক নভেল। কিন্তু বাংলাভাষী শিশুদের জন্য বাংলায় বাস্তব ইতিহাস নির্ভর প্রথম গ্রাফিক নভেলের নাম ‘মুজিব’।
সুপারম্যানের মত অতিকল্পনীয় কোন শক্তি নয় বা ব্যাটম্যান-আইরনম্যানদের মত প্রযুক্তির ঝংকারও নয়। বাংলাদেশের আরও আট-দশটি পরিবারের মতই খুব সাধারণ পরিবার থেকে একজন মুজিবের সক্রিয়তায় একটি জাতির কাছে সুপারহিরোতে পরিণত হওয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ এ।
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) প্রকাশিত দশম সিরিজের নভেলটিতে তুলে ধরা হয়েছে জাতির পিতার জীবন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি অবলম্বন করে শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে এই গ্রাফিক নভেল তৈরি।
আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া অমর একুশে বইমেলায় নভেলটির এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবগুলো সংখ্যা পাওয়া যাবে সিআরআই-এর স্টলে। এ ছাড়াও অনলাইনেও এই সংখ্যাগুলো পাওয়া যাবে। মোট ১০ খণ্ডে সমাপ্ত হচ্ছে এই গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’।
গ্রাফিক নভেলটিতে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ঘটনার বাইরেও তার জীবনের অনেক অজানা ঘটনা উঠে এসেছে। শিশুদের উপযোগী করে বানানো নভেলটি দেখে তারা ভাববে যেন মুজিব তাদেরই একজন। কেননা এখানে উঠে এসেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের এমন অনেকগুলো খুঁটিনাটি বিষয়, যা শিশুদের দারুণ আকৃষ্ট করে।
গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’-এর জন্ম প্রসঙ্গে এর প্রকাশক বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও সিআরআই ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক তার প্রথম বাংলাদেশে আসার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি বনানীতে এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি হই। কিন্তু আমাকে সেই স্কুল পরিবর্তন করতে হয়। আমি বিষয়টি নিয়ে খুব বিরক্ত ছিলাম এবং জানতে চাইলাম মায়ের কাছে, কেনো আমাকে স্কুল পরিবর্তন করতে হবে। তখন তিনি জানান, খুনিদের ছেলেরাও এই স্কুলে পড়ছে। তখন আমি জানতে চাইলাম, কিভাবে খুনিরা এখনও মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে? তখন আমাকে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স প্রসঙ্গে জানানো হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবার কখনো আমাদের কাছ থেকে ইতিহাস লুকিয়ে রাখেনি। তাই এই নৃশংস ঘটনা সম্পর্কে আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়।’ সে সময় তার সঙ্গে থাকা শিশুরা বঙ্গবন্ধুর এই ঘটনাগুলোর কিছুই জানতো না বলেও জানান তিনি।
রাদওয়ান মুজিব বলেন, ছোটবেলা থেকে মা-খালার কাছ থেকে নানার (বঙ্গবন্ধু) অনেক গল্প শুনতাম এবং অনেক প্রশ্ন করতাম। নানা কেমন ছিলেন, উনি কি করতেন ইত্যাদি। ধীরে ধীরে তাঁকে জানতে পারি। আমার মত এখনকার শিশুরাও নিশ্চয়ই তাকে জানতে চান। সে কারণেই শিশুদের উপযোগী করে বই প্রকাশের এ উদ্যোগ।
গ্রাফিক নভেল মুজিবের আরও একটি বিশেষত্ব হলো, এর প্রতিটি সংখ্যার সম্পাদনা করেছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। প্রতিটা সংখ্যার ড্রাফট কপি তাদের হাতে পৌঁছে দিলে সেখান থেকে চরিত্রগুলোর বক্তব্য, কাপড় পরা, এমনকি ট্রেনের বগির নম্বর পর্যন্ত লক্ষ্য রেখে এই সম্পাদনার কাজটি করা হয়েছে। কেননা তার স্মৃতিপটে সে সময়ের প্রতিটি ঘটনাকে চোখ বন্ধ যেন বাস্তবে দেখতে পান তারা। আর সে কারণেই তাদের সম্পাদনায় আরো নিখুঁত ও নির্ভুল হয়ে ওঠে প্রতিটি সংখ্যা।
দশটি সিরিজের গ্রাফিক নভেল মুজিবের প্রতিটি খণ্ডে তার জীবনের আকর্ষণীয় কিছু ঘটনা রয়েছে। প্রথম পর্বে স্কুলের শিশু ছাত্র মুজিবকে দৃষ্টিশক্তির সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করার পর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে গেলে কিভাবে তাকে আবার ফেরত আনা হয় এবং এরপর শৈশব ঘরে কিভাবে কাটে সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে দ্বিতীয় সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে তার শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেয়ার ঘটনা। যেখানে তিনি ফুটবলের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। এই পর্বে মুজিব ও তার বাবার একটি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ম্যাচে শেষ পর্যন্ত মুজিবের দল জয় পায়, নাকি তার বাবার দল?
