করোনা মহামারিকালীন জেন্ডারভিত্তিক অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে দেশে নারী, কন্যাশিশু বড়ধরণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েই গেছে। সমাজে অবস্থানের দিক থেকে দুর্বলতার মাপকাঠিতে নারী ও পুরুষের মধ্যে বেশ বড়ধরণের ফারাক আছে। নারী মানসিক ও শারীরিক নিপীড়ণের কারণে ক্রমাগত দুর্বলতর হচ্ছে। সেইসাথে করোনার কারণে নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ও সেবা পাওয়ার হারও কমে গেছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাকের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ যৌথভাবে “লাইফ ইন দ্যা টাইমস অব করোনা ভাইরাস: এ জেন্ডার পারসপেকটিভ, এভিডেন্স ফ্রম বাংলাদেশ”বিষয়ক একটি গবেষণা পত্র উপস্থাপন করেছে আজ বুধবার। এই কাজে সহায়তা করেছে শেয়ার নেট ইন্টারন্যাশনাল।
গবেষণাতে বলা হয়েছে বিশ্বে করোনাকালে সবচেয়ে বেশি ঘটমান বিষয় ছিল স্বাস্থ্য এবং আর্থ-সামাজিক সংকট, যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণে প্রভাব রাখবে। করোনার পুরো সময়কালে জেন্ডার সম্পর্ক এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এই দিকে দৃষ্টিও খুব কম দেয়া হয়েছে।
এই গবেষণায় করোনাকালে বাংলাদেশের গ্রামের ও শহরের, নারী এবং পুরুষের জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে যে, কোন সংকটকালে, ভাইরাস সংক্রমণ ও অন্যান্য জটিলতা নারী এবং পুরুষের উপর কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব রাখতে পারে।
করোনার মতো সংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে নারীর স্বাস্থ্য চিন্তা সেখানে অপ্রধান বা গৌণ। বিশেষ করে নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়টিও এই করোনাকালে খুবই অবহেলিত ছিল। কারণ এসময়ে প্রজনন স্বান্থ্য সংক্রান্ত সুবিধাদি যেমন স্থায়ী ক্লিনিক, গৃহ-পর্যন্ত সেবা প্রদান, সেবাদানের সময় কমে যাওয়াসহ সরবরাহে বিঘœ ঘটেছে। সেইসাথে কমেছে সেবাগ্রহীতার সংখ্যাও।
২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ এর মার্চ পর্যন্ত এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে দেশের ১০ টি অঞ্চলে। অঞ্চলগুলো হলো রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, নেত্রকোণা, কুড়িগ্রাম, পটুয়াখালি, বরগুণা, নীলফামারি, ঢাকা মহানগরী এবং সাভার। করোনা চলাকালে এমজেএফএর জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বিষয়ক জরিপ এবং ব্র্যাকের জেপিজিএসপির ম্যাসকুলিনিটি, স্টিগমা এবং করোনা বিষয়ক জরিপের তথ্য এখানে ব্যবহৃত হয়েছে। গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন শাহানা সিদ্দিকী, ফারহানা আলাম, সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস এবং সামিরা আহমেদ রাহা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বহী পরিচালক শাহীন আনাম ।
গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে উত্তরদাতারা যখন করোনার গুরুত্ব ও বিপদ সম্পরকে জানতে শুরু করেন, তখন তারা অনুধাবন করেন যে শহরের লোক বেশি ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, গ্রামের মানুষ অনেক কম আক্রান্ত হচ্ছেন।
ঘরে থাকা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করে চলা কারোপক্ষেই বিশেষ করে পুরুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ তাদের উপার্জনের জন্য বাইরে যেতে হয়েছে এবং তা নিজের নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করেই। সাবান ও ডিটারজেন্ট পাউডার বা স্যানিটাইজার কেনা, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য খুবই ব্যয়বহুল ছিল।
