চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চিকিৎসা সেবার মান বাড়ানো জরুরি

করোনাভাইরাস মানুষের অন্ধবিশ্বাসে আঘাত হানছে। করোনাভাইরাস ইহুদিদের জন্য, মুসলিম নিধনকারীদের জন্য, তাদের কথা ইতোমধ্যে ভুল প্রমাণিত হচ্ছে৷ করোনা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টান, ইহুদি, আস্তিক, নাস্তিক সবার মাঝেই সংক্রমিত হচ্ছে। আগেকার দিনের মহামারীকে মানুষ ‘সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ’ বলে আখ্যায়িত করতো৷ ডায়রিয়ায় গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যাওয়াকে তারা বলতো কলেরা। কলেরা সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল কলেরার মাথা নেই৷ কলেরার উৎপাত হতে অসহায় মানুষ বাঁচতে দ্বারস্থ হতো কলেরা কবিরাজের৷ লাঠি হাতে এসব কথিত কবিরাজ কলেরাকে তাড়িয়ে গ্রামছাড়া করার কথা বলতো৷

সেই কলেরাই চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিতে আজ ডায়রিয়া বলে আখ্যায়িত হচ্ছে৷ কিন্তু এই আধুনিক যুগে এবার এলো করোনা৷ কিন্তু করোনা কবিরাজ যে বেরোচ্ছে না তা নয়৷ আগের দিনের কবিরাজরা থাকতো দেবতার আসনে এবার আসামীর আসনে৷ বাংলাদেশেও করোনা কবিরাজের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে৷

এ যুগের কিছু মানুষেরও বিশ্বাস ছিল। করোনা এসব অন্ধবিশ্বাসের অলৌকিক বিষয় নয়৷ মানুষ সতর্ক থাকলেই করোনা সংক্রমণ হতে দূরে থাকতে পারবে৷ সেজন্য দেশের রাষ্ট্রীয় আইন ও লকডাউন, হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, পিপিই পরার কথা বলছে৷ মসজিদে জমাতে নামাজ পরার উপরও নিষেধাজ্ঞা জারী করছে৷ নিষেধাজ্ঞা জারী হচ্ছে কাবাঘরের তওয়াফে৷ আজকের মানুষ সংক্রমণ হতে বাঁচতে নির্ভর করছে অন্ধবিশ্বাসের প্রতি নয় সতর্কতা ও প্রযুক্তি ভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি৷

মানুষের কেন মৃত্যু হয় আদিকাল হতে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে মানুষ। আগে বলা হতো সৃষ্টিকর্তা আয়ু থামিয়ে দিলেই মানুষের মৃত্যু ঘটে৷ বাইবেল, কোরআন এবং বেদের মতো গ্রন্থ অনুযায়ী, মৃত্যু বিধাতার হাতে লেখা। আবার আধ্যাত্মিক শক্তি বলে মানুষের জীবনকাল বেড়ে যেতে পারে বলেও বিশ্বাস করতো মানুষ৷ অলৌকিক ভাবে মৃতব্যক্তিকে প্রাণদানের ঘটনার কথাও বিশ্বাস করেছে মানুষ৷ কিন্তু বিজ্ঞান এসে কী বললো? বলল, মৃত্যু নিছক একটা টেকনিক্যাল সমস্যা। হার্ট ও রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেলেই মানুষের মৃত্যু ঘটে। ক্যানসার লিভার ধ্বংস করলে মানুষের মৃত্যু হয়। ভাইরাস ফুসফুস আক্রমণ করলে মানুষের মৃত্যু হয়। হার্টের পেশিতে যথেষ্ট অক্সিজেন না পৌঁছালে সে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে মৃত্যুর কারণ ঘটায়। জেনেটিক পরিবর্তনের জন্য ক্যানসার লিভারে ছড়িয়ে পড়লেও তা মৃত্যুর কারণ ঘটায়। হাঁচি কাশিতেও রোগ জীবাণু ছড়ায়৷

বিজ্ঞান মনে করে প্রতিটি কারিগরি সমস্যার পেছনেই কারিগরি কারণ থাকে। এখন আর কেউ মৃত্যু জয় করতে খ্রিস্টের আবির্ভাবের কথা ভাবে না৷ বিজ্ঞানের এত অগ্রগতিতেও মৃত্যুকে স্বাভাবিকতায় রাখা বা জয় করা কি সম্ভব হয়েছে? দেশে দেশে মৃত্যুর কারণগুলোর পেছনে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। নতুন নতুন ওষুধ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করা হচ্ছে৷ ঘরে ঘরে শিশুদের ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে৷ তাই আগের দিনের মতো এখন আর ঘরে ঘরে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে না৷

কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবন রক্ষার চেষ্টাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেল। ‘মহামারীতে মানুষ কেন মরে, এই প্রশ্নের উত্তরে আগে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার কথাই বলতো। এখন সবাই ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পালন করে সতর্কতা৷ দেশে দেশে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব সৃষ্টিটা সেজন্যই সংঘটিত হচ্ছে৷ দেশে দেশে বাড়ানো দরকার হাসপাতাল, উন্নতি ঘটানো দরকার চিকিৎসা বিজ্ঞানের৷ সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা দরকার এ খাতে৷ কোটি টাকার মসজিদ মন্দির গীর্জা প্যাগোডায় আজ মানুষ যেতে পারছে না৷ সরকারও বাধ্য হচ্ছে এসব উপাসনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করতে৷ করোনাকালে সারা পৃথিবীর মানুষ একটি ভ্যাকসিনের জন্য মুখিয়ে আছে৷

এজন্য মানুষের আরও বেশি প্রয়োজন চিকিৎসক, নার্সের৷ প্রয়োজন চিকিৎসকদের সুরক্ষা৷ প্রয়োজন শ্বাসযন্ত্রের মেশিন মজুদ। প্রয়োজন আরও বেশি টেস্টিং কিট। প্রয়োজন সুরক্ষার পোশাক। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন চিকিৎসাখাতে অধিক বিনিয়োগ ও বিনিয়োগের যথার্থ প্রয়োগ৷

‘মহামারীর আগে পরে আধ্যাত্মিক বিষয়ে বিনিয়োগ এত অবশ্যম্ভাবী না৷ সরকারের উচিত স্বাস্থ্য খাত উন্নত করতে বিনিয়োগ বাড়ানো। আধ্যাত্মিক বিষয়ে উন্নত হওয়া ব্যক্তির নিজের ব্যাপার। মাটির মেঝেতে মাদুর পেতে নামাজ পরা আর টাইলস করা মেঝেতে নামাজ আদায়ে কি পূণ্যের ভিন্নতা আছে? কোটি কোটি টাকা খরচ করে ব্যবহার উপযোগী পুরাতন মসজিদ ভেঙে নতুন মসজিদ করা হচ্ছে৷ কেন এই ব্যয় কি বাহুল্য নয়? ১০ লাখ টাকা ব্যয়ের মসজিদ ভেঙে করা হচ্ছে কোটি টাকার মসজিদ৷ অথচ পুরাতন মসজিদটি আরও ৫০ বছর পার করতে পারতো৷ বাংলাদেশে এরকম নজীর ভুরিভুরি৷ শুধু মসজিদ নয়, অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়ের বিষয়েও একই বাহুল্য লক্ষ্য করা যায়। এসব অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ করতে হবে। তবে এসব উপাসনালয়ে যে ব্যয় অত্যন্ত প্রয়োজন সেখানে বরাদ্দের বিষয়টি ভিন্ন, তা দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া দুর্নীতিসহ নানা খাতের হরিলুট বন্ধ করতে হবে।

মূল বিষয় হলো: স্বাস্থ্যখাতকে সবার উপরে রাখা উচিত৷ হাসপাতালের টেস্টিং মেশিন ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটানোই আজকের এক নম্বর দাবি৷ অধিকাংশ হাসপাতালে বিশাল ইমারত আছে কিন্তু চিকিৎসক নেই৷ নেই চিকিৎসা সামগ্রী ও টেস্টিং মেশিন৷ করোনা মহামারীতে করোনার টেস্টিং মেশিন কয়টি হাসপাতালে আছে? করোনা এমন একটি রোগ চিকিৎসকদের এটা কোন সাবজেক্টই ছিলো না৷ বাংলাদেশে মাত্র হাতে গোণা কয়েকটি পিসিআর ল্যাবরেটরিতে করোনার পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ এতে করোনা সংক্রমণ কিভাবে রোধ হবে? এটা কেন দেশব্যাপী করা হলো না, বা করা গেল না? তবে কি সেটা বাজেট স্বল্পতার জন্য? এমনটি হলে কেন বাজেট বাড়ানো হলো না?

ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, ত্রাণকার্য পরিচালনা, পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধসহ বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর জন্য আরও ৫২ কোটি ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে৷ এমন বরাদ্দ আরও বহুখাতে হচ্ছে৷ এমন প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

তবে করোনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিষয়৷ সব বরাদ্দ ছাপিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। এতে চিকিৎসকদের সুরক্ষা এবং প্রতি হাসপাতালে করোনা টেস্টিং যোগ্যতা অর্জন সম্ভব হবে? বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে হলেও এগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত৷ করোনা সংকট হতে বাঁচতে সব মন্ত্রণালয়ের উচিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করা৷ মন্ত্রী পরিষদের উচিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহিতায় ও স্বচ্ছতার মধ্যে রাখা৷ চিকিৎসা সেবার একমাত্র অগ্রগতিই পারে করোনা সংকট রুখতে৷ এ যুগ বিজ্ঞানের যুগ, অলীক ও অন্ধবিশ্বাসের নয়৷

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)