গত জানুয়ারির শুরুতে চীনের উহান শহরে নতুন একটি ভাইরাস ছড়ানোর খবর ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিল শহর কর্তৃপক্ষ। শহরের এক চিকিৎসক যখন তার সহকর্মীদের সার্স জাতীয় নতুন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে সতর্ক করছিলেন, তখন পুলিশ এসে তাকে বলেছিল এসব কথা বন্ধ করতে।
একমাস পর আজ সেই চিকিৎসক নিজেও করোনা নামের ওই নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের বিছানা থেকে নিজের সেই ‘মুখ বন্ধ করানো’ গল্প সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছেন তিনি, যার মধ্য দিয়ে তিনি রাতারাতি হয়ে উঠেছেন জনগণের হিরো।
‘সবাইকে শুভেচ্ছা, আমি লি ওয়েনলিয়াং, উহান সেন্ট্রাল হসপিটালের একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ,’ পোস্টের শুরুটা এরকম। তারপর সেখানে একে একে জানানো হয়েছে শুরুর দিকের ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে উহান কর্তৃপক্ষের ত্রুটিপূর্ণ প্রচেষ্টার হতাশাজনক ছবিই যেন ফুটে উঠেছে।
ডা. লি ডিসেম্বরেই উহান সেন্ট্রাল হসপিটালে কাজ করা শুরু করেন। ওই সময় তিনি হাসপাতালে ৭ জন রোগীকে শনাক্ত করেন যাদের মধ্যে সার্স সংক্রমণের মতো লক্ষণ রয়েছে। এই সার্স ভাইরাস ২০০৩ সালে বিশ্বজুড়ে মহামারীর সৃষ্টি করেছিল।
ধারণা করা হচ্ছিল ওই ৭ জন উহানের হুয়ানান সিফুড মার্কেট থেকে কোনোভাবে অসুস্থ হয়েছিলেন এবং পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসার জন্য তাদেরকে হাসপাতালে বিচ্ছিন্ন করে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছিল।
গত ৩০ ডিসেম্বর লি একটি গ্রুপ চ্যাটে তার সহকর্মী অন্যান্য চিকিৎসকদের ওই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সুরক্ষা পোশাক পরতে পরামর্শ দেন।
কিন্তু ডা. লি তখনও জানতেন না যে, ওই ৭ জনের দেহে যে রোগ ধরা পড়েছে তা একেবারে নতুন একটি ভাইরাস।
এর ঠিক চারদিন পর জননিরাপত্তা ব্যুরোর কয়েকজন কর্মকর্তা তার সঙ্গে দেখা করতে এসে তাকে একটি চিঠিতে সই করতে বলেন। চিঠিতে তার বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা মন্তব্য করে সামাজিক শৃঙ্খলা ব্যাহত করা’র অভিযোগ তোলা হয়েছিল।
চিঠিতে লেখা ছিল: ‘আমরা কঠোরভাবে আপনাকে সতর্ক করছি: যদি আপনি এভাবেই জেদ ধরে রাখেন, অশিষ্টতা দেখাতে থাকেন এবং অবৈধ কার্যকলাপ করতে থাকেন, তাহলে আপনাকে বিচারের আওতায় আনা হবে – আপনি কি বুঝতে পেরেছেন?’
চিঠির নিচে ডা. লি ওয়েনলিয়াংয়ের নিজ হাতে লেখা ছিল: ‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি।’
পুলিশের বক্তব্য অনুসারে, ওই সময় লিসহ আটজনের বিরুদ্ধে ‘গুজব ছড়ানো’র অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছিল।
অবশেষে প্রমাণ হলো যে লি গুজব ছড়াচ্ছিলেন না, বরং তার প্রাথমিক আশঙ্কা আরও বড় রূপ নিয়ে সত্যি হয়েছে। সেখানে সরকারের নেয়া ব্যবস্থাই ছিল দুঃখজনক।
জানুয়ারির শেষের দিকে ডা. লি সেই চিঠির একটি কপি পোস্ট করে পুরো ঘটনাটি ব্যাখ্যা করেন চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইবোতে। অবশ্য ইতোমধ্যে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
জানুয়ারির প্রথম কয়েক সপ্তাহে উহান কর্তৃপক্ষ দাবি করছিল, শুধু আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে এলেই মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। চিকিৎসকদের জন্য তখন কোনো সতর্কতা নেয়া হয়নি। কারণ ধরেই নেয়া হয়েছিল, মানবদেহ থেকে মানবদেহে ভাইরাসটি ছড়ায় না।
বিবিসি জানায়, পুলিশ বাসায় আসার সপ্তাহখানেক পর ডা. লি এক রোগীকে গ্লুকোমার চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। তিনি জানতেন না যে ওই নারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত।
উইবো পোস্টে লি জানান, এরপর ১০ জানুয়ারি তার কাশি শুরু হয়। পরদিন থেকে জ্বর, আর তার দু’দিন পর তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। লি’র পর তার বাবামাও অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এর দশদিন পরই, অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি করোনা ভাইরাসকে জরুরি স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে ঘোষণা করে চীন সরকার।
ডা. লি জানান, তাকে বেশ কয়েকবার নানারকম পরীক্ষা করার পরও প্রত্যেকবার করোনা ভাইরাসের টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভই আসছিল। অবশেষে ৩০ জানুয়ারি নিউক্লিয়িক অ্যাসিড টেস্টের ফলাফল পজেটিভ আসে। ওই দিনই উইবোতে পোস্ট দিয়ে পুরো বিষয়টি জানান এই চিকিৎসক।