সামাজিক গণ মাধ্যমে কয়েকদিন আগে একটি অনুরোধ সবাইকে কাঁদিয়ে দিয়েছে। লকডাউনে কাজ গেছে। বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন না। ফলে বাড়ির মালিক বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।পরিবারটির কার্যত খাওয়া জুটছে না। এই অবস্থায় সামাজিক গণ মাধ্যমে তাদের কাতর আবেদন; তাদের দুটি পোষ্য কে তারা পেট ভরে খাবার-ই দিতে পারছেন না, চিকিৎসা তো দূরের কথা। তাই যদি কোনো সহৃদয় পরিবার পোষ্য দুটিকে পালন করেন, এ জন্যে সামাজিক গণ মাধ্যমে কাতর আবেদন জানিয়েছেন ওই পরিবারটি।
সেই সামাজিক গণ মাধ্যমেই লকডাউন, করোনা, অতিমারি, ভয়ঙ্কর ছাঁটাই– এই ভয়াবহ সময়ে একদা আগুনখেকো এক নেতার পুত্রের জন্মদিন পালনের ছবি, নেতা পুত্রটি নিজেই দিয়েছেন।পিতাসহযোগে কেক কাটার ছবির পাশে, জন্মদিন পালনে পেল্লায় দুটি ইলিশ মাছের ছবি তিনি দিয়েছেন। নেতাপুত্র ভালো চাকরি করেন। তার পত্নী ও উঁচু দরের চাকরি করেন। পিতা দলের সর্বক্ষণের কর্মী হলেও মা ছিলেন অধ্যাপিকা।ডাক্তার মাতামহের কোনো সম্পত্তির পরোয়া না করেই নেতাপুত্রটি অমন এক জোড়া কেন, দশ জোড়া দুই , আড়াই কিলো করে ইলিশ কেনার ক্ষমতা রাখেন।
কিন্তু প্রশ্নটা হল, তারই শত শত সহযোদ্ধা, কমরেড কার্যত চাকরি বাকরি হারিয়েছেন এই অতিমহামারির কালে। ভয়াবহ সঙ্কটের সঙ্গে গোটা মানবসমাজের অংশ হিশেবেই নেতাপুত্রের কমরেডদের লড়াই করতে হচ্ছে। করোনার বৈশ্বিক থাবায়, যাঁরা এই মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হন নি, তাঁদের ও একটা বড় অংশ প্রায় রাতারাতি মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তে পরিণত হয়েছেন।
নিম্নবাত্তের একটা অংশ লঙ্গরখানার লাইনে দাঁড়ালেও, মধ্যবিত্ত, যাদের চাকরি গেছে, বাবার অসুখ, নিজেও কোনো না কোনো অসুখে ভোগেন।তাই হয়তো মাসে সব মিলিয়ে ওষুধ বাবদই তার হাজার দশেক টাকা খরচ করতে হয়।সন্তানের পড়াশুনা। ইস্কুল, কলেজ বন্ধ। অথচ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এই সময়কালে ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নিতে ছাড়ছেন না। সেই ‘ কমরেড’ টি কিন্তু এখনো মধ্যবিত্ত ট্যাবুতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন না বিনামূল্যে বিতরিত সবজি বাজারে গিয়ে দাঁড়াতে।
সেই নেতাপুত্রেরই কমরেডরা যখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থনৈতিক অবস্থা বিচার করে কমিউনিটি কিচেনের জন্যে স্লিপ বিলি করছেন, অতিমারি, লকডাউনের দাপটে চাকরি হারানো একজন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, যিনি বামপন্থী মিটিং, মিছিলের ও হয়ত নিয়মিত মুখ, তিনি মধ্যবিত্ত মানসিকতার দরুণই পারছেন না, সহযোদ্ধাদের কাছে, নিজের আর্থিক অবস্থার বর্তমান প্রেক্ষিতটি বলে কমিউনিটি কিচেনের জন্যে স্লিপ নিতে। সেই যুবক বা ছাত্র কিংবা সংসারজালে আবদ্ধ একজন মানুষ, তিনি বাম- ডান- অতি বাম ,তথাকথিত নিরপেক্ষ- যাই হোন না কেন, যখন সামাজিক গণ মাধ্যমে দেখবেন বা বন্ধুবান্ধবের কাছে শুনবেন, নেতাপুত্রের জন্মদিনে পাঁচ হাজারি জোড়া ইলিশের গল্প, তখন তাঁর মনের অবস্থাটা কি হবে?