তৃতীয় পর্বে দেখানো হয় দুর্ভিক্ষের চিত্র। যেখানে একজন গ্রামের যুবক ক্ষুধার্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। সংগঠক হিসেবে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানুষের পাশে দাঁড়াতে সব ধরণের ভূমিকা পালন করেন। এই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করে মুজিব কী পারবে তার গ্রামের মানুষকে রক্ষা করতে?
চতুর্থ পর্বে অল্প টাকা নিয়ে মুজিবকে দেখা যায় দিল্লি যাত্রা করতে। সেখানে গিয়ে হঠাৎ বিপদে পড়লেন তিনি। কিভাবে সেই বিপদ কাটিয়ে উঠবেন মুজিব?
দুর্নীতি ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তার দৃঢ় সংকল্প বর্ণিত হয়েছে পঞ্চম পর্বে। যেখানে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মুসলিম লীগ নেতার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছিলো। কী করেছিলেন তখন মুজিব?
ষষ্ঠ পর্বে তার আজীবন রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের গল্প আঁকা হয়েছে। এইভাবে গল্পটি তার স্বপ্নময় যৌবন থেকে রাজনৈতিক টালমাটাল সময়ে চলে গিয়েছিল যা পরবর্তীতে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। মুজিবের রাজনীতিতে প্রবেশের রোমঞ্চকর বর্ণনা রয়েছে এই পর্বে।
উপমহাদেশকে বিচ্ছিন্নকারী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে চিত্রিত করা হয়েছে সপ্তম পর্বে। যেখানে রাস্তাঘাট লাশে ছেয়ে গেছে। কারফিউর মধ্যেও মুজিব তার জনগণকে সাহায্য করতে বেরিয়েছিলেন। একটি মিলিটারি জীপ তার কাছে এলে সে অন্য লাশের পাশে মরার মতো ভান ধরে শুয়ে পড়েন। ভারতীয় অহিংস নেতা মহাত্মা গান্ধীকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায় সেই দাঙ্গা। মুজিব সেই দাঙ্গার ছবি লুকিয়ে কিভাবে মহাত্মা গান্ধীর কাছে পৌঁছে দেন, জানা যাবে এই পর্বে।
অষ্টম পর্বে তুলে ধরা হয়, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনা। যেখানে মুজিব কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করেন। একটি ঘটনায়, সাইকেল আরোহী মুজিবকে তাড়া করছিলো পুলিশ জিপ। কিন্তু কেনো তাড়া করছে, তাকে কী পুলিশ ধরে ফেলেছে, কি হয়েছিলো তারপর? এমন সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে এই পর্বে।
দেশভাগ পরবর্তী টালমাটাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তরুণ নেতা মুজিবের শাসক গোষ্ঠীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দলকে সংগঠিত করার রোমাঞ্চকর সব অভিযানের গল্প উল্লেখ রয়েছে নবম পর্বে পর্ব। মিশন পাঞ্জাব-এ মুজিব কী পারবেন সফল হতে?
‘মুজিব’ গ্রাফিক নভেল সিরিজের শেষ পর্ব (দশম) ‘মুক্তির পথে’ বের হয়েছে। এ পর্বে থাকছে তরুণ নেতা মুজিবের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের মিথ্যা অপবাদ, জেল-জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার গল্প। কিভাবে ছোট্ট ‘মুজিব’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিণত হয়েছেন তার পরিপূর্ণতা মিলবে এই পর্বে।