চীনের করোনা ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন করবে বলে উল্লেখ করেছে লন্ডনভিত্তিক পত্রিকা দ্য ইকোনোমিস্ট।
বুধবার পত্রিকাটিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কাজনক তথ্য উঠে এসেছে।
হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানের একটি বন্য প্রাণীর বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের আতঙ্কে ভুগছে সমগ্র বিশ্ব। ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করার পর চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে প্রদেশটির সঙ্গে অন্য এলাকার সব ধরনের পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ফলে সেখানকার প্রায় ৬ কোটি মানুষ প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। মৃতের সংখ্যা বেড়ে এখন ১৭০। এই ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী তিব্বতেও শনাক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে চীনের প্রতিটি অঞ্চলেই করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে।
চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন জানিয়েছে, দেশটিতে বুধবার (২৯ জানুয়ারি) পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ৭১১ জন।
ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ষোল শতকের কমপ্লেক্স প্যাভিলিয়ন ও পুকুরগুলি সাংহাইয়ের প্রাণ। সবকিছুতে যেন চাইনিজ নববর্ষের ছুটি চলছে। এর চলার পথগুলোতে রঙিন লণ্ঠন জ্বলছে, স্টলগুলি সজ্জিত, প্রবেশ পথ ভিড় সামালাতে কয়েক ডজন নিরাপত্তারক্ষীও রয়েছে। কেবল অনুপস্থিত মানুষ। করোনা ভাইরাসের ভয়ে তারা ঘরেই অবস্থান করছে।
সিল্ক-স্কার্ফ শপের ম্যানেজার লি জিনমিংয়ের বরাত দিয়ে ইকোনোমিস্ট বলছে, আমি যদি আজ কয়েকটি বিক্রয় করি, তবে আমি মনে করবো ভালো করছি। গত বছর ছুটির দিনগুলিতে ইউ গার্ডেন ৭ লক্ষ পযটককে আকৃষ্ট করেছিলো। কিন্তু এই বছরের ছুটির দিনের লোকসান মারাত্মক।
চীন এবং বিশ্বের বহু সংস্থার অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত দেশগুলির জন্য লির মন্তব্য বিশাল আশঙ্কার ব্যাপার। এর আগে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে ৪ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছিল। যদিও এবারের করোনা ভাইরাস এতোটা মারাত্মক নয়। কিন্তু এর প্রভাব ভয়ংকর মনে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক ধারণা করছে যে, মহামারী থেকে আক্রান্ত ৯০% অর্থনৈতিক ক্ষতি মানুষের অন্যের সাথে মেলামেশা করার ভয় থেকেই আসে, যার ফলে অফিস আদালত ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। চীনের অবস্থা এমনই।
ভাইরাস বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করায় চীন ভ্রমণে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফ্লাইট, হোটেল বুকিং বাতিল হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশটির পর্যটন খাত। দেশটির ক্রমবর্ধমান পর্যটন খাতে বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা।
চীনা লুনার ইয়ার উপলক্ষে প্রতিবছরই এ সময়ে পর্যটনমুখর থাকে চীনের হোটেল আর পর্যটন কেন্দ্রগুলো। পরিবারের টানে দেশে আসেন চীনারা। বিভিন্ন দেশ থেকে নতুন বছর উদযাপন করতে আসেন পর্যটকরা। যাত্রীসেবায় তাই ব্যস্ত থাকে এয়ারলাইন্সগুলো। কিন্তু এ বছরের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে ফিকে হয়ে গেছে উৎসবের আনন্দ।
এ বছর কয়েক লাখ মানুষ দেশটিতে ভ্রমণে যাওয়ার কথা থাকলেও ভাইরাস আতঙ্কে ফ্লাইট বাতিল করছেন অনেকে, বাতিল করছেন হোটেল বুকিংও। যাত্রীদের আগের বুকিং দেওয়া ফ্লাইটের ভাড়া ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীনা সাউদার্ন এয়ারলাইন্স, চীনা ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স ও চীনা এয়ার। হোটেলগুলোতেও নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা।
হোটেল, গাড়ি আর টিকিটের বুকিং বাতিলের জরিমানা মওকুফ করছে চীনের বৃহত্তম অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি ট্রিপ ডট কম। এ ঘটনায় কমেছে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের শেয়ারের দর।
চীনের অর্থনীতির ১১ শতাংশ নির্ভর করে পর্যটন খাতের ওপর। এ খাতকে ঘিরে কাজ করে ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স আর স্পেনের পর বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম পর্যটনবান্ধব দেশ চীন। ২০১৮ সালে দেশটিতে পর্যটক এসেছে ৬ কোটি। ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসলে তা দেশটির অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এর সর্বাধিক প্রত্যক্ষ প্রভাব হুবেই প্রদেশে অনুভূত হচ্ছে। এর রাজধানী উহানকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে তালাবদ্ধ রয়েছে। খাদ্য ট্রাক এবং চিকিৎসা সরবরাহ ব্যতিত খুব কমই এখানে প্রবেশ করতে পারে এবং কম লোকই সেখানে যাওয়ার অনুমতি পায়। হুবেই চীনের জিডিপির ৪.৫% সরবরাহ করে থাকে।
অন্যান্য শহরের লোকজন সেখানে স্বাভাবিক জীবন চলাচল থামিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে গ্রাহকদের ওপর। ক্ষতির পরিমাণ কতোটা হবে তা নির্ভর করছে ভাইরাসটি কখন থামানো যাবে তার ওপর। গত বছর খুচরা বিক্রয় নতুন বছরের সপ্তাহে ১৪৪ বিলিয়ন ডলার ছিল, কিন্তু এখন তা অনেক তলানিতে নেমে পড়েছে। কিছু শিল্প বিশেষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত বছরের এই ছুটির দিনে চীনের বক্স অফিসের ৯% আয় ছিলো। এ বছরে দেশের প্রায় ১১ হাজার সিনেমা বন্ধ রয়েছে।
সাংহাই ও গুয়াংডং প্রদেশসহ বেশ কয়েকটি বড় অর্থনৈতিক কেন্দ্র নতুন বছরের ছুটি এক সপ্তাহের মধ্যে বৃদ্ধি করেছে। সংস্থাগুলি ১০ ফেব্রুয়ারি অবধি ছুটি বাড়িয়েছে। চীনের অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ঘরে বসেই কর্মীদের কাজ করতে দেয়, তদুপুরি কয়েক মিলিয়ন অভিবাসী শ্রমিক ছুটির দিনে তাদের নিজ শহরে ফিরে এসেছে, তাদের চাকরিতে ফিরে যাওয়ার সময় অনিশ্চিত।
সার্স ভাইরাসের তুলনায় করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালে চীন গ্লোবাল জিডিপির ৪% উৎপাদন করেছিল। গত বছর এটি ছিল ১৬%। এখন তা নিচের দিকে। থাইল্যান্ডসহ আশপাশের অনেক দেশ চীনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য হ্রাস করার চিন্তা করছে। স্টারবাকস চীনে তার ৪,২৯২ ক্যাফের অর্ধেকেরও বেশি অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির মধ্যদিয়ে যাবে।
আমেরিকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চীন যে অবস্থানে আছে তা থেকে অনেক দূরে সরে যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী যার ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
চ্যান লং অফ প্লেনাম নামক একজন পরামর্শদতাতা মনে করেন, প্রথম প্রান্তিকে চীন প্রবৃদ্ধি বছরে বছরে ২% হ্রাস পেতে পারে, যা দশকের মধ্যে এটি সবচেয়ে দুর্বল। তবে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা গেলে এই ক্ষতি পোষিয়ে আনা যাবে।