কানাডায় এখন পর্যন্ত ১১,২৮৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ১৭৩ জন আর সেরে উঠেছেন ১,৯৭৯ জন। এর মধ্যে টরন্টো, মন্ট্রিয়ল এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় প্রবাসী বাঙালিদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
কানাডায় বেশিরভাগ প্রবাসীরা এখন ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না। প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মার্চের শুরু থেকেই বেশিরভাগ মানুষ ঘরে বন্দি। দোকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলছে না। কাজ নেই, আয়ের পথও বন্ধ। এতে গত ১০-১৫ দিনে ধরে রেমিট্যান্স পাঠানো প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ। এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে নিজেদের খরচ মেটানোই দায় হয়ে যাবে বলে মন্তব্য অনেকের। আবার অনেকের জরুরি প্রয়োজনে টাকা পাঠানোর দরকার থাকলেও বের হতে পারছেন না ঘর থেকে।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এখন পুরো বিশ্ব অবরুদ্ধ। ফলে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে আশা জাগানো প্রবাসী আয়ে ধাক্কা লেগেছে। রেমিট্যান্স আহরণের দেশগুলোর অচলাবস্থায় বেকার হয়ে পড়ছেন অনেক প্রবাসী। সংশ্নিষ্টদের আশঙ্কা সামনের দিনগুলো প্রবাসীদের জন্য কঠিন হওয়ার পাশাপাশি অব্যাহত থাকবে রেমিট্যান্সের নেতিবাচক ধারা।
বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আহরণের অন্যতম উৎস আমেরিকা ও কানাডা। দেশগুলোর বর্তমান অবস্থায় খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে প্রবাসীদের জীবনযাত্রা। অনেকেই ঘরে বসে গুনছে সুদিনের প্রহর।বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রবাসীদের অনেকেরই কাজ নেই। ঘরে বসে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। করোনার প্রার্দুভাবের এই সময়ে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন ধরে কাজ বন্ধ হলে কর্মহীন অবসর সময় কাটান বেশিরভাগ প্রবাসীরা। গ্রহণ করেন সরকারের দেয়া এমপ্লয়মেন্ট ইন্সুরেন্স।
আমরা যারা প্রবাস জীবন যাপন করি তাদের সকলের মন পড়ে থাকে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি। সবসময়ই দেশকে নিয়ে ভাবনা। ঘরে বসে প্রবাসীরা ইন্টারনেট, ফোন, ভার্চুয়াল ও ভিডিওগ্রাফির মাধ্যমে খবর নিচ্ছেন একে অপরের। যোগাযোগ রাখছেন দেশের আপনজনদের সাথে। ভিডিও কলের মধ্য দিয়ে প্রবাসীরা গ্রুপে আলোচনা করছে কানাডার বর্তমান অবস্থা ও নিজ দেশের কথা। দেশের রেমিট্যান্স কমায় অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে এমন প্রশ্নের উত্তরে অনেক প্রবাসী মন্তব্য করেছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমলে বাংলাদেশের দু’টি জায়গায় সরাসরি আঘাত আসবে। একটি হলো নিম্নবিত্তদের অবস্থা করুণ হবে আর দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৪ মার্চ পর্যন্ত ১১৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে যা গত বছরের মার্চের একই সময়ে ছিল ১২০ কোটি ডলার। এ হিসাবে রেমিট্যান্স কমেছে দুই কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণে রেকর্ড হয়। ওই সময়ে প্রবাসীরা ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা অর্থবছর হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। এর ধারা অব্যাহত রাখতে গত অর্থবছরের বাজেটে রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনাসহ প্রবাসীরা যেন অর্থ সহজে পাঠাতে পারেন এ জন্য বেশ কিছু শর্ত শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অন্যদিকে বিশ্ব শেয়ারবাজারকে নজিরবিহীন এক দুর্যোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে করোনাভাইরাস। বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর পদক্ষেপ- কিছুই যেন আটকাতে পারছে না সূচকের পতন। করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে ব্যাপক বিক্রির চাপের কারণে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজার ঐতিহাসিক ক্ষতির মুখে পড়েছে- যা ৩৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। খবর বিবিসি, ব্লুমবার্গ।