কুকুরের লেজ সোজা হতে দেখেছেন কখনও? না। এজন্যই হয়তো প্রবাদ আছে: ‘১২ বছর বেঁধে রাখলেও কুকুরের লেজ কখনও সোজা হয় না।’ করোনাকালেও এ প্রবাদকে বাস্তব করে তুলছেন কিছু চেয়ারম্যান ও ধর্ষক নামের মানুষরূপী পশুরা। করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যেই তারা ত্রাণ চুরি, এ নিয়ে সংবাদ করায় সাংবাদিকদের মারধর এবং ভাইরাস আছে বলে গভীর রাতে কিশোরীকে ঘর থেকে অপহরণ করে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে!
করোনাভাইরাস বিশ্বে কতোটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তা নতুন করে বলার নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমরাও ভুক্তভোগী। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘরবন্দী। দু’ হাজার বিশ সালে জ্ঞান-বিজ্ঞান আর আধুনিক সমরাস্ত্রের যুগে এসেও পরাশক্তিগুলোর অসহায় আত্মসমর্পণ। তাও আবার ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে। কখন কে আক্রান্ত হয় এ আতঙ্ক সবার মধ্যে। এমন আতঙ্কের মধ্যেও দেশে কিছু হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখা গেল।
এর মধ্যে ভোলার বোরহানউদ্দিনে সাংবাদিক নির্যাতনের কথাই ধরা যাক। সেখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় বড় মানিকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। এ অপকর্মে সহযোগী তার ছেলে। ঢাকা থেকে বাড়ি গিয়ে ওই সাংবাদিক অভিযোগ পান জেলেদের জন্য আসা সরকারি চাল চুরি হচ্ছে। তিনি স্বাভাবিকভাবেই খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন। এখানে রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায়। চেয়ারম্যান নিজেই চাল চুরি করে বিক্রি করছেন। ওই সাংবাদিক দেখলেন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জেলেদের চাল চুরি করা হচ্ছে।
একজন সাংবাদিক যখন এমন কোনো ঘটনা দেখবেন, প্রমাণ হাতে পাবেন, তখন তার কাজ কী? এ প্রশ্নের জবাবে যে কেউ বলবেন, সংবাদ করা। তিনি প্রথমে বিষয়টা আরও খতিয়ে দেখবেন। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সংবাদ করবেন। জেলেদের জন্য আসা চাল যাতে আর চুরি না হয়, সেজন্য সংবাদের মাধ্যমে জনমত তৈরির চেষ্টা করবেন। ভোলার সেই সাংবাদিক সাগর চৌধুরী তাই করেছেন। এটাই কাল হয়েছে তার জন্য।
এখন প্রশ্ন হলো: সাংবাদিক সাগর চৌধুরী ঢাকা থেকে গিয়েও এমন অভিযোগ পেলেন, স্থানীয় সাংবাদিকরা এতদিনেও কি এসব দেখেননি? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব বিষয় স্থানীয় সাংবাদিকদের অগোচরে হয় না। তাদের মধ্যে দু’চারজন ছাড়া বেশিরভাগই চালচোর চেয়ারম্যানদের সহযোগী, এমনকি ক্যাডার হিসেবে কাজ করেন। ব্যতিক্রম দু’চারজন যারা আছেন, তারা বলতে গেলে সংখ্যালঘু। এজন্য মিডিয়া হাউজগুলোও কম দায়ী নয়। সেসব বিষয় অবশ্য এখানে আলোচনার বিষয় নয়।
চালচোর চেয়ারম্যানের এ অপকর্ম যখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেনে গেলেন, তখন থেকেই সাংবাদিক সাগরের ওপর হুমকি দেওয়া শুরু হলো। তাকে নিজেদের পক্ষে ভেড়াতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সংবাদের বিষয়ে নিজেদের বক্তব্য জানাতে ডেকে নেওয়া হয়। এরপর মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে ফেসবুক লাইভে পেটানোর মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা। এলাকায় তারা কতোটা বেপরোয়া হলে এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে তা এ ঘটনা থেকে বুঝা যায়।
তবে শেষ রক্ষা হয়নি সেই চেয়ারম্যানের ছেলের। সোশ্যাল মিডিয়াসহ সাংবাদিকদের প্রতিবাদের মুখে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের ছবি দেখে অবশ্য মনে হয়নি সে অনুতপ্ত। আর পুলিশও তাকে হাতকড়া পরায়নি, যেখানে সাংবাদিকদের লেখালেখির অপরাধে কোমরে রশি বেঁধে আদালতে নিতেও দেখা গেছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন আইনকে তার নিজস্ব গতিতে সবার জন্য সমানভাবে চলতে দেননি। এরপরও হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করায় তাদের ধন্যবাদ।
এ ঘটনার পর জানা গেল হবিগঞ্জে আরেক চেয়ারম্যানের সাংবাদিক নির্যাতনের কথা। সেটাও ত্রাণের চাল চুরি। এলাকার অসহায় মানুষদের জন্য ১০ কেজি করে চাল বরাদ্দ হলেও দেওয়া হয় ৫ কেজি করে। এমন খবর পেয়ে সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহের জন্য সেখানে গেলে ওই চেয়ারম্যান ব্যাট দিয়ে মারধর করেন সাংবাদিকদের!
