বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে মহামারী এরকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বারবার এসেছে। মানুষ তার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এইসব মহামারী পার হয়ে আজও জীবন্ত। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে বিজ্ঞানেও মানুষ অভাবনীয় উন্নতি অর্জন করেছে। মহামারীকে পর্যুদস্ত করেছে তার মেধায় ও উৎকর্ষতায়। যেসব মহামারী বিশ্ব সভ্যতাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেসবের উল্লেখ আছে ইতিহাসে সাহিত্যে বিজ্ঞানে দর্শনে রাজনীতিতে। অর্থাৎ মানব সভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে এই প্রাকৃতিক রোগবালাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
তবে দ্বাবিংশ শতকের এই উন্নততর সভ্যতায় রোগশোকের মহমারীতে যেনো ভয়ানক বিচলিত মানুষ। মানুষ একা হতে হতে এখন আবার একা হয়ে যাওয়ার বাধ্যবাধকতায় চলে যাচ্ছে। এই ভাইরাস মানবসৃষ্ট না প্রাকৃতিকভাবেই হাজির হয়েছে তা সময় এলে জানা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত মানুষ এই করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে দুঃশ্চিন্তা বাড়ছে। উন্নত সভ্য দেশ থেকে একেবারে গরীব দেশ পর্যন্ত এই করোনাভাইরাসের শিকার। আর আমাদের প্রজন্ম সভ্যতা ধ্বংস করা কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হইনি। এই প্রথম আমরা দেখলাম মহামারী কি।
বিশ্ব সভ্যতায় মহামারী নতুন কিছু নয়। ইতিহাসের দিকে একটু তাকানো যাক। এই সব মহামারীতে আমরা পৃথিবীর বিখ্যাত বহু মনীষীকে হারিয়েছি।
মহামারীর কথা এলেই প্রথমে আসে প্লেগের কথা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্লেগ প্রসঙ্গটি খুঁজে পাওয়া যায় রোমান সাম্রাজ্যে। জানা যায়, রোমান সম্রাট প্রথম জাস্টিয়ানের প্লেগ হয়েছিল। তবে চিকিৎসায় তিনি বেঁচে ওঠেন। এই মহামারিতে আড়াই থেকে পাঁচ কোটি লোক প্রাণ হারায়। প্লেগের দ্বিতীয় মহামারি হয় ১৩৪৭ সালে। এটা ছিল কুখ্যাত বিউবনিক প্লেগের মহামারি এবং এতে প্রায় এক–তৃতীয়াংশ লোকের প্রাণহানি ঘটে। ইতিহাসে এটি ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত। বন্য ইঁদুরের মধ্যে রোগটি এখনো বিদ্যমান থাকায় তাদের সংস্পর্শে এলে মানুষের এই রোগ ছড়াতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্লেগ মহামারি ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। তবে এই ১৯৯৪ সালেও ভারতের ৫টি প্রদেশে প্রায় ৭০০ জন প্লেগে আক্রান্ত হয়। আলবেয়ার কামু বিখ্যাত ফরাসি লেখক। তার প্লেগ উপন্যাসে এই মহামারীর বর্ণণা দিয়েছেন এইভাবে-
…..দূর শহর থেকে ভেসে আসা তুমুল হর্ষধ্বনি শুনতে শুনতে রিও-র মনে হল, মানুষের এই উল্লাস হয়তো আবার একদিন বিপন্ন হবে, কারণ প্লেগের জীবাণু কখনোই পুরোপুরি ধ্বংস হয় না, হারিয়েও যায় না চিরতরে। বছরের-পর-বছর এই জীবাণু লুকিয়ে থাকে আসবাবপত্র আর কাপড়চোপড়ের মধ্যে, অপেক্ষা করে শোবার ঘরে, ভাঁড়ারে, বুকশেলফে। তারপর সেই দিনটি আসে যেদিন এই জীবাণু মানুষের সর্বনাশের জন্য আবার ইঁদুরগুলোকে জাগিয়ে উত্তেজিত করে মরবার জন্য, এবং ঝাঁকে ঝাঁকে ওদেরকে পাঠিয়ে দেয় আনন্দমুখর কোনো শহরে।…..