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ভাইরাসটির বিস্তার কমাতে দেশে দেশে বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্যে শেয়ারবাজারের এই দরপতন হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে এবার বিশ্ব অর্থনীতিতে যে আঘাত আসতে শুরু করেছে তাতে ২০০৮ সালের মন্দার চেয়ে বড় আর্থিক সংকট তৈরি হবে বলে অর্থনীতিবিদরা হুশিয়ার করেছেন। ইতালি ও স্বল্পোন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর পরিস্থিতি আরও খারাপ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা মঙ্গলবার বলেছেন, ‘২০২০ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রবণতায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে মন্দা পরিস্থিতি উদীয়মান বাজার ও স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে যে আঘাত হানবে তা নিয়ে।’ ইউএস ব্যাংক ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের বিশ্লেষকরা বলছেন, মুদ্রানীতি ও আর্থিক খাতে প্রণোদনার ঘোষণার পরও যতক্ষণ পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর মেয়াদ ও প্রভাব অজানা থাকবে, তেলের দাম অবদমিত ও মুনাফার সম্ভাবনা মেঘাচ্ছন্ন থাকবে, ততদিন শেয়ারবাজারের অস্থিরতা বাড়তে থাকবে বলেই আমরা আশঙ্কা করছি।
করোনাভাইরাসের প্রতিক্রিয়ায় কানাডার শেয়ার বাজারে সম্প্রতি স্মরণকালের সবচেয়ে বড় পতন ঘটেছে । একদিনের পতনের ইতিহাস পর্যালোচনায় ১৯৪০ সালের পর এই ধরনের পরিস্থিতি এই প্রথম বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন। বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়ে গেছে মন্দা। এবারের মন্দা ২০০৯-এর মন্দাকেও ছাড়িয়ে যাবে। স্থবির অর্থনীতিকে গতিশীল করার মাধ্যমে মন্দার সময় ও গভীরতাকে কমিয়ে আনতে কার্যক্রম শুরু করতে তাগিদ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আইএমএফ-এর প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রভাবে বিশ্বের আর্থিক কর্মকাণ্ড হঠাত স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে শুরু হয়েছে মন্দা। এ মুহূর্তে উদীয়মান দেশগুলোর প্রয়োজন আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু এ পরিমাণও প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে তিনি মনে করেন। গত শুক্রবার অনলাইনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন মন্তব্য করেন। জর্জিয়েভা আশা প্রকাশ করে বলেন, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে বিশ্ব মন্দা সামলে উঠতে পারে। কিন্তু এজন্য উদীয়মান দেশগুলোকে সহায়তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। তিনি বলেন, গত কয়েক সপ্তাহে উদীয়মান দেশের শেয়ারবাজার থেকে ৮৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি পুঁজি তুলে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিশ্ব অর্থনীতির একটা মূল উদ্বেগ হলো দেউলিয়া অবস্থা এবং কর্মী ছাঁটাই, যা শুধু পুনরুদ্ধারকে বাধা দেবে তাই নয়, সমাজের কাঠামোকেও ক্ষয়িষ্ণু করে তুলবে। এই দেশগুলো ঋণের ভারে জর্জরিত। উন্নয়নশীল ৮০টিরও অধিক দেশ আইএমএফ থেকে জরুরি ভিত্তিতে অর্থ সাহায্য চেয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। এদিকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ কোভিড-১৯ এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য জরুরি সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে। শুক্রবার বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধানরা বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোকে বড় দায়িত্ব নিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বলেছেন, ঋণ সংকটে থাকা দেশগুলো এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক দেশের বাড়তি সহায়তা প্রয়োজন হবে। তিনি জানান, এরই মধ্যে ৬০টি দেশে জরুরি সহায়তার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিশ্বব্যাংক করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এরই মধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলারের জরুরি তহবিল গঠন করেছে। এরই মধ্যে ২ বিলিয়ন ডলারের ২৫টি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নিজের পাশাপাশি আপনজনদেরকে নিয়ে প্রবাসীদের ভাবনা যেন এক চিরাচরিত দায়িত্ব। এতকিছুর পরেও আশা নিয়েই বুক বেঁধে আছি আমরা। সুদিন আসবেই।