শঙ্খ ঘোষের কবিতার পঙতি;’ নিয়ন আলোয় পণ্য হল, যা কিছু আজ ব্যক্তিগত’র ভয়ঙ্কর , কদর্যতায় এই অতিমারির কালে আমাদের সমাজজীবন আর ও একটা বিশেষ রকমের প্যান্ডেমিক অবস্থার ভিতরে আমাদের ঠেলে দিয়েছে।বহু বামপন্থী ছাত্র যুব জীবন বাজি রেখে এই অতিমারির কালে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এঁদের সকলের যে লড়াই , তাকে উপেক্ষা করে একটা অংশের নীচু তলার নেতারা সবটুকুর কৃতিত্ব নিজের পকেটে ভরতে চান। সাধারণ কর্মী, সমর্থকদের যে হাড় ভাঙা পরিশ্রম, তার সবটুকু ফসল ওঠাতে চান একাংশের ‘ আমাকে দেখো ‘ গোছের নেতা। এই প্রবণতা বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলির ভিতরে শোভা পায়। কারণ, এটাই ওদের দস্তুর। এটা শোভা পায় না বামপন্থীদের ভিতরে। কমরেডশিপের আকাল যেন রাজনীতি থেকে সমাজের , এমন কি পরিবারের অন্দরেও এত বেশি রকমের প্রকট হয়ে উঠছে, যাতে এই সময়কালে সবটাই নেতার ছেলের জন্মদিনের বাজখাই জোড়া ইলিশের মত ব্যাপারটা হয়ে যাচ্ছে।
নিজের সামর্থে কুলোলে এক জোড়া কেন, দশ জোড়া ইলিশ খাওয়ার ভিতরে এতটুকু অন্যায় নেই। অপরাধ নেই। আছে রুচির প্রশ্ন। থেকে যাচ্ছে মানসিকতার বিষয়টি। আমার সামর্থ আছে, আমি এই আকালের বাজারেও জোড়া ইলিশ কিনতে পারছি। ভালো কথা। কিন্তু এই জোড়া ইলিশ কিনতে পারার হাম বড়াইটা কেন ফেসবুকে আমি গাবিয়ে বেড়াব? আর আমি যদি সাধারণ মানুষের বাইরের কেউ হই, কোনো কেষ্টবিষ্টুর ছেলেপুলে হই, তাহলে তো আমার সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সর্বোপরি মানবিক দায়িত্বটা গড়পড়তা মানুষদের মত হতে পারে না। আমার কমরেডের বাড়িতে গরম ভাতের গন্ধ বেরুচ্ছে কি না, সেটা বোঝা আমার পক্ষে বেশি দরকার, নাকি আমার কাছে নিজের জন্মদিনের জোড়া ইলিশের ছবির প্রদর্শনী করে হাড়ের গরমটা জানান দেওয়া বেশি জরুরি?
ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে যে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি, এটা কি সবাই উপলব্ধি করতে পারছি? অতিমারির সুযোগ নিয়ে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা এখন পরিণত হয়েছে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে। ভারতে এখন কার্যত শাসকের বিরুদ্ধাচারণ করাটাকেই দেশবিরোধিতার নামান্তর বলে ধরে নেওয়াটা রেওয়াজ হয়ে যেতে শুরু করেছে। ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট। বেকারি।ভয়ঙ্কর রকমের ছাঁটাই। বড় বড় বহুজাতিক সংস্থাগুলির উঁচু দরের কর্মীরা পর্যন্ত অতিমারির ফলে কাজ হারাচ্ছেন।কৃষি ব্যবস্থা ধুঁকছে। অথচ বাজারে আগুন। কিন্তু কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। গোটা দেশেই ফাটকা কারবারীরা শাসক ছত্রছায়ায় থেকে দশ টাকার জিনিষ দু’টাকায় বিক্রি করছে দেদারসে। রাজনৈতিক দলগুলি অনেকটা ব্রিটিশ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মত বিবৃতির প্রতিযোগিতার ভিতরেই নিজেদের প্রতিবাদকে সীমাবদ্ধ রাখছেন। নতুবা বাড়ির ছাদে বৌ বাচ্চাসহ বুকে পোস্টার লটকিয়ে ফেসবুকে ছবি দিয়েই প্রতিবাদের মহান দায়িত্ব পালন করছেন। তাই নেতার ছেলের জন্মদিনের জোড়া ইলিশ, অর্থাৎ; এই হাড়ের গরম প্রকাশের মানসিকতার ভিতরেই এখন রাজনীতির সমস্ত নীতিমালাকে আবদ্ধ রাখার নিত্যনোতুন তত্ত্ব আবিস্কার এবং সেই তত্ত্বের চর্চার মুখ্য উপজীব্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
রাজনীতি শব্দটির অর্থ যে কেবল মিটিং মিছিল নয়, শুধুমাত্র ক্ষমতা দখল নয়। সরকার তৈরি নয়।রাজনীতির মূল লক্ষ্য হল, সমাজবদল। মার্কস, লেনিন, গান্ধী ,বঙ্গবন্ধু– প্রত্যেকেরই যে এটাই ছিল মূল লক্ষ্য , সেটা তাঁদের অনুগামীরা কার্যত ভুলেই গেছেন। সমাজ বদলের স্বপ্নে লেনিনের দুনিয়া বদলের বিপ্লব, রুশ দেশে সামাজিক পরিবর্তনের পক্ষে লড়াইটাকে লেনিনের জীবনাবসানের পর কতদিন ধরে রাখতে পেরেছিল-এই প্রশ্ন তুললে অনেকেই চটে যাবেন। ভারতের স্বাধীনতার আগে থেকেই স্বাধীনতার অন্যতম অংশ হিশেবে সামাজিক সংস্কারের যে সীমিত কর্মসূচির কথা গান্ধীজী বলেছিলেন, সেই কর্মসূচিগুলি , তাঁর জীবদ্দশাতেই কার্যত মুখথুবড়ে পড়েছিল। শ্রেণী চিন্তার প্রশ্নে গান্ধীর বুর্জোয়া, ধনীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, তাঁর জীবদ্দশাতেই গান্ধীবাদী সমাজ সংস্কারমূলক কাজগুলি একটা শৌখিন মজদুরিতে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে তার জীবদ্দশাতে যে আদর্শগত ভিত্তির প্রসার ঘটেছিল, তাঁর শাহাদাতবরণে সেটি চরম বিঘ্নিত হয় ।তাই সোভিয়েট কালের সেই দেশ থেকে শুরু করে , গান্ধীর সময়কাল বা গান্ধী উত্তর ভারত বা বঙ্গবন্ধু উত্তর বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরীর মত হাতে গোটা দু চারজন মানুষের জীবনচর্চা ছাড়া , বাকিদের চর্চা, চর্যা, মূল্যবোধ, সহযোদ্ধাদের ভিতরে সেই মূল্যবোধের বিস্তার, সবকিছুই আগুনখেকো নেতার অগ্নিবর্ষী ছানাপোনার জন্মদিনের নধরকান্তি জোড়া ইলিশের মত হয়ে যায় আর কী !
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)