চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

করোনায় ‘না’ জয়যুক্ত হলে বিপদ

‘না’ শব্দের সাথে আমাদের সংযোগ প্রবল। পারবো না, করবো না কিংবা করতে দেবো না। এর সাথে বাঙালির যোগসূত্র প্রাচীন। এজন্যই ‘পারিব না’ কবিতা লিখে কবি কালী প্রসন্ন ঘোষ উৎসাহ দিয়েছেন। কবিতায় তিনি লিখেছেন:
‘‘পারিবো না–এ কথাটি বলিও না আর,
কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার;
পাঁচজনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা,
পারো কি না পারো করো যতন আবার
একবার না-পারিলে দেখো শতবার।’’

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের এই ‘পারিবো না’ রোগ নতুন করে দেখা গেছে, করোনা মোকাবেলায় ছুটি ঘোষণার আগে ও পরে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী অন্যতম সফল ব্যবস্থা হলো লকডাউন। নিজের বাসায় অবস্থান করা। নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা রাখা। কিন্তু আমরা দেখলাম ইটালি ফেরত প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে পারবো না’র আবদার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে এ মামাবাড়ির আবদার মানেনি বিধায় ইটালি ফেরত যুবক কী আচরণ করেছিল, সেটা দেশবাসী সহ বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ দেখেছে। এখনও পর্যন্ত দেশে করোনায় যত রোগী আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন, তাদের সিংহভাগই ইটালি বা অন্য দেশ থেকে আসা প্রবাসী অথবা তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি। আইইডিসিআর এর তথ্যে এখনও পর্যন্ত এমন তথ্যই পাওয়া যায়।

এরপর আরেক ‘না’র সাক্ষী হলো দেশ। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের (আবাসিক) ভবনে করোনাভাইরাসের কোয়ারেন্টাইন সেন্টার খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সেই সেন্টারের দায়িত্বে ছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু সেখানেও স্থানীয়দের না। ওই ভবনে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার খোলায় প্রতিবাদ জানান ভবনের মালিক ও বাসিন্দারা। তারা ওই ভবনের সামনে দিনভর বিক্ষোভ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেখান থেকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। করোনাভাইরাস নির্মূলে সহায়তার বদলে দ্বিতীয়বারের মতো ‘না’ জয়যুক্ত হয় সরকারের নমনীয় সিদ্ধান্তের ফলে।

একপর্যায়ে করোনার প্রাদুর্ভাব ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এতে প্রবল জনমতও ছিল। এই সাধারণ ছুটি দেওয়া হয়েছিল যে যেখানে আছে সেখানে অবস্থান করার জন্য। সেখানেও আমাদের না জয়যুক্ত হয়েছে। বিপুল জনসমাগম পাড়ি দিয়ে বাড়ি যেতে নিষেধ করা হলেও তা পাত্তা দেয়নি ঢাকা বা অন্যান্য শহরে থাকা বেশিরভাগ মানুষ। দেশের প্রথম সারির একটি ইংরেজি দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী এক কোটি বিশ লাখ মোবাইল ব্যবহারকারী এ ক’দিনে ঢাকা ছেড়েছেন। এরমধ্যে অনেকেই একাধিক সিম ব্যবহার করেন। সেই হিসাবে ধরলেও গড়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। এতে দেশব্যাপী গ্রামপর্যায়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরমধ্যে এমন শঙ্কা অনেক জায়গায় বাস্তবেও দেখা গেছে। ঢাকা থেকে যাওয়া কয়েকজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। তাহলে তাদের সঙ্গে গাদাগাদি করে যারা গ্রামে গেলেন, স্বাভাবিকভাবেই তারাও সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন। কিন্তু তাদেরকে এখন আলাদা করে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