এ দু’টো ঘটনা হয়তো সামনে এসেছে সাংবাদিকরা মারধরের শিকার হওয়ার কারণে। কিন্তু হলফ করে বলা যায় যে, প্রতিনিয়ত এমন হাজারও চুরির ঘটনা ঘটছে দেশব্যাপী। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকেও কথা বলতে হয়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৬৪ জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বরাদ্দ হওয়া ত্রাণ চুরির বিষয়ে কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন। হুঁশিয়ার করেছেন। এরপরও তৃণমূল পর্যায়ে চোরদের চুরি থামেনি! এগুলো দেখার দায়িত্ব কার? এমন দুর্যোগেও অনেক সংসদ সদস্য এলাকায় যাননি। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করবে কারা? সুতরাং যা হওয়ার তাই হচ্ছে। তারা এতদিনও চুরি করেছেন, করোনা দুর্যোগের এই সময়ও চুরি ও ক্ষমতার দাপটে ‘ধরাকে সরা জ্ঞান করা’ অব্যাহত রেখেছেন।
এছাড়া কুড়িগ্রামে স্বয়ং জেলা প্রশাসক তার অধীনস্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্যবহার করে সেখানকার এক সাংবাদিকের সঙ্গে ফিল্মি স্টাইলে যা করেছেন, তা রীতিমত বিস্ময়। ওই ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকেও এ বিষয়ে কথা বলতে হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। কুড়িগ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়েছেন ওই জেলা প্রশাসক। শুধু তিনি নন, তার সঙ্গে বিতাড়িত হয়েছেন অপকর্মের সহযোগী ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যরাও। সেখানেও জেলা প্রশাসনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের খবর প্রকাশ করা ও ফেসবুকে এর বিরুদ্ধে কথা বলায় রোষাণলের শিকার হয়েছিলেন সাংবাদিক আরিফ।
অন্যদিকে এমন করোনাক্রান্তিতেও ধর্ষণের খবর পাওয়া গেল জামালপুরে। তাও আবার বাড়িতে গিয়ে করোনাভাইরাস চেক করার নামে। গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, জামালপুর সদর উপজেলার মেষ্টা ইউনিয়নের জালালের চর রোহেলি গ্রামে করোনাভাইরাসের তল্লাশির কথা বলে গভীর রাতে পুলিশ পরিচয়ে ঘরে ঢুকে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়েছে। গণর্ষণের শিকার ওই কিশোরীকে পরদিন সকালে ঝিনাই নদীর পাড়ে আহত অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করে এলাকাবাসী।
করোনার আগে আমাদের অন্যতম প্রধান মহামারী ছিল ধর্ষণ। প্রতিদিন খবরের পাতায় অমার্জনীয় এ হিংস্রতা দেখতে হতো আমাদের। করোনাকালে সেই মহামারী একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি। জামালপুরের ঘটনা যেন তাই প্রমাণ করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের করোনাবিরোধী যুদ্ধের পাশাপাশি এই পশুদের বিরুদ্ধেও সজাগ থাকতে হবে। পাশাপাশি ত্রাণ চুরিসহ সব ধরনের অপরাধ বন্ধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে কথা বলে সাংবাদিকরা মার খাচ্ছে বলে তাদেরকেই কথা বলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে; বিষয়টা এমন নয়। সবাইকে সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তুলতে হবে। নয়তো যেদিন আপনি এমন নির্মমতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হবেন, তখন আর আপনার পক্ষে কথা বলার কেউ থাকবে না। তবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন: বাসায় থাকা, নিয়ম মানা। করোনাযুদ্ধে জয়ী হতে এর বিকল্প নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)