১৮০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে মহামারী আকারে কলেরা শুরু হয়। কলেরা প্রথম শুরু হয়েছিল আমাদের এই অঞ্চলে।এ রোগকে ‘ওলা ওঠা’ নামে ডাকা হতো। চীন, রাশিয়া ও ভারতে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কলেরারকালে আমরা হারিয়েছি মহান শিক্ষক ডিরোজিওকে। যিনি এই অঞ্চলে শিক্ষা ও নারী শিক্ষা প্রসারে ব্যাপক অবদান রাখেন। কলকাতায় মেয়েদের জন্য একটি স্কুল করতে গিয়ে তিনি কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সেটি শেষ করতে পারেন নি। ২০১৭ সালে ইয়েমেনে এক সপ্তাহে কলেরায় অন্তত ১১৫ জনের মৃত্যু হয়। বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ কলেরা মহামারী কালের একটি উপন্যাস লেখেছেন। সেটির নাম- লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা। ল্যাটিন অমেরিকার প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসটিতে শেষ পর্যন্ত মানবতার জয় হয়েছে।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম থেকে গুটি বসন্তের প্রাদুর্ভাব শুরু। বিংশ শতাব্দীতে গুটিবসন্তে প্রায় ৫০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৯ সালে গুটিবসন্ত নির্মূলের ঘোষণা দেয়। তবে এই সময়কালেও অনেক লেখক গুটি বসন্তের কথা লেখে গেছেন। আমাদের এই অঞ্চলে এই রোগের প্রার্দুভাব ছিল অনেকটা কলেরার পর পরই।
গত দুই শতাব্দীতে ১০০ কোটি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, ২০২০ সালের মধ্যে ৬ থেকে ৯ লাখ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাবে। গত শতকের বিখ্যাত মাস্টার্স অর্টিস্ট, লেখক কবি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বিশ্বখ্যাত চেক-জার্মান লেখক ফ্রানজ কাফকা মারা যান যক্ষ্মায়। আমাদের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যও অসম্ভব প্রতিভার সাক্ষর রেখে মাত্র একুশ বছর বয়সে মারা যান এই রোগে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণামতে ইনফ্লুয়েঞ্জায় ১৯১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৫ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। তবে রোগ বিশেষজ্ঞদের ধারণা প্রায় ১০ কেটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এটাও মহামারী আকার ধারণ করেছিল। এ নিয়ে গল্প কবিতা আছে। তবে তা শিল্পের স্তুুপে বন্দি বলে মানুষ তেমন জানতে পারেনি।
আমাদের কালে আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসের প্রথম নাম শুনি। এই ভাইরাস প্রথম বিজ্ঞানীদের নজরে আসে ১৯৭৬ সালে আফ্রিকায়। ১৯৭৬ সালে ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দক্ষিণ সুদানে রোগাক্রান্ত মানুষের অর্ধেকের বেশিই মারা গিয়েছিল। ইয়ামবুকু গ্রামে মৃত্যুর আক্রান্ত ১০০ জনের ভেতর ৮৮ জনই মৃত্যুর কাছে হার মেনেছিল। ইবোলা ভাইরাস নিয়ে বিখ্যাত আফ্রিকান লেখক ওল সোয়েংকা কিংবা চিনুয়া আচেবের লেখায় আমরা কোনো উল্লেখ এখনও পাইনি। তবে নিশ্চয় আফ্রিকার এই মহামারী ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। কোনো সাহিত্যে আমরা ভবিষ্যতে হয়তো তার উল্লেখ পাব।
আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। স্বৈরচারী সরকার পতন আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আমরা বেঁচে আছি। ইতিহাসে আমরা মহামারীর ঘটনা পড়েছি। আর জীবদ্দশায় একটি মহামারী দেখে যাচ্ছি। যা কিনা মানব সভ্যতায় সামজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক অভিঘাতে একটি বিশাল দাগ রেখে যাবে। আমরা যদি বেঁচে থাকি একটি মহামারী ও তার সঙ্গে মানুষের নৈতিক পতনের স্বাক্ষী হয়ে থাকবো।
একটি আদর্শ ধারণ করে এই আমরা মানুষকে যূথবদ্ধতার কথা বলেছিলাম একদা। আজ উন্নত প্রাযুক্তিক সভ্যতায় এসে বলছি একা হয়ে যাও। কী নির্মম মানব যাপন! করোনাকালের এই নিঃসঙ্গতা বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নতুন কোনো সভ্যতা নির্মাণের দিকে যাচ্ছে না মানবিক ধবংসের দ্বারপ্রান্তে যাচ্ছি সেটাই এখন দ্রষ্টব্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)