‘বাঙালি মুসলমানদের করোনা হবে না’, বলে একসময় যারা নিয়ম না মানার শীর্ষে ছিলেন, তোয়াক্কা করেননি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারি নির্দেশনার, তারাই আবার করোনার ভয়ে ছুটলেন গ্রামের দিকে। এতে করোনার ঝুঁকি বাড়ায় অনেকে বিরুপ মন্তব্য করলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়, অনলাইনে, অফলাইনে। অনেকে আবার তাদের গালিও দিলেন। কিন্তু তখন চোখ থমকে যায় খিলগাঁও কবরস্থানে টাঙানো একটি ব্যানারে। সেখানে স্থানীয়রা বলছেন, ওই কবরস্থানে মহামারী করোনার শিকার হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের কবর না দিতে। এরপর আর বাড়ি যাওয়া মানুষদের বিষয়ে কিছু বলতে পারিনি। যে শহরে কেউ মারা গেলে কবরস্থানে দাফন করতে নিষেধাজ্ঞা টানানো হয়, সেখানে মানুষ থাকবে কেন? এমন প্রশ্ন তখন অযৌক্তিক মনে হয়নি। বরং বারবার এটা ভেবেই মন খারাপ হয়েছে। এটা যে শুধু বাংলাদেশেই হয়েছে তা নয়। প্রতিবেশি দেশ ভারতেও এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে। করোনার শিকার হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের শশ্মানে শেষকৃত্য করতেও বাধা এসেছে। এ যে একই উপমহাদেশ, এতে তা আরও একবার সামনে আসলো।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সর্বশেষ ‘না’ এসেছে তেজগাঁও শিল্প এলাকায়। এই ‘না’ এর অন্যতম কূশলী স্থানীয় কাউন্সিলর। তিনি আবার তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার সঙ্গে ‘না’ এর পক্ষে কিছু স্থানীয়। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় আকিজ গ্রুপের হাসপাতাল নির্মাণের কাজে বাধা দিয়েছেন তারা। এর ফলে হাসপাতাল নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাদের দাবি, এখানে হাসপাতাল হলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে। তবে তাদের এই দাবি পাত্তা পায়নি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে। তার হস্তক্ষেপে হাসপাতালের কাজ চলবে বলে জানানো হয়।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসছে, আমরা বিদেশ থেকে এসে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকবো না, সেনাবাহিনীকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার বানাতে দেবো না, সাধারণ ছুটিতে যার যার অবস্থান অনুযায়ী ঘরে থাকবো না, মুসলমানদের এসব হয় না বলে নিয়ম মানবো না, আবার মৃতদেহ কবরস্থানে দাফন করতে দেবো না, এমনকি করোনার চিকিৎসায় হাসপাতাল তৈরি করতে দেবো না; তাহলে আমরা আসলে করতে দেবো কী? এত ‘না’র মধ্যেও আমরা চাই করোনা যেন না থাকে দেশে। সেটা অবশ্যই চাই। এত ‘দেবো না’র পর এই চাওয়া কি ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার’ মতো হয়ে যায় না? করোনা মোকাবেলায় কোনো কিছু করতে না দিয়ে প্রাদুর্ভাব শূন্যের কোটায় আনার অলীক স্বপ্ন তো প্রত্যাশাই রয়ে যাবে।

তবে এটা ঠিক যে, এসব বিষয় নিয়ে ভাবার সময় এখন না। এজন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিলাম আমরা। উহান আক্রান্ত হওয়ার পরও আমরা এ সময় পেয়েছিলাম। তখন মন্ত্রী পরিষদের কতিপয় সদস্যের ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি। অথচ এখনও দেখতে হয় করোনা পরীক্ষার কিট সংকট, চিকিৎসকদের সুরক্ষা পোশাক ও যন্ত্রপাতির অভাব, চিকিৎসায় হাসপাতাল সংকট। এমন আরও অনেক বলা যাবে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তাই সকল ‘না’কে পরাজিত করে করোনার বিরুদ্ধে সম্মিলিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে এখনই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)