‘আমাদের বেলা ফুরিয়েই যায়। অন্ধকার নাইমা আসে। কিন্তু নতুন সূর্যোদয় আর হয় না।’ শোভার এক প্রশ্নে যখন রাজুর এমন উত্তর আসে তখন কোটি প্রবাসীর মনের কথা উচ্চারিত হয় যেন। চাপা কান্নায় মথিত হয় মন। শোভার সঙ্গে সংসার হবার কথা ছিল। সন্তানের নামও ঠিক করা ছিল। কিন্তু হয়নি। সংসারের ঘানি টানতে অনেকটা পালিয়ে বিদেশ চলে গিয়েছিল রাজু। তারও আগে জীবন বাস্তবতায় হারিয়ে ফেলা প্রেয়সীর বাবা যখন জিজ্ঞাসা করে ‘তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?’ রাজু স্বাভাবিক উত্তরই দেয়। বলে, ‘বাবা-মা ভালোই আছেন। তাদের অনেক আশা, অনেক চাওয়া আমার কাছে।’ শোভার তীক্ষণ প্রশ্ন, ‘তোমার কোনো চাওয়া নেই?’ উত্তরে রাজু বলে, ‘এক সময় ছিল, এখন আর নেই।’ তখন ঘানি টেনে ক্লান্ত এক কলুর বলদ এর স্বগতোক্তি বড় পোড়ায় দর্শক চিত্ত।
আবার বিদায় বেলায় বাজতে থাকা গান যাচ্ছি ছেড়ে আমার শহর/ যাচ্ছি ছেড়ে মা/ইচ্ছা করে থাকতে ভীষণ / থাকতে পারিনা/ ভালো থেকো প্রিয় মানুষ/ নাইবা নিলে খোঁজ/ দূর প্রবাসের একই আকাশ তোমায় খুঁজি রোজ। জয় শাহরিয়ার কথা সুরে পারভেজ সাজ্জাদের গানের দহন রেখে দেয় বেদনার রেশ।
প্রবাসী আবেগের ঢেউ উঠেছে ইউটিউব দুনিয়াতেও। চ্যানেল আই এর নিজস্ব ইউটিউবতো বটে বিভিন্ন ভাবে আপলোডের হিড়িকও পড়ে গেছে নাটকটি নিয়ে। সব মিলয়ে ৮৮ টি লিংক মেলে কলুর বলদ নাটকের। চ্যানেল আই ইউটিউবের প্রায় ৭ লাখ ভিউসহ সব মিলিয়ে ২ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায় ভিউ। ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নাটকের দর্শক মন্তব্যেও ছিল প্রশংসা এবং আবেগের ছড়াছড়ি। একজন লেখেন, নাটকতো নয় বাস্তব জীবন। দেখতে দেখতে কখন চোখের কোনে পানি জমেছে টের পাইনি। ভালো থাকুক সমস্ত প্রবাসী বীরেরা।’ এরকম অসংখ্য মন্তব্যে ভরা সোশাল ফিড।
এক প্রবাসীর মর্মস্পর্শী উপলব্ধি নিয়ে নাটকটি লিখেছেন মেজবাহউদ্দিন সুমন। আর ‘কলুর বলদ’ নামে টেলিফিল্মটি নির্মাণ করছেন ‘গোপিত’, ‘জ্যামপুত্র’ খ্যাত সাজ্জাদ সুমন। প্রবাসী এক যুবকের দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে ‘কলুর বলদ’ নাটকটির গল্প শুরু। যে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমায়। একদিকে চাকরি থেকে বাবার অবসর। অন্যদিকে এক বোনের বিয়ে হয়েছে এবং আরো দুজন ছোট ভাই-বোন রয়েছে। পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বলতে বড় ছেলেটি। যার কারণে বাধ্য হয়ে ভালো আয় রোজগারের আশায় বিদেশে পাড়ি জমায় সে। দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে রাজু দেশে টাকা পাঠায়। তার উপার্জিত অর্থে বাবা দেশে বাড়ির কাজ শুরু করেন। তা ছাড়া পুরো পরিবারের খরচও বহন করে রাজু। প্রেমিকা শোভাকে না বলে বিদেশ গিয়েছিল সে। যাওয়ার সময় শোভার জন্য একটি চিঠি রেখে গিয়েছিল।
মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের জন্য কাপুরুষের মতো নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দেয় রাজু। দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে দেশে ফিরেছে সে। দেশে ফেরার পর বাবা, ভাই, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই জিজ্ঞেস করে ‘আবার কবে যাবি’। বাবার তাগিদ বাড়িটির আরেক তলা উঠাতে হবে, মেয়েটির বিয়ে দিতে হবে, ছোট ছেলেটিকে মেডিক্যালে ভর্তি করাতে হবে। এজন্য আরো টাকা লাগবে।
শুধু মা আর শোভা চায় রাজু বিয়ে করে দেশে সেটেল হোক। রাজু নিজেও দেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার ভাবনা নিয়েই দেশে ফিরেছে। কারণ দীর্ঘ সময় আপনজনদের কাছ থেকে দূরে থেকে রাজু অনেক ক্লান্ত। কিন্তু সবার চাওয়া আর রাশি রাশি সমস্যার সামনে নিজের কোনো ইচ্ছের কথাই আর বলতে পারে না। নিজের সমস্ত চাওয়া, স্বপ্ন, ভালোলাগা, হৃদয়ের খুব গোপনে লালিত কষ্ট অগোচরে জমা রেখেই আবার বিদেশে চলে যায় রাজু। এই হলো নাটকটির গল্পের সারাংশ।
গল্পটি তখনই সবার হয় যখন গল্পের চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারেন দর্শক। কলুর বলদে সব চরিত্রকে মনে হয়েছে আমাদের চেনা চরিত্রের গল্প। রাজুর দেশে ফেরার আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া গল্পে সময় যত গড়িয়েছে খুলেছে বিষাদের পাতা। স্বল্প সময়ে যতটুক সম্ভব সরল ভঙ্গিমায় বলে গেছেন নির্মাতা। অতি ভারক্রান্ত না করে।
পুরো নাটক জুড়ে প্রবাসী রাজুর চাপা কষ্ট নাড়া দেয় দর্শককে। তবে একটি চরিত্রকে মনে হয়েছে নাটকের মিসকাস্ট। নায়ক রিয়াজের অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। বিশেষ করে তার কণ্ঠস্বরে রিয়াজ ফুঁটে ওঠেনি। অনবদ্য ছিলেন মামুনুর রশীদ। মা দিলার জামান ভালো কিন্তু কিছু জায়গায় অভিব্যক্তির শূণ্যতা বা অতি নাটকীয়তা ছিল। অভিনেত্রী তানিয়া যথার্থ ছিলেন তার ভূমিকায়।
নাটকটি উপলব্ধি করতে শেখাবে এই প্রশ্ন যে,প্রবাসীরা শুধুই টাকার মেশিন? দেশে ফিরলে সবাই তাকে তাড়া দেবে ফিরে যাওয়ার জন্য। জিজ্ঞাসা করবেনা তার কষ্টের কথা। তার চাওয়ার কথা। বাবা-ভাই-বোন কেউ না!
কাঁদবে কেবল মা। থাকতে বলবে কেবল মা। কিন্তু চলে যেতে হবে এমন সব রাজুকে। আহারে কলুর বলদের জীবন।
কলুর বলদ