আশা ছিল কোভিড-১৯ মানুষকে হিংসা, বিবাদ, পরচর্চা তথা কু রিপুকে দমন করতে শেখাবে। কিন্তু মানুষ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও নিজেদের সংশোধন করতে পারেনি।
একটা ক্ষুদ্র অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে বিশ্বের সমস্ত শক্তি আজ পরাস্ত। এক দেশ আরেক দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। মানুষ মানুষ থেকে দূরে থাকছে নিজের জীবন রক্ষা করতে। এ নির্মম শাস্তি প্রকৃতি কেন দিচ্ছে তা ভাবার বোধ শক্তি মনে হয় মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। সবাই যার যার মত করে মনে করছে অন্য কেউ মরে গেলেও আমি নিজে বাঁঁচব। আজও মিথ্যা মোহ, দাম্ভিকতা নিয়ে চলছে লড়াই। কোভিড-১৯ যে সত্য উন্মোচন করেছে তা মানতে নারাজ মানুষ। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, প্রকৃতি তার নিয়মে কাউকে ছাড় দেয় না। আর সে কারণে মানুষকে ঘর বন্দি করে বুঝিয়ে দিচ্ছে, কত অন্যায় অবিচার এ পৃথিবী সহ্য করেছে। সীমা লঙ্ঘনকারীকে শাস্তি পেতেই হয়।
ভালো কোন খবর দিয়ে এখন আর দিন শুরু হয় না। প্রতিদিন মৃত্যু আর করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংবাদে বিপর্যস্ত জনজীবন। অপেক্ষা কেবল এ ভাইরাসের প্রতিষেধকের জন্য। সে সাথে লক ডাউনের কারনে বাড়ছে ক্ষুধার হাহাকার। অর্থ কষ্ট ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। এ দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় কম বেশি সকল মানুষ আছে। সারা বিশ্ব আপ্রাণ চেষ্টা করছে করোনা ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে। কিন্তু এখনো পারছে না।
কোভিড-১৯ কোন জাত ধর্ম রাজনীতি চিনে আক্রমণ করছে না। মানুষ এর বাহক। সে মানুষ মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান বা অন্য কোন যে কোন ধর্মের। এ আক্রান্ত পপরিস্থিতি নিয়ে ধনী গরীব সব দেশ আজ এক কাতারে সামিল। সম্পদ, অস্ত্র, অর্থ সব কিছু মূল্যহীন। কারণ এর চিকিৎসা নেই। নিজের ভেতরের জৈবিক শক্তি থাকলে নতুন জীবন লাভ না হয় মৃত্যু। আর মৃত্যুকালে থাকে না কোন স্বজন। হৃদয় বিদারক এক বিদায়।
তাই এ ভয়াবহতা থেকে বাঁচার জন্য দরকার মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। বিপদে পাশে থাকার নাম হলো মানবতা। কোভিড ১৯ এমন এক ব্যাধি যার কারনে পিতার পাশে থাকেনি পুত্র। সন্তানকে ফেলে চলে গেছে মা। এমন নজির দেখেও সমাজের কিছু মানুষ করোনা ভাইরাসের মহামারী প্রতিরোধ করতে মাঠে নেমেছে আক্রান্ত বা মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে। তাদের বিবেক ও দায়িত্ববোধের কাছে পরাজিত হয়েছে জাত, ধর্ম পরিচয়।
মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম হলো ‘ মানবিকতা ‘। নাম বা পরিচয় দিয়ে ধর্মকে বোঝা সম্ভব নয়। মুসলমান ঘরে জন্ম নিলে হয় মুসলিম। হিন্দু ঘরে জন্ম নিলে হয় হিন্দু। এটা হলো বাহ্যিক ধর্ম পরিচয়। এ চিন্তার বাইরে গিয়ে নিজেকে জানার চেষ্টা করতে পারলে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়ে সাম্প্রতিক বির্তকটা হতো না দেশে।
বিদ্যানন্দ প্রতিষ্ঠানটি একজন হিন্দুর হাতে গড়ে উঠেছে বলে এর নামে হিন্দুত্ব খোঁজার মানসিকতা সমাজকে লজ্জিত করে। আর আধুনিক বলে দাবি করা বাংগালী সমাজে এ সাম্প্রদায়িক চিন্তা আবারও প্রমাণ করল, ‘তথাকথিত ধর্মের জাল থেকে আমাদের মুক্তি নেই। ‘
কোভিড-১৯ এর শুরু থেকেই যে প্রতিষ্ঠানটি তার স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারেনি ধর্মান্ধ কিছু মানুষ। বরং সাম্প্রদায়িকতার নোংরামি করে বিভক্ত করছে মানুষকে। তবে এ মহামারীর সময় এ ধরনের কাজ কি কোন রাজনৈতিক চাল কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ রাজনীতি ও ধর্ম পরস্পরের সহোদর।