অর্থনৈতিকভাবে দেখা গেছে পরিবারের বিশেষ করে নারীর জমানো টাকা সংসারের পেছনে ব্যয় হয়ে গেছে। খুব জরুরি কিছু জিনিষের দাম খুব বেড়ে যাওয়ার পর আর দাম কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে। দারিদ্রের কারণে বেড়েছে গৃহে ঝগড়া-বিবাদ এবং নারী প্রতি সহিংসতা। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো বাল্যবিয়ের হার বেড়েছে কারণ বাবা-মায়ের কাছে দারিদ্রের বোঝা কমানো মানে হচ্ছে বাড়ির কন্যা সন্তানকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেওয়া।
পরিবারগুলো তিনবার খাওয়ার পরিবর্তে দুইবার খেয়েছে। আয় কমে যাওয়ায় পরিবারে সার্বিক পুষ্টির মাত্রাও কমে গেছে। সবাই বাসায় অবস্থান করা সত্তে¡ও রান্নার সার্বিক দায়িত্ব পালন করেছে নারী। পুরুষ সদস্য বাইরে গিয়ে কিছু খেতে পারলেও, নারীরা ঘরে যতটুকু ছিল, তাই খেতেই বাধ্য হয়েছে।
দেশের ১ কোটি ৯০ লাখ স্কুল ছাত্রছাত্রীর অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনার বাইরেই থেকে গেছে। অনলাইন শিক্ষা গ্রামের ও দরিদ্র পরিবারের জন্য ফলপ্রসূ হয়নি। পড়াশোনা না থাকায় বাল্যবিয়ের হার বেড়েছে অনেক।
যেহেতু বর্তমানে স্বাস্থ্য পরিচর্যার কাজটি করোনা ঠেকানোর কাজে নিয়োজিত, তাই অন্যান্য অসুখের জন্য ক্লিনিক, হাসপাতালে যাওয়া লোকের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতা পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে। পরিবারের আয় কমে যাওয়া মানে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও স্যানিটারি ন্যাপকিন জাতীয় প্রজনন সামগ্রী কেনার ক্ষমতা হারাচ্ছেন তারা। প্রত্যেক উত্তরদাতা চরম চাপ ও উদ্বিগ্ন অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তাদের প্রত্যেকেরই মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রয়োজন।
নারীর চলাচল নানাকারণে ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। কাজের জন্য বাইরে না গিয়ে ঘরের কাজ ও বয়স্ক ও শিশুদের দেখাশোনা করে দিন কেটেছে তাদের। লকডাউনের প্রথম কিছুদিন পুরুষরা গৃহঅভিমুখী হলেও, দ্রুতই তাদের কাজের ও সমাজ রক্ষার প্রয়োজনে বাইরে যেতে হয়েছে। প্রথম দিকে সবাই মোবাইল ভিত্তিক কমিউনিকেশনের উপর নির্ভরশীল থাকলেও পরে অতিরিক্ত খরচের কারণে তা টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। জরিপ চলাকালীন সময়ে সামাজিক অনুষ্ঠান সীমাবদ্ধই ছিল।
নিরাপত্তাহীনতা ও বিভিন্ন ধরণের চাপ ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বিশেষ করে আয়ের সংস্থান কমে যাওয়ায় সংসারে দৈনন্দিন ঝগড়াঝাটি ও মতদ্বৈধতা অনেক বেড়েছে। নারীকেই ঝগড়া থামানোর উদ্যোগ নিতে হয়েছে।
যৌনজীবনে পুরুষ তাদের স্ত্রীদের সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা না করেই, তাদের কাছ থেকে অধিকমাত্রায় অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করেছে। অন্যদিকে অনেক নারী উত্তরদাতাও বলেছেন যে বিভিন্নধরণের মানসিক অস্থিরতার কারণে তাদের স্বামীরাও যৌনজীবনে ঠিকমতো সাড়া দিতে পারেননি। নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা ও ধরণ বেড়েছে। করোনার কারণে নারী আইনগত ও সামাজিক সহায়তায়ও সেভাবে পাননি।