‘আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন’- এ শ্লোগানে জন্ম নেয়া বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সফলভাবে মানুষের জন্য কাজ করছে অনেক দিন ধরে। কোভিড১৯ এর চলমান মহামারী তে তারা সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা, ত্রাণ সাহায্য সেবা দিয়ে সারাদেশের নজর কেড়েছে। এক টাকার আহার – এ চিন্তা যার মননে আছে সে কিশোর কুমার দাস সাম্প্রদায়িকতার কাছে হার মেনে যাওয়াটা বেদনাতুর করে মুক্ত চিন্তাকে।
যেখানে বিদ্যানন্দ প্রতিষ্ঠানের শ্লোগানে এর নামের মমার্থ লুকিয়ে আছে। সেখানে কিশোর কুমার দাসের নিজের সরে যাওয়ার ব্যাখ্যায় প্রমাণ করে, এ সমাজে ধর্মীয় সংকীর্নতা কিভাবে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে আছে । তিনি কৈফিয়ত আকারে বলেন, ‘বিদ্যানন্দ নামটি দিয়েছেন একজন মুসলমান ব্যান্ড এক্সপার্ট। “আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন ” শ্লোগানের সাথে মিল রেখে তিনি নামটি দিয়েছিলেন। অনেকেই এটাকে ব্যক্তি নাম থেকে নেয়া বলে প্রচার করেন। এজন্য আমরা দুই বছর আগে নাম পরিবর্তনের পক্ষে বিপক্ষে ভোট করি এবং স্বেচ্ছাসেবকরা নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে ভোট দেয়। ‘
বাংলাদেশ ও বাংগালী বাস্তবতার নিরিখে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে যেতে পারেনি। আর সে কারণে ব্যক্তিকে জড়িয়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে বির্তকিত করতে পারে। কিন্তু মানবিক ভাবনাকে জয় করতে হলে মন্দের সাথে লড়াই করতে হবে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম দেখে মানুষ আজ অভিভূত। ঘুষখোর পুলিশ এখন মানবিক পুলিশ হিসাবে আছে মানুষের পাশে। যেমন ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে। তারা আগামীতে যদি এ মানবিকতা বজায় রাখতে পারে তাহলে কেউ বলবে না পুলিশ খারাপ।
বিদ্যানন্দের কাজের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর সমর্থন আছে বলেই সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চারিত হয়েছে মানুষ। ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস আর সাম্প্রদায়িকতার কাছে পরাজিত হলে সমাজে পরিবর্তন আসবে না। তাই বিদ্যানন্দ আর কিশোর কুমার নামের মাঝে ধর্মের রাজনীতির সন্ধান করা অন্যায়। এ মুহূর্তে মানুষের জন্য মানুষকে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে । কোভিড-১৯ থেকে প্রকৃত ধর্ম ‘ মানবিকতার’ শিক্ষা নিতে না পারলে মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
বিদ্যানন্দের প্রবাসী উদ্যোক্তা সশরীরে খুব অল্পই সময় দিতে পারেন। ৯০ ভাগ মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকরাই চালিয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির বিশাল কর্মযজ্ঞ। তবুও উদ্যোক্তার ধর্ম পরিচয়ে অনেকেই অপপ্রচার চালায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে। যাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় কার্যক্রম, অনুদানের গতি। গত মাসেই বিদ্যানন্দের প্রধান পদত্যাগের কথা জানিয়ে দেন স্বেচ্ছাসেবকদের। সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে নয়, বরং ব্যক্তিগতত্যাগে স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপ্রাণিত করার এবং নতুন মেধায় প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করার স্বপ্নে এমন সিদ্ধান্ত। আর তিনি প্রধানের পদ ছাড়লেও বিদ্যানন্দ ছাড়ছেন না, সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে চেয়েছেন।’
বিদ্যানন্দ জানায়, আমরা বিষয়টি প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম চলমান ক্যাম্পেইনের পরে। কিন্তু কিছুদিন ধরে চলা মাত্রাতিরিক্ত সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে জল ঢালতে খবরটি আজকে শেয়ার করলাম। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বিষয়টি হতাশার নয়। পদ আঁকড়ে থাকার মানসিকতার এই সমাজে উল্টা পথে হাঁটতে পারার জন্য গর্ব হচ্ছে। আর বিদ্যানন্দে পদে কি যায় আসে? এখানে তো কাজটাই আসল, আর সেটাই আমরা করে ছাড়বো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)